খণ্ডজ্ঞান ও অসম্পূর্ণ জ্ঞানকে পূর্ণজ্ঞান মনে করে যদি কেউ সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে নিজের মতামতকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করেন তাহলে যে অনর্থক কুনাট্যের অবতারণা হয় বন্দে মাতরম গানকে কেন্দ্র করে তেমনটাই ঘটছে। আর তাতে সোৎসাহে অংশ নিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীও। সত্যিই নির্বাচন বিষম দায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ঘনিষ্ট বৃত্তের সঙ্ঘ-বিজেপি নেতারা হঠাৎ করেই যে অতিমাত্রায় বঙ্কিম প্রিয় হয়ে উঠেছেন। বঙ্কিম রচিত বন্দেমাতরম সঙ্গীতটি কেন জাতীয় সঙ্গীত হলো না, কেন সঙ্গীতটির শেষের কিছু অংশ গীত হয় না ইত্যাদি না প্রশ্ন তুলে নেহরুকে কাঠগড়ায় তুলে রাজনীতির নতুন এক বিভাজনমুখী ইস্যু তাজা করতে চাইছেন। সেই সুযোগে বঙ্কিম প্রেমের বাহুল্যে বাংলার মানুষের আবেগ একটু উসকে দিয়ে সামনের বিধানসভা ভোটে বাড়তি সুবিধার ছক কষছেন।
এতসব চুলচেরা হিসাব কষে কেন্দ্রীয় সরকার বন্দে মাতরম গান রচনার ১৫০ বছর উদ্যাপনের আয়োজন করেছে এবং নরেন্দ্র মোদী সেখানে হাজির হয়ে যথারীতি কংগ্রেস ও নেহরুকে গাল পেড়ে আত্মতৃপ্তি বোধ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন বন্দে মাতরম গানের যে অংশটি গাওয়া হয়না সেটাই নাকি গানের প্রাণসত্তা এবং ভারতাত্মার বন্দনার মূলকথা। সেটা বাদ দিয়েই নাকি কংগ্রেস ভারত বিভাজনের বীজ বপন করেছে। এরজন্য তিনি নেহরুকেই দায়ী করেন। এটাও বলা হচ্ছে মুসলিমদের খুশি করতেই নাকি বঙ্কিমকে অপমান করা হয়েছে। তেমনি নাকি বঙ্কিমকে ছোট করে রবীন্দ্রনাথকে মহান করা হয়েছে। সেজন্যই বন্দেমাতরম জাতীয় সঙ্গীত না হয়ে জনগণমন জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে।
কথায় আছে ‘রতনে রতন চেনে’। মোদীরাও তেমনি বন্দে মাতরম গানের বাকি অংশটাই চিনেছেন, প্রথম অংশটা চেনেননি বা বোঝেননি। তাঁরা যেটা চিনতে ও বুঝতে চান সেটা জনগণমন-য় সেটা নেই তাই তারা জনগনমন-র বিরোধী। বন্দে মাতরম বিতর্ক তুলে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও বিভাজনের বিষ ঢালতে চায় তারা। এতে অবশ্য নতুনত্ব কিছু নেই। আরএসএস’র মতাদর্শের বিপরীত মেরুতে বিশ্বকবির অবস্থান। তাই তিনি সঙ্ঘের চোখের বিষ। উদারতা, বিশ্বমানবতা, জাতির সীমা ছাড়িয়ে মহাজাতিকে স্পর্শ করা, ধর্ম-বর্ণ-জাতের উর্ধ্বে মনুষ্যত্বকে যিনি সবার উপরে স্থান দেন তিনি সঙ্ঘের শত্রুর পক্ষ হয়ে উঠবেন তাতে সন্দেহ কি। সঙ্ঘ মতাদর্শে জারিতরা সেই কারণেই তাদের শাসিত রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় পাঠ্যসূচি থেকে রবীন্দ্রনাথকে সরাতে তৎপর। রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার অপরাধে আসামে ডাবল ইঞ্জিনের সরকার এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতাকে দেশদ্রোহী হিসাবে এফআইআর করেছে। মোদী কিন্তু এর বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। নীরবে সমর্থন করেছেন।
বন্দেমাতরম গানের একাংশ কেন গাওয়া হয় না বা কেন জাতীয় সঙ্গীত না সেটা শখের লোকজন জানেনা এমন নয়। তথাপি কথায় বলে না স্বভাব যায় না মলে। তথ্য বিকৃতি, ইতিহাস বিকৃতি, ইতিহাসের অপব্যাখ্যা আরএসএস’র বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতারা চাননি দেশের মুক্তির সংগ্রামে ধর্মীয় কোনও ভেদাভেদ থাকুক বা কারো ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত লাগুক। তাই বন্দেমাতরমের সেই অংশটিই গাওয়া হতোনা যেটা হিন্দু ধর্মের আবহ ও পৌত্তলিকার বিষয় আছে। জাতীয় নেতারা চেয়েছেন তেমন গান যা ধর্মমত নির্বিশেষে সকলকেই দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু মোদীদের কুয়োয় হিন্দু ব্যাঙ ছাড়া আর কেউ নেই। তাই তারা ধর্মনিরপেক্ষতা সহ্য করতে পারে না। হিন্দুত্ব ছাড়া আর ভাবতেও পারে না।
Editorial
বন্দে বিভাজনম
×
Comments :0