Cash Transfer to Women

নারীদের নগদ হস্তান্তর প্রকল্প ট্রেড ইউনিয়ন দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা

উত্তর সম্পাদকীয়​

নিশীথ চৌধুরি
ভারত-জুড়ে গত এক দশকে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার নারী-কেন্দ্রিক নগদ হস্তান্তরভিত্তিক কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, মধ্য প্রদেশের লাড়লি বেহনা, মহারাষ্ট্রের মাজী লড়কি বহিন, কর্নাটকের গৃহ লক্ষ্মী, তামিলনাড়ুর মাগালির উরিমাই থোগাই, তেলেঙ্গানার মহালক্ষ্মী, ঝাড়খণ্ডের মাইয়া সম্মান, রাজস্থানের ইন্দিরা গান্ধী মাতৃত্ব পুষ্টি কর্মসূচি এবং অন্যান্য প্রকল্প এ সকলই এই স্বীকৃতিকে প্রতিফলিত করে যে নারীরা কাঠামোগত অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার এবং বিনা পারিশ্রমিকে গৃহস্থালি কাজের অধিকাংশ ভার তারা বহন করেন। রাজ্য সরকারগুলি ও কেন্দ্রীয় সরকারের মতে প্রত্যক্ষ নগদ সহায়তার লক্ষ্য হলো আর্থিক অনিশ্চয়তা হ্রাস করা, স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধি করা, খরচ-বিন্যাসের স্থিতি নিশ্চিত করা এবং নারীদের স্বাধীন অর্থনৈতিক সত্তা হিসাবে প্রতীকী স্বীকৃতি প্রদান করা। কিন্তু এগুলি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠলেও স্থায়িত্ব, অধিকারভিত্তিক কল্যাণব্যবস্থা এবং ‘ক্ষমতায়ন’ ধারণার প্রকৃত অর্থ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কও উত্থাপিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে বিভিন্ন রাজ্য ও জাতীয় প্রকল্পের একটি সংহত মূল্যায়ন, আন্তর্জাতিক সমতুল্য মডেলের পর্যালোচনা এবং শ্রম-সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ভারতের রাজ্যভিত্তিক প্রকল্পসমূহ
এই মুহুর্তে দেশজুড়ে বিভিন্ন রাজ্যে নারী-কেন্দ্রিক নগদ হস্তান্তরের যে সমস্ত প্রকল্পগুলি চলছে তার একটা তুলনামূলক সারণি পরিশিষ্টতে যুক্ত করা হলো। এই সারণিতে যে সব তথ্য একত্রিত করা হয়েছে সেগুলি হলো রাজ্যের নাম, প্রকল্পের নাম, প্রকল্প চালুর বছর, যোগ্যতার মানদণ্ড, প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ, সর্বশেষ অন্তর্ভুক্ত মহিলার সংখ্যা, বাৎসরিক ব্যয় এবং অর্থের উৎস। (পরিশিষ্ট প্রবন্ধের শেষে)
নারীদের জন্য জাতীয় প্রকল্প সমূহ
জাতীয় স্তরে, ভারত সরকার এমন কয়েকটি প্রকল্প পরিচালনা করে যা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা লাড়লি বেহনার মতো নিঃশর্ত মাসিক নগদ ভাতা না হলেও নারীদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার একটি মূল ভিত্তি তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও (শিক্ষা ও লিঙ্গ অনুপাত সংশোধন), মহিলা শক্তি কেন্দ্র (গ্রামীণ ক্ষমতায়ন), প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা পরিকল্পনা (মাতৃত্বকালীন নগদ সহায়তা), জননী সুরক্ষা যোজনা (প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব), ওয়ান-স্টপ সেন্টার (লিঙ্গভিত্তিক হিংস্রতার শিকার নারীদের সহায়তা), উজ্জ্বলা (মানব পাচারের শিকার মহিলাদের পুনর্বাসন), ওয়ার্কিং উইমেন হস্টেল, এবং সম্প্রতি প্রচারিত লাখপতি দিদি উদ্যোগ— যার লক্ষ্য এনআরএলএম’র অধীনে ৩ কোটি গ্রামীণ নারীকে বছরে ১ লক্ষ টাকার আয়ের জন্য সক্ষম করে তোলা।
এ কথা ঠিকই যে সমষ্টিগতভাবে দেখা গেলে, জাতীয় প্রকল্পসমূহ একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে, যার উপর রাজ্য স্তরের প্রকল্পগুলি আরও কিছু প্রকল্প গঠন করতে পারে— বিশেষ করে যেসব রাজ্যে শক্তিশালী কল্যাণ কাঠামো বিদ্যমান।
তুলনামূলক আলোচনা 
বিশ্বব্যাপী বহু দেশ নারী-কেন্দ্রিক বা লিঙ্গ-সংবেদনশীল নগদ হস্তান্তর ও আয়-সমর্থনমূলক ব্যবস্থার ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চালু ‘ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট’ (ভিজিডি) কর্মসূচি এবং মাতৃকালীন ভাতা প্রকল্প— দারিদ্রপীড়িত লক্ষ লক্ষ নারীর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা-বলয় তৈরি করেছে। নেপাল বিধবা, অবিবাহিত ও বয়স্ক নারীদের মাসিক সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা প্রদান করে, যা লিঙ্গভিত্তিক দুর্বলতাকে স্বীকৃতি দেয়। শ্রীলঙ্কার ‘এমপাওয়ারিং উইমেন প্রজেক্ট’ এবং পুষ্টিনির্ভর সহায়তা কর্মসূচিগুলি নারীদের স্বাস্থ্য ও স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিচালিত।
সুইডেনে, যা বিশ্বের অন্যতম উন্নত সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোর দেশ, বিস্তৃত পিতামাতার ভাতা এবং সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত শিশু যত্ন পরিষেবা নারীদের বিনা-পারিশ্রমিক গৃহকর্মের বোঝা উল্লেখযোগ্যভাবে কমায় এবং শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়ায়। কানাডার চাইল্ড বেনিফিট প্রকল্প সর্বজনীন হলেও তা নিম্ন-আয়ের মায়েদের ওপর বিশেষভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনেও অনুরূপভাবে মাতৃত্বকালীন অনুদান, শিশু যত্ন ভরতুকি এবং লিঙ্গসমতা-কেন্দ্রিক উদ্যোগ প্রদান করে।
এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাগুলি দেখায় যে সরাসরি নগদ সহায়তা দারিদ্র কমাতে অবশ্যই সহায়ক, কিন্তু এটাতো কোনোমতেই অস্বীকার করা যাবে না যে টেকসই ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন নগদ ভাতার পাশাপাশি শ্রম অধিকার, সরকারি শিশু যত্ন ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা এবং শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা – এগুলো সবকটাই একসঙ্গে কাজ করে।
নগদ ভাতার যুক্তি
সরকারের সাথে সাথে এই প্রকল্পগুলির সমর্থকেরা বলেন যে প্রত্যক্ষ নগদ সহায়তা নারীদের জন্য বেশি নমনীয়তা, মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করে— কারণ এতে তারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারেন। তাদের যুক্তি, নারীরা বিনা-পারিশ্রমিকে যে বিপুল পরিমাণ গৃহস্থালি শ্রম করেন, যা অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখলেও স্বীকৃতিহীন রয়ে যায়, নগদ ভাতার মাধ্যমে সেই শ্রমকে অন্তত প্রতীকীভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সমর্থকেরা আরও বলেন, নিয়মিত আয়ের সমর্থিত নারীদের পুরুষ উপার্জনকারীর উপর নির্ভরশীলতা কমায়, পারিবারিক পুষ্টি উন্নত করে, জরুরি পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা বাড়ায় এবং পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে। অর্থনীতিবিদেরা উল্লেখ করেন যে নগদ ভাতা প্রদান পদ্ধতিতে সরকারি ব্যয় ও প্রশাসনিক খরচ তুলনামূলকভাবে কম হয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থকেরা মনে করেন যে এই প্রকল্পগুলি কল্যাণ ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করে— কারণ এতে আমলাতান্ত্রিক বিবেচনার ওপর নির্ভরশীলতা কমে, এবং অধিকারের ভিত্তিতে সুবিধা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বিরোধী পক্ষ ও অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা ও উদ্বেগ
বিরোধীদের মতে, নগদ ভাতা প্রকল্পগুলি কাঠামোগত সমস্যার সমাধান না করে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকি রাখে, ফলে ভোট নির্ভরতা সৃষ্টি হয়, আর জনসেবা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অবকাঠামো উন্নয়নের মতো মৌলিক ক্ষেত্রগুলি উপেক্ষিত থাকে। কিছু অর্থনীতিবিদ সতর্ক করেন যে নিঃশর্ত নগদ ভাতা গভীরতর লিঙ্গ বৈষম্য যেমন নারীদের কম শ্রম-অংশগ্রহণ, মজুরি বৈষম্য, নিরাপদ কর্ম পরিবেশের অভাব ইত্যাদি সমস্যার সমাধান করতে পারে না।
আরও একটি আশঙ্কা হলো, যেসব রাজ্যের বাজেট সীমিত, তারা বড় আকারের নগদ প্রকল্প চালাতে গিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি বা কর্মসংস্থান সুনিশ্চিতকারী প্রকল্পগুলির ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়। মহিলাদের সম্বন্ধে মনুবাদীদের দৃষ্টভঙ্গি কী এবং সে সমস্ত ধারণার কট্টর সমর্থক বিজেপি-কে যে আরএসএস’র নির্দেশ মেনেই চলতে হবে, তা আমরা জানি। আমাদের মতো অনেকেই তাই আরও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই প্রকল্পগুলি নারীদের গৃহবন্দি থাকার পর্যায়কে স্থায়ী করে দিতে পারে, বিশেষত যেখানে শ্রমবাজার দুর্বল। কারণ অল্প মাসিক ভাতা কোনোভাবেই স্থায়ী ও মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থানের বিকল্প হতে পারে না।
অধিকার বনাম কল্যাণ
আমরা ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ এই নগদ ভাতা প্রকল্পগুলির সুবিধাভোগী সেই বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত শ্রমজীবী মহিলা কর্মী, যাদের নিয়মিত মজুরি বা সামাজিক সুরক্ষা নেই তাদের জন্য তাৎক্ষণিক এই সহায়তা স্বাগত জানালেও আমাদের যুক্তি হলো, নগদ সহায়তা কখনোই মজুরি অধিকার, সুরক্ষিত কর্মসংস্থান, মাতৃত্বকালীন সুবিধা, ক্রেশ, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই কভারেজ, ন্যূনতম মজুরি আইন বা সমান মজুরি আইনের বাস্তবায়নের বিকল্প হতে পারে না।
আমরা সতর্ক করে দিতে চাই যে, অনেক সময় সরকার এই ধরনের কল্যাণমূলক প্রকল্পকে ব্যবহার করে শ্রমিকবিরোধী শ্রম সংস্কারের প্রতি মনোযোগ সরিয়ে নিতে বিশেষ করে সেই শ্রম কোডগুলির বাস্তবায়নের মাধ্যমে, যা শ্রমিকদের সুরক্ষা দুর্বল করে। সিআইটিইউ’র এই প্রসঙ্গে অভিমত খুবই স্পষ্ট। প্রকৃত ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব যখন যৌথ দরকষাকষির ক্ষেত্রে শ্রমজীবীদের ক্ষমতা বাড়ে এবং আরও শক্তিশালী হয়, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ হয়, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত হয় এবং সরকারি জনসেবার সম্প্রসারণ ঘটে। ভাতা দেওয়ার আমরা বিরোধী নই, কিন্তু উপরিউক্ত প্রশ্নগুলিতে নারীদের ক্ষমতায়ন না করে, শুধু নগদ ভাতা প্রদান করলে নারীদের  প্রকৃত এবং সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন হয় না। তাই আমাদের স্পষ্ট অবস্থান হলো— নগদ সহায়তা অবশ্যই স্বাগত, কিন্তু এটি কোনোভাবেই অধিকারের বিকল্প নয়।
নারী-কেন্দ্রিক নগদ ভাতা প্রকল্পগুলি ভারতে দ্রুত বিস্তৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে পূর্বে প্রান্তিক অবস্থায় থাকা লক্ষ লক্ষ নারী সরাসরি রাষ্ট্রীয় সহায়তার আওতায় এসেছেন। এই প্রকল্পগুলি তাৎক্ষণিক আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করে, নারীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সহায়তা করে এবং গৃহস্থালি ও সামাজিক শ্রমে তাদের অবদানকে প্রতীকী স্বীকৃতি দেয়। তবে এগুলি সর্বাধিক কার্যকর হবে তখনই, যখন শক্তিশালী শ্রম-সুরক্ষা, সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিশু যত্ন পরিষেবা এবং লিঙ্গ বৈষম্য রোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনার সঙ্গে সমন্বিত থাকে।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা দেখায় যে কেবল নগদ ভাতা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায়নের জন্য যথেষ্ট নয় যতক্ষণ না তা কাঠামোগত সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত হয়। ভারত এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে: চ্যালেঞ্জ হলো, এই প্রকল্পগুলোকে যেন কেবল নির্বাচনী কল্যাণমূলক ব্যবস্থায় সীমিত না রাখা হয়, বরং এগুলোকে এমন এক সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অংশে রূপান্তরিত করা, যা নারীর মর্যাদা, অধিকার এবং প্রকৃত অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম।
 

Comments :0

Login to leave a comment