Panchayat vote 2023

সারা দিন জড় হয়ে রইলেন কমিশনার

কলকাতা

শনিবার রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট নেওয়া হলো। এদিনও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহা ‘জড়’ হয়েই রইলেন। ভোট শুরু হওয়ার তিন ঘণ্টা পরে তিনি কমিশনের অফিসে এলেন। তারপর চেম্বার থেকে একবারও বের হলেন না। সকাল সাতটা থেকেই কমিশনের কন্ট্রোল রুমের এক ডজন ফোন বেজে চলেছে। কর্মীদের কারও ইচ্ছা হলে ফোন ধরছেন। ইচ্ছা হলে ই-মেল দেখছেন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযোগের পাহাড় জমে যাচ্ছে। কিন্তু কমিশনের কারও কিছু করার নেই। সঙ্গে দিনভর নাটক চলল রাজ্য নির্বাচন কমিশনার এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর আধিকারিকদের।  
এদিন ভোট শুরুর তিন ঘণ্টা পরে যখন রাজীব সিনহা তাঁর দপ্তরে ঢুকলেন, ততক্ষণে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে ৭ জনের মৃত্যুর খবর এসে গিয়েছে। দপ্তরে ঢুকে তিনি অন্য দিনের থেকেও এদিন আরও বেশি চুপ ছিলেন। ছিলেন নির্বিকল্পও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, এই অফিসার রাজীব সিনহাকে দিয়েই পঞ্চায়েত ভোট করাবেন। কারণ রাজীব সিনহা ছাড়া তাঁর হাতে অন্য কোনও ‘বশংবদ’ বিকল্প ছিল না। রাজ্য নির্বাচন কমিশনারও তাঁর উপর ন্যস্ত দায়িত্ব এক মাস ধরে মুখ বুজে পালন করলেন। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের কোনও পরিকল্পনা ৮ জুলাই পর্যন্ত করা হয়নি। স্পর্শকাতর বুথের তালিকাও কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে দেওয়া হয়নি।
এদিন রাজীব সিনহা অফিসে ঢোকার কিছু পরেই সিআরপিএফ’র ডেপুটি কমান্ড্যান্ট দিলীপ মালিক কমিশনের অফিসে আসেন। তিনি কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠক যখন চলছে, তখনও রাজ্যে সন্ত্রাসের ভোট চলছে। সকাল ১১টার পর বিএসএফ‘র আইজি সতীশ চন্দ্র বুদাকোটি নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করতে কমিশনের দপ্তরে আসেন। তাঁর সঙ্গে সেই সময়ে বাহিনী মোতায়েন নিয়ে আলোচনা হয়। ৬৬০ কোম্পানি বাহিনী মোতায়েন হবে তখন বলে ঠিক হয়। বেলা প্রায় ১২টার পরে জেলাশাসকদের কাছে বাহিনী মোতায়েনের বার্তা পৌঁছায়। ততক্ষণে নির্বাচনে ৯ জন খুন হয়ে গিয়েছেন। 
বিএসএফ’র আইজি এদিন রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানান, স্পর্শকাতর বুথের তালিকা তাঁর হাতে দেওয়া হয়নি। বেলা বারোটার সময়েও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে জেলাশাসকরা কিছু জানতেন না। ফলে জেলাশাসকরাও বলতে পারেননি, তাঁদের জেলায় কোথায় কত বাহিনী মোতায়েন হয়েছে। এমনকী, চার হাজারের উপর স্পর্শকাতর বুথে কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি।  রাজ্যের সব বুথে যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে না, তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ৬৫৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রাজ্যে এসেছিল। চার হাজারের উপর স্পর্শকাতর বুথের সঙ্গে কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৬ হাজার বুথে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা যেত সেই বাহিনী দিয়ে। কিন্তু সেই বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত কাজে লাগানো হয়নি বলে ভোটের দিন কমিশনকে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেন বিএসএফ কর্তা নিজেই। 
শনিবার রাজ্যের ২২টি জেলার ৬০ হাজারের বেশি বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতির অভাব নিয়ে অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগের বাস্তবতা কতটা, তা বুঝিয়ে দিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে চিঠি দিয়ে অভিযোগ জানিয়ে রাখলেন আদালত নির্দেশিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর ‘ফোর্স কোঅর্ডিনেটর’ তথা বিএসএফ’র আইজি সতীশ চন্দ্র বুদাকোটি। চিঠি পাওয়ার পর পালটা উত্তর দেওয়া হয়েছে কমিশনের তরফেও। কমিশনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত সচিব (কমিশনের নোডাল অফিসার) চিঠিতে অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে কীভাবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ রেখে সহযোগিতা করা হয়েছে, তা উল্লেখ করেছেন। 
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ ছিল, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া থেকে শুরু করে ভোট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকবে। হাইকোর্ট বলেছিল, ৮২২ কোম্পানি বাহিনী দিয়ে ভোট করাতে হবে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন সুচতুরভাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি পাঠিয়ে বাহিনী পাঠানোর কথা বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজ্যে আসা ৬৬০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের তালিকা এদিন রাতেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার দিতে পারেনি। এদিনও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সামনে তৎপরতা দেখা গিয়েছে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের। রাজ্যপাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন বুথে গিয়ে ভোট দেখেছেন। তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ‘হাহুতাশ’ করেছেন। 
এদিন দুপুরে ২টো নাগাদ সাংবাদিকদের ডেকেছিলেন রাজীব সিনহা। তখন রাজ্যে ভোটের মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১০। সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, রাজ্য হিংসাত্মক পরিবেশে ভোট হচ্ছে। ১০ জন মারা গিয়েছেন। কমিশন কী তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলো? রাজীব সিনহা এই গোটা ব্যাপারটি রাজ্য পুলিশের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে বলেন, রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। কমিশনের কাজ নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা দেখা। এই কাজ কমিশন করেছে। কমিশন অভিযোগ পেয়ে পুলিশ সুপার এবং জেলা শাসকদের জানিয়ে দিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করবে। গ্রেপ্তার করবে। বেলা ২টোর সময় কমিশনার জানান, ‘‘আমরা এখনও পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছি।’’ 
মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রী। আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি সবসময়ে রাজ্য পুলিশের বিষয়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার এদিন নির্বাচনে হিংসা এবং মৃত্যুর দায় কার্যত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির দিকেই ঠেলে দিয়েছেন। রাজীব সিনহার বক্তব্য, ‘‘এই হিংসা এবং খুন, এটা তো অপরাধ। এই অপরাধের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করবে। তদন্ত করবে। আশা করি, পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।’’ কমিশনার আরও বলেন, ‘‘হিংসা এবং সন্ত্রাস বন্ধ করার দায়িত্ব যাঁরা জেলা স্তরের অফিসার রয়েছেন, তাঁদের। তাঁদের এই দায়িত্বও রয়েছে। আমাদের দায়িত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা করার। আমরা ব্যবস্থাপনায় কোনও ঘাটতি রাখিনি।’’ কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে রাজীব সিনহা বলেছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দেরি করেছে। আমরা যে সময়ে বাহিনী চেয়েছিলাম, সেই সময়ে বাহিনীর ছাড়পত্র পেলে সমস্যা হতো না। শুক্রবার পর্যন্ত আমরা ৬৬০ কোম্পানি বাহিনী পেয়েছি। জেলার পুলিশ সুপারদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নিরপেক্ষভাবে বাহিনী ভাগ করে মোতায়েন করতে হবে।’’
এদিন রাজ্যে মোট ৬১ হাজার ৬৩৬টি বুথের মধ্যে ৬০ হাজার ৫৯৩টি বুথে ভোট হয়েছে। ১০৪৩টি বুথে কোনও প্রার্থী না থাকায় ভোট হয়নি। কমিশন জানিয়েছে, এদিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৬৬.২৮ শতাংশ। হিংসাত্মক ঘটনার কারণে পুনর্নির্বাচনের দাবির প্রশ্নে কমিশন জানিয়েছে, ‘‘রবিবার আমরা গোটা ব্যাপারটি দেখব। যেখানে ১৫ শতাংশের কম ভোট পড়েছে বা যেখানে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে, সাধারণত সেই সব বুথেই পুনরায় ভোট হয়। যেখানে ভোট বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেখানেও পুনরায় ভোট নেওয়া হয়। এই সমস্ত দিক বিবেচনা করেই কোথায় কোথায় আবার ভোট হবে, তা ঠিক করা হবে।’’

 

 

Comments :0

Login to leave a comment