অনির্বাণ দে: বহরমপুর
যুব আন্দোলনের কর্মীদের কাছে জেলখানাও এখন রাজনৈতিক পাঠাগার। বহরমপুরে ডিওয়াইএফএই’র ২০তম রাজ্য সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিদের মধ্যেই মিলিতভাবে তৃণমূল শাসনে জেলে কাটানো হয়ে গেছে ৭১০ দিন। তবু অদম্য জেদে কারো ভাটা পড়েনি। কারারুদ্ধ দিনগুলোর শিক্ষা তাঁদের চোয়াল আরও শক্ত করে দিয়েছে। কেউ এক মাস, কেউ দুই মাসের বেশি, আবার কেউ অল্প কিছুদিনের জন্য জেলে আটকে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়েই এবারের রাজ্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং যুবদের স্বার্থরক্ষার দাবিতে লড়াই তীব্র করতে সোচ্চার রয়েছেন।
এদিন সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় ডিওয়াইএফআই’র প্রাক্তন সর্বভারতীয় সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে বেকারত্বর বিরুদ্ধে লড়ছে ডিওয়াইএফআই। কেন্দ্রে প্রথম ইউপিএ সরকার গঠনের পর কাজের অধিকারের জন্য আইন তৈরির শর্ত দিয়েছিল বামপন্থীরা, আইনি স্বীকৃতি সহ একশোদিনের কাজের প্রকল্প চালু হয়েছিল। মোদী ক্ষমতায় বসেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আদর্শগতভাবে এই প্রকল্পের পক্ষে নন। আর তৃণমূল এরাজ্যে সরকার আসার পর এই প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি করেছে, গরিবের কাজের টাকা লুট করেছে। কাজের অধিকারের দাবি নিয়ে এর বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করতে পারে যুবরাই, কোনও ভয় দেখিয়েই তাঁদের মাথা নোয়ানো যাবে না।
সেই নির্ভীক লড়াইয়ের বার্তাই উঠে এসেছে ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্মেলনে। পাহাড়ের বাঁক থেকে নোনা জলের স্রোত। খরায় লাল মাটি থেকে ফসলে ভরা মাঠ। হাসপাতালের গেট থেকে চায়ের বাগানের চৌরাস্তায়। দাঁতে দাঁত চেপে লাগাতার লড়াইয়ের নতুন অক্ষ বুনছে ডিওয়াইএফআই। বুঝিয়ে দিচ্ছে হামলা, মামলা, জেল, কিছুতেই তাদের থামাতে পারবে না।
প্রতিনিধিদের মধ্যে সব থেকে বেশিদিন জেল খেটেছেন সাগর শর্মা। মীর আলম জেল খেটেছেন ৬৮ দিন। এক মাসের বেশি সময় জেলের অন্ধকারে কাটিয়েছেন মহম্মদ নুর জামান, সৌমজিত বিশ্বাসরা। তারা রয়েছেন যুবদের সম্মেলন। শহীদ কমরেড বিদ্যুৎ মণ্ডলের মা অমলা মণ্ডল সম্মেলনে সন্তানসমদের কথা শুনেছেন। তিনি বলছেন, ‘মনে হচ্ছে ছেলেদের সঙ্গেই আছি। ছেলেরা লড়ছে। সারাদিন ওদের লড়াইয়ের কথা শুনছি।’
এদিন সম্মেলনে উঠে এসেছে স্থানীয় ইস্যুতে লড়াই গড়ে তোলার কথা। মুর্শিদাবাদের ফরাক্কায় শিশুকে ধর্ষণ করে খুনের পর এফআইআর’এ ধর্ষণের ধারা যোগ করেনি পুলিশ। হাসপাতালেই মরদেহ আটকেছিলেন যুবরা। টানা দুই দিন মাটি কামড়ে লড়াইয়ের পর শিশুর ময়নাতদন্ত হয়। চার্শজিট জমা করাতেও রাস্তা আটকাতে হয়েছিল যুবদের। অবশেষে বিচারে স্বস্তি পেয়েছে পরিবার। কিন্তু লড়াকু যুবদের জুটেছে মিথ্যা মামলা।
একই রকম লড়াইয়ের সাক্ষী কুলতলির যুব কর্মীরা। আবার পূর্ব বর্ধমানের ভাতাড়ের কর্মীরা স্থানীয় মানুষকে নিয়েছে আন্দোলন গড়েছেন রেলের জন্য, তাতেও এসেছে জয়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সন্দেশখালির প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, গ্রামে জমির ভারসাম্য বদলে দিচ্ছে তৃণমূল, কায়েম হচ্ছে পুরানো জমিদারি ব্যবস্থা। এর প্রতিবাদে গ্রামের মানুষদের জোটবদ্ধ করছে যুবরা। একইভাবে হুগলীর সিঙ্গুরে শিল্পের জমিতে মাছের ভেড়ি গড়ার প্রতিবাদ করেছে ডিওয়াইএফআই। মুর্শিদাবাদের যুবরা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন পড়ে আছে রেজিনগরের শিল্প তালুকের জমি? শিল্প হবে কবে? ১০০ দিনের কাজ নিয়ে গ্রামের মানুষকে নিয়েই লড়েছে গলসী, কাঁকসার ডিওয়াইএফআই কর্মীরা।
জুটেছে হামলাও। সেই হামলার সাক্ষী মুর্শিদাবাদের ডিওয়াইএফআই নেতা হাসমত শেখ। রাজ্য সম্মেলনের দেওয়াল লেখার জন্য তাঁকে বিডিও অফিসে তুলে নিয়ে গিয়ে পিটিয়েছিল তৃণমূলের নেতারা। মারের চোটে জ্ঞান হারিয়েছিলেন হাসমত শেখ। তারপর ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন এলাকার ডিওয়াইএফআই কর্মীদের নিয়ে। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করতে বাধ্য হয়েছে পুলিশ। এই জেদ আর লড়াকু মেজাজের প্রতিফলন রয়েছে ডিওয়াইএফআই রাজ্য সম্মেলনে। সম্মেলনের মঞ্চে রয়েছে লড়াকু মানুষের প্রতিকৃতি। মুষ্ঠিবদ্ধ হাত নিচ্ছে লড়াইয়ের শপথ।
সম্মেলন উপলক্ষে বহরমপুর রবীন্দ্রসদন চত্বর সাজানো হয়েছে ডিওয়াইএফআই’র লড়াই আর সংগ্রামের ছবিতে। মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন উপাদান নিয়ে চলছে প্রদর্শনী। তুলে ধরা হয়েছে স্বাধীনতার লড়াইয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষের অংশগ্রহণের কথা। আর সেই প্রদর্শনীর বাইরে অভয় দিচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, দেওয়াল জুড়ে লেখা হয়েছে, "মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি"। সম্মেলন থেকে এই অপমানের অন্ধকারকে কাটানোর লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন যুবরা।
এদিন সম্মেলনে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ চলছে। আর তা নিয়ে চর্চার নামে দক্ষিণপন্থীরা দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদের নামে যুদ্ধোন্মাদনা আর ধর্মীয় উন্মাদনা ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে জনমত নির্মাণের চেষ্টা করছে। দেশপ্রেম আর উগ্রজাতীয়তাবাদের মধ্যে ফারাক অনেক। আন্তর্জাতিকতাবাদ ও দেশপ্রেমের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। যুবরা দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করছে। দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থেই যুদ্ধজিগিরের বিরোধিতা করতে হবে, হক কথা সোচ্চারেই বলতে হবে।
Comments :0