amal majumder

স্বপ্নের ফেরিওয়ালা অমল, ক্রিকেট তাঁকে ভোলেনি

খেলা

সুমিত গাঙ্গুলি

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮। মুম্বাই (তৎকালীন বোম্বাই) সাসানিয়ান ক্রিকেট ক্লাবের মাঠে হ্যারিস শিল্ডের খেলা। সারদাশ্রম স্কুলের অধিনায়ক শচীন তেন্ডুলকার টসে জিতে ব্যাটিং নিলেন সেন্ট জেভিয়ার্সের বিপক্ষে। তখনও কেউ জানে না, আগামী তিনদিন ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে চলেছে। সারদাশ্রমের কোচ রমাকান্ত আচরেকার। ১৯৬৩-৬৪ মরশুমে তিনি মইন-উদ্-দৌলা ট্রফিতে স্টেট ব্যাঙ্কের হয়ে খেলেছিলেন। স্টেট ব্যাঙ্কেরই হেড ক্লার্ক, শিবাজী পার্কে খেলা শেখান। তাঁর হাত থেকে বেরিয়েছে লালচাঁদ রাজপুত, বলবিন্দর সিং সান্ধুর মতো ক্রিকেটার। সান্ধু ১৯৮৩ সালের বিশ্বজয়ী দলের সদস্য।
যাই হোক, সারদাশ্রমের হয়ে ব্যাট করতে নামলেন অতুন রানাডে (মুম্বাই ও গোয়ার হয়ে পরে রঞ্জি খেলেন) ও রুপক মিলেট। রুপক আউট হতে নামলেন বিনোদ কাম্বলি। রানাডে আউট হতে ক্রিজে এলেন শচীন। তখন লাঞ্চও হয়নি। দলের রান ২ উইকেটে ৮৪। পাঁচ নম্বরে নামতে হতে পারে বলে প্যাড পরে বসলেন অমল মজুমদার। বসেই রইলেন। আর নামা হলো না। আচরেকারের ধমকে যখন সারদাশ্রম অধিনায়ক শচীন ইনিংসের ঘোষণা করলেন তখন দলের রান ২ উইকেটে ৭৪৮। যে কোনও ফরম্যাটে তখনও সর্বাধিক রানের জুটি গড়লেন কাম্বলি (অপরাজিত ৩৪৯) ও শচীন (অপরাজিত ৩২৬)। সেই ৬৬৪ রানের জুটি প্যাড পরে বসে বসে দেখলেন অমল। এই ঘটনা যেন তাঁর গোটা কেরিয়ারের ভবিষ্যতের প্রতীক হয়ে রইল। জাতীয় দলের দরজায় তিনি কড়া নেড়েই গেলেন। দরজা আর খুললো না কোনোদিন।
২ নভেম্বর, ২০২৫। তখন অবশ্য ৩ নভেম্বর হয়ে গিয়েছে। নবি মুম্বাইয়ের ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে নাদিন ডে ক্লার্কের তোলা ক্যাচটা ধরেই দৌড় শুরু করলেন হরমনপ্রীত কাউর। ভারতীয় অধিনায়কের সঙ্গে দৌড়লো গোটা দল। ব্যাট হাতে টানা রান করা স্মৃতি মান্ধানা, জেমাইমা রডরিগেজ, রিচা ঘোষ, প্রতীকা রাওয়ালের চোটের জন্য দলে সুযোগ পেয়েই ফাইনালে ব্যাট হাতে ৮৭ আর বল হাতে ২ উইকেট নেওয়া শেফালি ভার্মা সবাই। ফাইনালে ৫৮ রান করে আর ৫ উইকেট নিয়ে দীপ্তি শর্মা তখন আনন্দে মাতোয়ারা। ভারত মহিলা বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ৪৭ বছরের স্বপ্ন সফল। অদম্য জেদ, হার না মানা মানসিকতা, লড়াই সবকিছু ছিল এই দলটার। আর তার ভিত গড়েছিলেন অমল মজুমদার। জয়ের পর হরমনপ্রীত তাঁর পায়ে নমস্কার করলেন। গোটা দলকে একসূত্রে বেঁধেছিলেন অমল। অথচ তিনি জাতীয় দলে খেলেননি।
জুনিয়র ক্রিকেটে প্রচুর রান করেছেন অমল। অনূর্ধ্ব-১৫ বিজয় মার্চেন্ট, অনূর্ধ্ব-১৯ কোচবিহার ট্রফির খেলায় রানের বন্যা  ছুটিয়েছেন। বিজয় মার্চেন্টে তিনি ট্রিপল সেঞ্চুরিও করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ভবিষ্যতের ‘শচীন’ বলে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯২ সালে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দল একটি চতুর্দলীয় প্রতিযোগিতা খেলতে ইংল্যান্ডে যায়। অমল ছিলেন সহ অধিনায়ক। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে টাই হয়। সেই দলের গগন খোদা ভারতের হয়ে খেলেছিলেন পরে। দক্ষিণ আফ্রিকার হার্শেল গিবস আর ডেল বেঙ্কেনস্টাইন পরে বিখ্যাত হন। ভারতের পঙ্কজ ধার্মানি, শ্রীধরণ শ্রীরাম পরে জাতীয় দলে খেলেন।
১৯৯৪ সালের ১২ ফ্রেব্রুয়ারি। ফরিদাবাদের নাহার সিং স্টেডিয়ামে অমলের অভিষেক হয় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। ৪৭ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর তিনি ও যতীন পরাঞ্জপে জুটি বাঁধেন। হরিয়ানার বোলিংকে ছিন্ন করে দেন দুই ব্যাটার। যতীন ১১৬ করে ফিরে যাওয়ার পর নামেন অধিনায়ক রবি শাস্ত্রী। অমল তখনও খেলে যাচ্ছেন। অভিষেকেই শতরান করেন তিনি। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ব্যাট করে পৌঁছান শতরানে। এরপর শাস্ত্রীও শতরান করেন। তিনি ১১৮ করে ফেরেন। অমল আউট হচ্ছেন না। সমীর দীঘে (তিনিও শতরান করেছিলেন) ও অমল প্রায় ২০০ রান যোগ করেন। শেষ পর্যন্ত অমল সাড়ে দশ ঘণ্টা ব্যাট করে ফেরেন ২৬০ রান করে। অভিষেক ম্যাচে এটা তখন বিশ্বরেকর্ড ছিল। সেদিন ভিক্টোরিয়ার স্যামুয়েল লকস্টনের অপরাজিত ২৩২ আর কর্নাটকের গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের ২৩০ রানের রেকর্ড ভেঙেছিলেন অমল। ৩১টি চার মারলেও, একটিও ছয় মারেননি। বোম্বে (মুম্বাই) ৭১৮ রান তুলেছিল। তাঁর রেকর্ড ভাঙতে সময় লেগেছিল ২৪ বছর। অজয় রোহেরা ২০১৮ সালে মধ্য প্রদেশের হয়ে ২৬৭ করেন অভিষেক ম্যাচে হায়দরাবাদের বিপক্ষে।

অমলের ব্যাটে ঝড় বইতে শুরু করে এরপর। সেবারে রঞ্জিতে তিনি মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলে ৪৯৪ রান করেছিলেন। এরপর প্রতিবছরেই শতরান ও দ্বিশতরান করতেন তিনি। হয় রঞ্জিতে না হলো দলীপ ট্রফির খেলায়। যদিও জাতীয় দলের দরজা খুলল না। ছ’বার রঞ্জি জিতেছেন তিনি মুম্বাইয়ের হয়ে। ইরানী ট্রফি খেলেছেন অজস্র বার, মুম্বাইয়ের একাধিক বিদেশি দলের বিপক্ষে খেলেছেন। বোর্ড সভপতি দলের হয়ে আর ভারত ‘এ’ দলের হয়ে বিদেশি দলের বিপক্ষে খেলেছেন। বেসরকারি টেস্ট আর একদিনের ম্যাচ খেলেছেন। কিন্তু সরকারি টেস্ট দলে খেলেননি।
২০০৯ সালের রঞ্জি সেমিফাইনালে তিনি মুম্বাইয়ের হয়ে খেলেন তিনি। ফাইনালে বাদ পড়েন। মুম্বাই চ্যাম্পিয়ন হয়। অমল বুঝলেন মুম্বাই দলে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তিনি পরের মরশুমে যোগ দিলেন আসামে। তাঁর নেতৃত্বে আসাম প্লেট গ্রুপ থেকে উঠে এল এলিট গ্রুপে। রেলের বিপক্ষে ৭৯, গুজরাটের বিপক্ষে ৯০ করেন।
অমল ২০১২ সালে চলে যান অন্ধ্র প্রদেশে। হিমাচলের বিপক্ষে দু’ইনিংসেই শতরান, ঝাড়খণ্ডের বিপক্ষে ১৮০, একাধিক শতরান করেন তিনি। সেবার রঞ্জিতে তাঁর সংগ্রহ ৮৬৮, ষষ্ঠ সর্বাধিক। পরের মরশুমে অবসর নেন। বলেছিলেন, তরুণদের সুযোগ দেওয়ার জন্য তিনি আর খেলবেন না। তখনও মরশুমের তিন ম্যাচ বাকি।
কেরিয়ারে মোট ৪৮.১৩ গড়ে ১১, ১৬৭ রান, ৩০টি শতরান ও ৬০টি অর্ধশতরান সহ। মনে রাখতে হবে, ভারতীয় ক্রিকেটাররা বছরে খুব বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ পান না। অমল যদি ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার হতেন, তাহলে ২৫০০০ রান আর ৭০টার বেশি শতরান থাকত তাঁর।
একদিনের খেলাতেও তিনটি শতরান সহ ৩২৮৬ রান করেন ৩৮.২০ গড়ে। ভারতীয় ঘরোয়া ক্রিকেটের হিসাবে মূলত ’৯০ দশকের ক্রিকেটার হিসাবে সংখ্যাটা বেশি নয়। তখন ‘এ’ দলও বেশি ম্যাচ খেলতো না। তাহলে হয়ত জাতীয় দলের দরজাটা খুলে যেত অমলের।
অমলের সময়ে ভারতীয় দলে মিডল অর্ডারে নামতেন শচীন তেন্ডুলকর, ‌মহম্মদ আজহারউদ্দিন, বিনোদ কাম্বলি, সঞ্জয় মঞ্জেরেকার। পরে রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি, ভিভিএস লক্ষ্মণরা। ওপেনে ছিলেন প্রথমে মনোজ প্রভাকর ও সিধু, কখনও অজয় জাদেজা। তারপর নয়ন মোঙ্গিয়া, লক্ষ্মণ। দেখে নেওয়া  হয় সদাগোপন রমেশ, দীপ দাশগুপ্ত, দেবাং গান্ধী, শিবসুন্দর দাস। এরপর বীরেন্দ্র সহবাগ চলে আসেন। অমল টেস্ট খেলেননি। সুযোগই পাননি। মনে হয়না নির্বাচকরা আদৌ তাঁর কথা ভেবেছিলেন।
অমল এরপর কোচিং শুরু করেন। তাঁকে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ব্যাটিং কোচ করা হয়। ২০১৩ সালে তাঁর দায়িত্ব পড়ে নেদারল্যান্ডের ব্যাটিং সামলানোর। এরপরেই তিনি ২০১৮ সালে রাজস্থান রয়্যালসের ব্যাটিং কোচ হন। দক্ষিণ আফ্রিকা দল ভারত সফরে এলে তাঁকে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি মুম্বাই দলেরও কোচ হন। শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালে তিনি ভারতের মহিলা দলের প্রধান কোচ হন।
বিশ্বকাপের প্রথম থেকেই অমল বলেছিলেন ‘মাঝের ওভারগুলোয় ভালো ব্যাট করতে হবে।’ সেই মতো ভারতীয় দল প্রথম ম্যাচ থেকেই এই লক্ষ্যে খেলতে শুরু করে। মিডল অর্ডার ব্যর্থ হলে লোয়ার মিডল অর্ডার ঠিক লড়াইয়ের মতো রান করে দিয়েছে। এমনকি অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে ওপেনিং জুটি বেশি রান করলেও পঞ্চম উইকেটে ৫৪ রান ওঠে। ইংল্যান্ড ম্যাচেও আসল লড়াই মিডল অর্ডার লড়েছিল। নিউজিল্যান্ড ম্যাচে মিডল অর্ডার খুব একটা সুযোগ না পেলেও টপ অর্ডার মাঝের ওভারে স্কোরবোর্ড সচল রাখে। সেমিফাইনালে মাঝের ওভারের লড়াই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত, গত তিনটি বিশ্বকাপে ভারত ছাড়া আর কেউ অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারেনি। ফাইনালের কথা তো সবাই জানে। জেমাইমাকে তিন নম্বরে উঠিয়ে আনা। রিচাকে বারংবার স্লগ ওভারে ব্যাট করানো, সবটাই মুম্বাই ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কের কাজ। অমল দেখালেন টেস্ট না খেললেও ক্রিকেট মস্তিষ্কে তিনি কম যান না।  
শচীন তাঁকে ‘মুম্বাই ক্রিকেটের অচর্চিত নায়ক’ বলেছেন। রোহিত শর্মা বলেছেন ‘খেলায় তিনি সমস্ত হৃদয় দিয়েছেন।’ কিন্তু অমল সর্বদা প্রশংসা এড়িয়ে যান। জয়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বললেন, ‘আমি বাক্‌রুদ্ধ। ভীষণ গর্বিত। এই মুহূর্তের প্রতিটি অংশ ওদের (দলের ক্রিকেটারদের) প্রাপ্য। কঠোর পরিশ্রম, বিশ্বাসে ওরা প্রতিটি ভারতীয়কে গর্বিত করেছে।’ যদিও, অমল টেস্ট ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। মহিলা ক্রিকেটে ভারতের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত তৈরি করা মানুষ অমল কখনও ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেননি। তিনি কখনও নীল ক্যাপ পরেননি। কোনও ম্যাচের আগে কখনও জাতীয় সঙ্গীতের জন্য দাঁড়াননি। তবুও, মুম্বাইয়ের সেই রাতে, ভারতীয় পতাকা উড়েছিল। অমল প্রতিটি ক্রিকেটারের স্বপ্নকে ছুঁয়েছিলেন। তিনি বিশ্বজয়ী হলেন। আচরেকারের তৃতীয় বিশ্বজয়ী ছাত্র, সান্ধু ও শচীনের পর। যদিও ক্রিকেটার হিসাবে নয়। আচরেকারের ভূমিকায়— কোচ হিসাবে।

Comments :0

Login to leave a comment