দেবেশ দাস
এসআইআর মানে ভোটার তালিকার Special Intensive Revision, বিশেষ নিবিড় সংশোধন। প্রতিবছরই ভোটার তালিকার সংশোধন (revision) হয়, কিছু নাম ঢোকে, কিছু নাম বাদ যায়। এসআইআর মানে বিশদভাবে তালিকাকে সংশোধন করা, খুটিয়ে দেখা, তাকে ত্রুটিমুক্ত করা। এটা আগেও হয়েছে, ২০০২ সালে। তখন এটা নিয়ে বিশেষ হইচই হয়নি। কিন্তু এবার হইচই হচ্ছে। হইচই শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, সারা দেশেই হচ্ছে। এবার হইচই হওয়ার কারণ, সাধারণত যেভাবে ভোটার তালিকা সংশোধন এতদিন হয়ে এসেছে, এবার নির্বাচন কমিশন সেভাবে করার কথা বলছে না। নয়া পদ্ধতিতে বিহারে এসআইআর হয়ে গেছে। এবার পশ্চিমবঙ্গে শুরু।
এসআইআর– আগের পদ্ধতি ও নতুন পদ্ধতি
আগের পদ্ধতিতে এসআইআর শুরু হতো চালু ভোটার তালিকা নিয়ে। সেখানে যাদের নাম আছে, দেখা হতো তাঁরা বেঁচে আছে কিনা ও সত্যি সত্যিই উল্লেখিত ঠিকানায় আছে কি না। যদি ভোটার তালিকায় উল্লেখিত ঠিকানায় সে বাস করে থাকে ও সে বেঁচে থাকে, তার নাম নতুন ভোটার তালিকাতেও থাকতো। এই পদ্ধতিটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ছিল, কারণ যার নাম একবার ভোটার তালিকায় আছে, সে তো কোনও প্রমাণপত্র দিয়েই ভোটার তালিকায় নাম তুলেছে। ভোটার তালিকায় নাম আছে অথচ সেই ব্যক্তি সেখানে থাকে না, বা কারও দুই জায়গায় নাম আছে, সে বাদ যেত নতুন তালিকা থেকে। এইভাবে পশ্চিমবঙ্গে ২০০২ সালে ২৮ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছিল। কোনও হইচই হয়নি।
গত ১১ সেপ্টেম্বরের পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত চিফ ইলেক্টোরাল অফিসারের একটি চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে যে দুটি তালিকা, ২০০২ সালের ১ জানুয়ারির ভোটার তালিকা ও ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারির ভোটার তালিকা নিয়ে এসআইআর শুরু হবে, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদেরকে দেখাতে হবে যে তার বাবা বা মার নাম ২০০২ সালে ভোটার তালিকায় আছে কিনা, তবে তাঁদের নাম এখনকার পরবর্তী ভোটার তালিকায় থাকবে। আবার এখন কোনও ব্যক্তি যেখানে থাকে, তার বাবা মা হয়তো ২০০২ সালে সেখানে থাকতো না, অতএব, নিজেদের উদ্যোগে বাবা-মার ২০০২ সালের বাসস্থানের ঠিকানায় গিয়ে ২০০২ সালের ভোটার তালিকা দেখতে হবে।
ভোটার হওয়ার ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর। ১৯৮৪ সালে যিনি জন্মেছেন, যার বয়স এখন ৪১, তার ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ভোটার তালিকায় নাম থাকা সম্ভব নয়। হয়তো সে ২০০৩ থেকে ২০২৪ অবধি লোকসভা, বিধানসভার ৯টি নির্বাচনে, পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের ৪টি নির্বাচনে ভোট দিয়েছে, বা কেউ কেউ প্রার্থীও হয়েছে, তবু এসআইআর’র নতুন নিয়মে তার ভোটার তালিকায় নাম থাকবে না, যদি তার বাবা বা মার ২০০২ সালে ভোটার তালিকায় নাম না থাকে। এরকম কতজন আছে? নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ভোটার তালিকায় মোট ১৮ থেকে ৩৯ বছরের ভোটারের শতাংশ ৪৫.৫। ৪১ বছর পর্যন্ত ভোটারদের শতাংশ আরও একটু বেশি হবে। আবার প্রত্যেকে তো আর ১৮ বছর বয়স হওয়া মাত্রই ভোটার তালিকায় নাম তোলে না, দুই-এক বছর দেরি হয়, সেরকম কোনও ব্যক্তি যে ধরুন ২০০১ সালে ১৮ বছর হওয়া সত্ত্বেও নাম তোলেনি, তার নামও ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ভোটার তালিকায় নেই। সেও সঙ্কটে। সব মিলিয়ে বর্তমান ভোটার তালিকার প্রায় ৫০ শতাংশের ক্ষেত্রেই এক পরীক্ষায় বসতে হবে। তাঁদের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮২ লক্ষ।
কেন এসআইআর’র পদ্ধতির পরিবর্তন?
২০০৩ সালে বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার (যে সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জি), নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এনে বলেছিল যে ১৯৮৭ সালের পর যারা এদেশে জন্মেছে তারা সরাসরি দেশের নাগরিক নয়। তাঁদের প্রমাণ করতে হবে যে তাঁদের মা বা বাবা, কেউ একজন এদেশের নাগরিক ছিল। এখন নির্বাচন কমিশন বলছে যে ১৯৮৪ সাল বা তার পরে যারা জন্মেছেন, তাঁরা ভোটার কিনা তা সন্দেহজনক, তাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁদের বাবা বা মা ২০০২ সালে পশ্চিমবঙ্গের কোথাও ভোটার ছিল। এটা কার্যত ২০০৩ সালের আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব প্রমাণের চেষ্টা। এনআরসি (ন্যাশানাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেনস) হচ্ছে ঘুরিয়ে। বিজেপি সরকার আসামে এনআরসি করে সেখানে নাগরিকত্ব খোঁজার চেষ্টা করেছিল, সেখানেও আনুষ্ঠানিকভাবে এনআরসি শুরু করার আগে কাজ শুরু হয়েছিল আগে ভোটার তালিকা নিয়ে। বিজেপি’র ইচ্ছা ছিল সারা দেশে এনআরসি করার, করতে পারেনি। এখন নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে সেই কাজে নেমেছে।
এক নাম একাধিক জায়গায়, বাদ যাবে?
পশ্চিমবঙ্গে যখন এসআইআর হয়েছিল ২০০২ সালে, তখন ভোটার ছিল ৪ কোটি ৯৬ লক্ষ, ২০১১ সালে তা দাড়িয়েছিল ৫ কোটি ৬২ লক্ষে, গত ১৪ বছরে তা বেড়ে, ২০২৫ সালে সেটা হয়েছে ৭ কোটি ৬৩ লক্ষে। এই ১৪ বছরে অনেকটা বেশি বেড়েছে। যদি ধরে নিই যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতোই ভোটার সংখ্যাও চক্রবৃদ্ধির হারেই বাড়বে, তাতে অঙ্ক কষে দেখানো যায়, ২০০২ সালকে ভিত্তি করে ২০২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে ভোটার সংখ্যা হওয়া উচিত ৬ কোটি ৮২ লক্ষ। তালিকায় সংখ্যা তার চেয়ে ৮১ লক্ষ বেশি। এরা কারা? আসলে এই এত ভোট বাড়ার কারণ, অনেক মৃতদের নাম এখনও আছে, কেউ এক জায়গা অন্য জায়গায় চলে গেলে দু’জায়াগাতেই নাম আছে, এসব তৃণমূল বাদ দিতে দেয়নি, আর সর্বোপরি তৃণমূল একই লোকের নাম একাধিক জায়গায় তুলেছে। নির্বাচনের সময় এই সমস্ত ভোটগুলি তৃণমূল গায়ের জোরে দিয়ে আসছে।
যে সমস্ত নাম একাধিক জায়গায় আছে, তাঁদের নাম বাদ পড়ার কোনও গ্যারান্টি নেই। কারণ কাগজপত্র দেখিয়েই তো নাম তোলা হয়েছে। তাদের বা তাদের বাবা-মার নাম ২০০২ সালের তালিকায় থাকলেও একই ব্যক্তির একাধিক জায়গায় নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কী হবে, সে কথা এসআইআর’র বক্তব্যে বলা নেই। বোঝাও যাচ্ছে না।
ভোটারদের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিয়ে বিজেপি’র ঘৃণা প্রচার
বিজেপি বলছে এই বাড়তি ভোটাররা সব বাংলাদেশের মুসলমান অনুপ্রবেশকারী। এটা বলে বিজেপি কিছু মুসলমানের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে চায়। এতে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো গেল, আর তৃণমূলের অপকর্মকেও আড়াল করা গেল। এক ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে চায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে। সেই অনুযায়ী গত ১০ অক্টোবর দিল্লিতে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র দৈনিক জাগরণ পত্রিকা আয়োজিত একটি আলোচনাসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ বলেন যে দেশে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে, এবং তা বাড়ার কারণ– অনুপ্রবেশ। মোদী সহ তাবড় তাবড় বিজেপি নেতা এতদিন মুসলিম পুরুষের চারটি বিয়ে ও গাদা গাদা বাচ্চা মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ানোর কথা বলে এসেছেন, কিন্তু অমিত শাহ সেদিন বলেছেন যে বেশি বাচ্চা হওয়ার জন্য মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়ছে তা নয়, তা আসলে বাড়ছে– অনুপ্রবেশের জন্য। তার বক্তব্য, মুসলিমদের সংখ্যা— “পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলি জেলায় এখন ৪০ শতাংশ অতিক্রম করেছে, … বর্ডারের জেলাগুলিতে ৭০ শতাংশ হয়ে গেছে”। অমিত শাহর এই তথ্য ডাহা মিথ্যে। জনগণনার রিপোর্ট এখনো বেরোয়নি বলে অমিত শাহ যা খুশি বলছেন। বাংলাদেশের সাথে বর্ডারে পশ্চিমবঙ্গে মোট ৯টি জেলা, তার মধ্যে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে ৬৭ শতাংশ মুসলিম ছিল, তারপরে মালদা (৫১%), উত্তর দিনাজপুর (৫০%), আর ৬টিতে ৩০ শতাংশের কম, মুর্শিদাবাদ ছাড়া আর কোনও জেলার ক্ষেত্রেই বর্তমানে মুসলিম শতাংশ ৭০ হওয়া অসম্ভব। সীমান্তবর্তী ছাড়া অন্য জেলাগুলির মধ্যে একমাত্র বীরভূমে মুসলিমদের শতাংশ ৪০-এ পৌঁছাতে পারে, আর কোন জেলার ক্ষেত্রে তা হতে পারে না (বীরভূমে ২০১১ সালে ৩৭% ছিল, অন্য জেলাগুলিতে ৩০ শতাংশের নিচে)।
মুসলিম অনুপ্রবেশের তত্ত্ব কতটা ঠিক?
(১) ২০০১ থেকে ২০১১, সারা দেশে মুসলিমদের শতাংশ বেড়েছে ২৪.৬ (অমিত শাহ সেটা উল্লেখ করেছেন), কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা ২১.৮। অনুপ্রবেশে তো পশ্চিমবঙ্গে এই শতাংশ বাড়ার কথা, তা হয়নি তো।
(২) অমিত শাহর বক্তব্য অনুযায়ীই, অনুপ্রবেশে সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে বেশি ভোটার বাড়ার কথা। কিন্তু শুধু সেখানে তা বাড়েনি।
(৩) ওই দেশে সংখ্যালঘু নিরাপত্তার অভাবে, হিন্দুরা এদেশে আসতে পারেন, বাস্তবে এসেছেন। কিন্তু ব্যাপকভাবে মুসলমানের বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসার সম্ভাবনা কম, কারণ ভারতের অর্থনীতির এমন কোনও উজ্জ্বল অবস্থা নয় যে দলে দলে জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসবে।
এসআইআর-এ কাদের নাম বাদ পড়ার সম্ভাবনা
(১) মুসলমানের নাম বাদ দেওয়া হবে বলে বিজেপি প্রচার করছে, এটা আসলে বুমেরাং হতে পারে। উদাহরণ— আসাম। আসামে এনআরসি করে ১৯ লক্ষ ধরা পড়ল যারা কাগজ দেখাতে পারলো না, তার মধ্যে মুসলমান ৫ লক্ষ (২৬ শতাংশ)। আসামের জনগণের মধ্যে মুসলমানের শতাংশ এর তুলনায় বেশি (৩৪ শতাংশ)।
(২) আসলে গরিব মানুষ (হিন্দু, মুসলমান উভয়েই), তফসিলি জাতি, আদিবাসী, যারা ঠিকমতো কাগজ গুছিয়ে রাখতে পারে না, তারাই পারবে না পুরানো কাগজ দেখাতে। তাঁদের নামই বাদ যাবে। বিহারে এসআইআর-এ ঠিকমতো কাগজ দেখাতে পারেনি বলে ৬৫ লক্ষ লোকের নাম বাদ গেছে। এদের মধ্যে কতজন অনুপ্রবেশকারী? নির্বাচন কমিশন বা সরকার বলেনি।
বিজেপি’র আসল উদ্দেশ্য
এটা বিজেপি জানে যে দলে দলে মুসলমানরা বাংলাদেশ থেকে এদেশে ঢুকে পড়েছে, সেটা সত্য নয়। কিন্তু অনেক হিন্দু ঢুকেছে, এটা সত্যি। কিন্তু বিজেপি মুখে শুধু মুসলমানদের বিরুদ্ধে বলবে। আসামের এনআরসি’র মতো পশ্চিমবঙ্গের এসআইআর-এ যদি আসলে হিন্দুদের নাম বেশি বাদ পড়ে যায়, তাতেও বিজেপি’র কিছু যায় আসে না। বিজেপি’র আসল উদ্দেশ্য– এক তীব্র ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করা। হিন্দু-মুসলিম যত বিভাজন হবে, তত বিজেপি’র লাভ। তৃণমূলেরও তাতে লাভ। ওরা দু’জনেই হিন্দু ও মুসলমানের এক পারস্পরিক ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে চায়। এত দুর্নীতি, এত বেকারি, এই সব ভুলে গিয়ে মানুষ হিন্দু-মুসলমানে মাতুক, তাতেই এই দুই দলের সুবিধা।
Comments :0