পরেশ হাঁসদা
আমাদের দেশের গরীব ও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষরা বহুমুখী আক্রমনের সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁদের অধিকার, ভাষা ও সংস্কৃতি বিভিন্নভাবে খর্ব হচ্ছে। বিগত একদশক ধরে সংবিধানে যতটুকু তাঁদের সুযোগ রয়েছে তা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আদিবাসীদের সামনে রেখেই আদিবাসীদের অধিকার হরণ করার অভিসন্ধির প্রতিফলন ঘটছে। ভাষা হল সংস্কৃতির ধারক-বাহক। বর্তমানে বিজেপি বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে 'এক দেশ, এক ধর্ম, একভাষা'- এই শ্লোগানকে জন মানসে হাজির করেছে, যা সংবিধান বিরোধী এবং সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দীর্ঘ আন্দোলনের ফসলের উপর আঘাত। পাশাপাশি আমাদের রাজ্যের টি.এম.সি সরকার সাঁওতালি ভাষা, শিক্ষা ও সাহিত্যকে খর্ব করছে। সাঁওতাল সম্প্রদায় তথা আদিবাসীদের প্রকৃত উন্নয়নের পরিপন্থী অবস্থান নিয়েছে এই সরকার। এই প্রেক্ষাপটে সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতি দিবসকে সামনে রেখে সাঁওতালী ভাষা আন্দোলনের কতকগুলি ঘটনার কথা আলোকপাত করা হল।
এটা সত্য যে সাঁওতালী ভাষা আন্দোলনকে হাতিয়ার করে শেষ পর্যন্ত বামপন্থীদের হাত ধরেই সাঁওতালী ভাষা সংবিধানে অষ্টম তফশীলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কেউ কেউ এই সত্য ঘটনাকে অস্বীকার করে থাকে। আশা করি এই লেখা বিভ্রান্তি কাটাতে সহায়ক হবে। সাঁওতালী ভাষা আন্দোলন তিন ধারায় সংগঠিত হয়েছে প্রথমতঃ শিক্ষা ও সাহিত্য বিষয়ক কার্য্যধারা, দ্বিতীয়তঃ গণ বিক্ষোভ আন্দোলন এবং তৃতীয়তঃ রাজনৈতিক ও সংসদীয় আন্দোলন।
ভাষাতাত্ত্বিকদের বিচারে অস্ট্রো-এশিয়াটিক শাখার প্রধান চারটি ভাষাগোষ্ঠী হল নিকোবরী, খাসিয়া, মনখমের এবং মুণ্ডারী। মুণ্ডারী গোষ্ঠীর ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম হল সাঁওতালী। ভারতবর্ষে আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে সাঁওতাল জনসংখ্যাই বেশি। জনসংখ্যার নিরিখে ভারতবর্ষে সাঁওতালী ভাষা ত্রয়োদশতম। এই দেশের বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যে কোথাও বিশাল অঞ্চল জুড়ে, আবার কোথাও বা বিচ্ছিন্নভাবে সাঁওতালদের বাসভূমি। সাঁওতালী একটি প্রাচীনতম ভাষা। সাঁওতালী ভাষার মধ্যে জীবনীশক্তি ও বৈচিত্র্য রয়েছে। এই ভাষার প্রতি প্রথম আকৃষ্ট হন খ্রীষ্টান মিশনারীগণ। তাঁদের সহযোগিতায় ইহা অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসে। তথাকথিত ভদ্র, শিক্ষিত লোক সাঁওতালদেরকে ঘৃণা করতেন। তাই তাঁরা সাঁওতালী ভাষাকে 'ঠার' বলে ব্যঙ্গ করতেন। 'ঠার' অর্থে জন্তুজানোয়ার, পশুপক্ষীদের ভাষা। সাঁওতালরা বাংলাভাষীদের সামনে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ, লজ্জাবোধ এবং হীনমন্যতায় ভুগতেন। ভারতবর্ষে জাতীয় সংবিধান প্রবর্তনের পরবর্তী সময়ে ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে সহ চাকরী করতে আসা সাঁওতালীভাষী আদিবাসী মানুষ কোলকাতা শহরে সাঁওতালী গ্রন্থ ও পত্র পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকে। এ সময়ে বেসরকারী ভাবে দিল্লীতে "সারা ভারত সাঁওতালী ভাষা কমিটি" গঠন করা হয়। ষাটের দশকে ওড়িষ্যা ও বিহারে অলচিকি লিপিতে সাঁওতালী ভাষা চর্চার জোয়ার আছড়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতার বুকে "আবোয়াঃ গাঁওতা, সাঁওতালী লিটারেরী অ্যান্ড কালচারল সোসাইটি, আদিবাসী সোসিও এডুকেশনাল এ্যান্ড কালচারাল এসোসিয়েশন সংক্ষেপে আসেকা এই তিনটি সংস্থাই সাঁওতালী ভাষা চর্চা ও বিকাশে অগ্রণীভূমিকা পালন করে। আসেকার উদ্যোগে অলচিকি লিপির ব্যবহার সাঁওতালী ভাষা চর্চার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়। সেই সময় প্রায় ২৫০টি পত্র পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। কয়েকটি প্রকাশক কর্তৃক কতকগুলি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে সাঁওতালী সাহিত্যের সমভার সমৃদ্ধ হয়।
সরকারী উদ্যোগ: আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসাবে ১৯৬৫ সালে আগষ্ট মাসের প্রথম দিন থেকে আকাশবানী কোলকাতা 'খ' প্রচার তরঙ্গে অল্প সময় হলেও সাপ্তাহিক সাঁওতালী অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। এই বছরই "আদিবাসী ভাষা কমিটি গঠীত হয়। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন যুক্ত ফ্রন্টসরকারের পাঠ্যপুস্তক কমিটি সাঁওতালী ভাষায় পড়াশুনার জন্য সিলেবাস তৈরি করে। কিন্তু লিপি বির্তকের কারণে তা মুদ্রিত হয় নি। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সাঁওতালী ভাষা নিয়ে চিন্তাভাবনা ভারতবর্ষে প্রথম শুরু করে। এই সরকার প্রাইমারী স্তরের পুস্তক অলচিকি লিপিতে মুদ্রণের পাশাপাশি "হড়কোরেন মারে হাপড়াম কো রেয়া কাথা, শায় সেরমা রেয়াঃ অনড়ছে" ইত্যাদি পুস্তক মুদ্রিত করে। এছাড়া সাহিত্যিক স্মৃতি পুরস্কার প্রদান শুরু করে।
১৯৭৭ সালে সাঁওতালী ভাষা চর্চা ও বিকাশের পদক্ষেপ হিসাবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালী ভাষায় সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়। ১৯৭৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার সাঁওতালী ভাষা উপযোগী অলচিকি লিপিকে নীতিগত ভাবে স্বীকৃতি দেয়। এর পর সাঁওতাল সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, পরোক্ষে ভাষা আন্দোলন শক্তমাটি খুঁজে পায় এবং আন্দোলন জোরদার হয়। রাজ্য সরকার ১৯৮০ সালে প্রাইমারি স্তরের পাঠ্য পুস্তক অলচিকি লিপিতে মুদ্রিত করেন। ১৯৮১ সালে ডিসেম্বর মাস থেকে বেতার তরঙ্গে দৈনিক সাঁওতালী অনুষ্ঠান ছাড়াও আধ ঘন্টার নাটক প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। সাঁওতালী ভাষায় রাজ্যস্তরে নাটক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ফলতঃ নাট্যকারদের মধ্যে সাঁওতালী নাটক রচনার আলোড়ন জাগে। এই বছরই অলচিকি লিপির স্রষ্টা পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমুকে পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার অন্তর্গত কেঁদবনা ময়দানে সাড়ম্বরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তাম্রপত্র দিয়ে সম্বর্ধনা দিয়ে ছিলেন। সরকারীভাবে অলচিকিতে শিক্ষক-শিক্ষণ শিবির বিভিন্ন জেলায় খোলা হয়। পরিভাষা কমিটি ও সিলেবাস কমিটি গঠনের পাশাপাশি পুস্তক মুদ্রণের কাজ চলে। তখনও সাঁওতালী ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতির কাজে লিপি বিতর্কের প্রভাব পড়ে। ২০০২ সালে শিক্ষক নিয়োগের সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গ পর্ষদ সাঁওতালী ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে গন্য করে এবং ৮০০ জন ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিকে এই সুবিধা গ্রহন করে। ২০০১ সালে রাজ্য সরকার পবিত্র সরকারকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে "সাঁওতালী ভাষায় শিক্ষা, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে অলচিকি হরফে সাঁওতালী মাধ্যমে শিক্ষাদান সহ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে অলচিকি ব্যবহার সাঁওতালী ভাষায় শিক্ষাদানের সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখার পর ২০০২ সালের মে মাসে ইতিবাচক রিপোর্ট সরকারের নিকট পেশ করেন। ২০০৬ সাল থেকে প্রাথমিক স্তরে সাঁওতালী মাধ্যমে পঠন পাঠনের কাজ শুরু হয় এবং সংশ্লিষ্ট ছাত্র-ছাত্রী ২০১১ সালে পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়।
গণবিক্ষোভ গনআন্দোলনের ধারাঃ যাটের দশকের গোড়া থেকেই সাঁওতালী ভাষা সংবিধানে অষ্টম তফশিলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে ওড়িষ্যা বিহার ও বাংলায় আন্দোলন শুরু হয়। আসেকা ও অল ইন্ডিয়া সান্তালি রাইটার্স এসোসিয়েশন সাঁওতালী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথম দিকে ছোটো বড়ো সংস্থা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। সাঁওতালী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ভারতের যুব সংগঠন ডি.ওয়াই.এফ.আই সোচ্চার হয়ে উঠে। ১৯৮৬ সালে বাঁকুড়া জেলার রাইপুরে রাজ্য ভিত্তিক আদিবাসী যুব কনভেনশনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোত বসু সাঁওতালী ভাষার স্বীকৃতির জোর দেন। এরপর বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন শুরু হয় এবং তৎকালীন লোকসভার স্পীকারের কাছে তিন লাখের বেশি স্বাক্ষর সহ দাবিপত্র পেশ করা হয়। নব্বই দশকের শেষের দিকে সাঁওতালী ভাষা মোর্চা ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠন গুলি ঐ একই দাবিতে বাংলা, বিহার, ওড়িষ্যার বিভিন্ন জায়গায় ডেপুটেশন, বিক্ষোভ সমাবেশ, পথ অবরোধ, রেল অবরোধ জোরালো অন্দোলন করেন। এমনকি দিল্লিতে ধরনায় বসেন এবং প্রতিনিধিগণ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে স্মারকলিপি প্রদান করেন। সিপিআই(এম) রাজনৈতিক দলই সাঁওতালী ভাষাকে অষ্টম তফসিলে অর্ন্তভুক্ত করার দাবিকে ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনী ইশ্তাহারে অর্ন্তভুক্তির মাধ্যমে তা রাজনৈতিক দাবি রূপে মর্যাদা দেয়। সিপিআই (এম)’র ডাকে ২০০২ সালে রাঁচিতে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক আদিবাসী সমাবেশে সাঁওতালী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি সহ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মৌলিক দাবিগুলি উত্থাপিত হয়। এই দাবির সমর্থনে সিপিআই (এম) পার্টির উদ্যোগে পদযাত্রার শেষে হুড়ায় বিরাট সমাবেশ হয়। ২০০৩ সালে ২০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের আদিবাসী কল্যাণ বিভাগের আহূত সভায় রাজ্যের বিভাগীয় মন্ত্রী উপেন কিস্কু সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতির দাবিতে সোচ্চার হন।
রাজনৈতিক ও সংসদীয় আন্দোলন: ১৯৯২ সালে মণিপুরী, কোচনী এবং নেপালী এই তিনটি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভের সময় পার্লামেন্টে সিপিআই (এম) সাংসদ সোমনাথ চ্যাটার্জি, বাসুদেব আচারিয়া এবং রূপচাঁদ মুর্মু সকলই একযোগে সাঁওতালী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি নিয়ে সোচ্চার হন। কিন্তু তৎকালীন নরসিমা রাও নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার তাঁদের বক্তব্য এড়িয়ে যান। সাঁওতালী ভাষা স্বীকৃতির দাবিতে সাংসদ সালখান মুর্মু লোকসভা অধিবেশনে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার জোরালো বক্তব্য রাখেন। কিন্তু তাতে কোনও ফলপ্রসূ হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ও বামফ্রন্ট সরকারের সদিচ্ছায় ২০০০ সালের ১ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয় সাঁওতালী ভাষাকে সংবিধানে অষ্টম তফসিলে অর্ন্তভুক্ত করার সর্বদলীয় প্রস্তাব। এই প্রস্তাবটি সর্বদলীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব মন্ত্রী উপেন কিন্তু দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানির হাতে প্রদান করেন। তিনি হাইপাওয়ার কমিটি গঠনের আশ্বাস দেন। সাঁওতালী ভাষী মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসকে উপেক্ষা করে ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার লোকসভার বর্ষাকালীন অধিবেশনে বোড়ো ভাষাকেই অষ্টম তফসিলে অর্ন্তভুক্ত করার জন্য সংবিধানের ১০০ তম সংশোধনী বিল সংসদে পেশ করেন। বামপন্থী সাংসদেরা সাঁওতালী ভাষাকেও এই সংশোধনীতেই অর্ন্তভুক্ত করার দাবিতে সোচ্চার হন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার রাজি হননি, ফলে বামপন্থী সাংসদরাও এই বিল ঐ বর্ষাকালীন অধিবেশনে পাশ হতে দেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থানের প্রতিবাদে আদিবাসী সংগঠন আসেকা রানি রাসমণি রোডে বিক্ষোভ মিছিলে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমিতাভ লালার গাড়ি আটকে গেলে তিনি কলকাতায় কাজের দিনে কোনও মিটিং মিছিল না করা নজিরবিহীন রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন দেশের বেশির ভাগ মানুষ এবং জননেতা বিমান বসু এই রায়ের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার জন্য তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। মিটিং মিছিল বন্ধ করার স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা ও প্রতিবাদ চলতে থাকে।
কেন্দ্র সরকারের অধীনস্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্টে আর কোনও ভাষাকে অষ্টম তফসিলে অর্ন্তভুক্ত না করার যুক্তি দেখানো হয়। সাঁওতালী, মৈথিলী, ভোজপুরী ইত্যাদি ভাষাকে যুক্ত করলে হিন্দি ভাষার আধিপত্য খর্ব হবে। এগুলি হিন্দি ভাষার ছত্রাধীন ভাষা। যথারীতি লোকসভার শীতকালীন অধিবেশন ২০০৩ সালের ২ ডিসেম্বর শুরু হয়। জানা যায় যে সংবিধানের ১০০ তম সংশোধনীতে কেবল বোড়ো ভাষাকেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই পরিস্থিতিতে বামফ্রন্ট নেতৃত্বের পরামর্শে দক্ষ সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার আহ্বানে আসেকার ৪ জন নেতৃত্ব ২১ ডিসেম্বর দিল্লিতে পৌঁছান, কেননা ২২ ডিসেম্বরই প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান ও ২৩ ডিসেম্বর লোকসভা ভবনের সামনে বাম সাংসদরা আসেকা প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ধরনায় বসার দিন।
নির্ধারিত দিন ২২ ডিসেম্বর লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ১২টা ৪৫মিনিটে বৈঠকটি বসে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে সাংসদ ছাড়া কোনও প্রতিনিধিদের সাথে তিনি দেখা করবেন না। কিন্তু অভিজ্ঞ সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার নাছোড়বান্দা অবস্থানে চারজন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া, ডাঃ রাম চন্দ্র ডোম, রূপচাঁদ মুর্মু ও অলকেশ দাস এবং আসেকার দুই প্রতিনিধি সুবোধ হাঁসদা ও দুখিরাম হাঁসদা এই ছয় জন এক ঐতিহাসিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। সাঁওতালী ভাষাকে সংবিধানে ৮ম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবির পিছনে দক্ষ ও অভিজ্ঞ সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া, শিক্ষাবিদ সুবোধ হাঁসদা ও সাংসদ রূপচাঁদ মুর্মু এই তিন জনের অকাট্য যুক্তি উত্থাপনের পরপর তিনজনের প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন একটি বাক্যে "বহুত দের হো গয়া"। শেষে বাসুদেব আচারিয়া বলেন- "স্যার, আপনারা যাই করুন আমি ডিভিসন চেয়েছি, আজকেই ভোটাভুটিতে পরিষ্কার হয়ে যাক, কারা সাঁওতালী ভাষার পক্ষে আর কারা বিপক্ষে।" এই কথা বলে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর অফিস ত্যাগ করেন। পরের দিনের কর্মসূচি সংসদ ভবনের সামনে ধরনায় বসার আয়োজন সংক্রান্ত বিষয়ে আসেকার প্রতিনিধি এবং হান্নান মোল্লা সহ কয়েকজন সাংসদ মিলে সিপিআই (এম) সাংসদদের অফিসে আলোচনা চলছিল। তখন ঠিক ১টা ৫০ মিনিটে হান্নান মোল্লা টেলিফোনে খবর পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রায় লাফিয়ে উঠে প্রতিনিধিদের বললেন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সাংসদ সোমনাথ চ্যাটার্জিকে জানিয়েছেন যে কেন্দ্রীয় সরকার সাঁওতালী ভাষাকে অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মেনে নিয়েছে। সংসদে উপস্থিতি ৩৩৮ জন সাংসদ সংবিধানের ১০০ তম সংশোধনীতে বোড়ো ভাষা সহ আরও তিনটি ভাষা সাঁওতালী, মৈথলী, ডোগরি ভাষাকে অষ্টম তফসিলে অর্ন্তভুক্তিকরণের প্রস্তাব সমর্থন করেন। ২০০৩ সালের ২২ ডিসেম্বর এরূপ নাটকীয়ভাবে সাঁওতালী ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হয়। সিপিআই (এম)ই দেশের একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল যারা সাঁওতালী ভাষীদের দাবিকে রাজ্য বিধানসভা থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ আইনসভা সংসদ পর্যন্ত নিয়ে গেছে এবং রাজনৈতিকভাবে এই দাবি আদায়ের জন্য ধারাবাহিক লড়াই চালিয়ে গেছে।
Comments :0