শমীক লাহিড়ী
১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার শান্ত প্রদীপ যখন জ্বলে ওঠার কথা, তখন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি ও টিপরা জ্বলে উঠেছিল সাম্প্রদায়িক হিংসার লেলিহান শিখায়। দীর্ঘ ৭৯ বছর পর, ২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বরের অন্ধকার রাতে যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংবাদমাধ্যমের দপ্তর আক্রান্ত হচ্ছিল এবং একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ধূলিসাৎ করা হচ্ছিল, তখন সচেতন মানুষের মনে সেই পুরানো আতঙ্কই ফিরে আসে। ইতিহাস যেন এক নিষ্ঠুর বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে— বদলেছে শুধু স্থান, কাল, পাত্র— কিন্তু উন্মত্ত মৌলবাদী ধর্মান্ধদের হিংস্রতা আর ঘৃণা ছড়ানোর কৌশলগুলো রয়ে গেছে হুবহু একই।
অক্টোবর ১৯৪৬, বিশ্বাসের অপমৃত্যু
নোয়াখালির সেই দাঙ্গা কোনও আকস্মিক ঘটনা ছিল? না, একেবারেই না! তা ছিল পরিকল্পিত। রাজনীতির সঙ্কীর্ণ স্বার্থে সাধারণ মানুষকে ধর্মের নামে উস্কে দেওয়া হয়েছিল। রায়পুরা থেকে শুরু হওয়া সেই তাণ্ডবে হাজার হাজার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, চলে হত্যালীলা ও নারী নিগ্রহ। মহাত্মা গান্ধী যখন ১৯৪৭-এর জানুয়ারিতে নোয়াখালির কাদা-মাখা পথে ‘শান্তি যাত্রা’ করেছিলেন, তিনি দেখেছিলেন কীভাবে এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীর রক্ত নিতে দ্বিধা করেনি। সেই দাঙ্গার মূলে ছিল ছড়িয়ে দেওয়া ভুল তথ্য ও পরিকল্পিত ঘৃণা, যা আজ আধুনিক যুগে ‘পোস্ট ট্রুথ’ বা উত্তর সত্য বলে পরিচিত। চলতি কথায়– নির্মান করা গুজব।
আধুনিক ‘মব জাস্টিস’!
২০২৫-এর ১৮ ডিসেম্বরের ঘটনাপ্রবাহে আমরা সেই একই চিত্রনাট্য দেখি। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে যখন ‘প্রথম আলো’ বা ‘ডেইলি স্টার’-এর মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ চালানো হয়, তখন তা কেবল ভবনের ওপরই হামলা নয়, এটা মুক্ত চিন্তার ওপর কুঠারাঘাত। ১৯৪৬-এ যেমন বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় বড় করার চেষ্টা হয়েছিল, বর্তমানেও একাত্তরের বীরত্বকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক শূন্যতা’ তৈরির চেষ্টা চলছে। নোয়াখালিতে যা ছিল লাঠি আর বল্লম, আজ তা ডিজিটাল স্ক্রিনের উসকানি আর পরিকল্পিত সুসংগঠিত ‘মব ভায়োলেন্স’।
নেপথ্যের কারিগর
এই অস্থিরতার পেছনে শুধুই একাংশের উন্মত্ত মানুষই কি দায়ী? না; শুধু স্থানীয় জনতা এত বড় ঘটনা নির্মাণ করতে পারে না। ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বড় বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে সবসময়ই শক্তিশালী কোনও অদৃশ্য হাত থাকে।
রবার্ট ড্রেফাস একজন প্রখ্যাত মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং লেখক, যিনি মূলত মধ্যপ্রাচ্য, জাতীয় নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর (বিশেষ করে সিআইএ) রাজনৈতিক ও কৌশলগত ভূমিকা নিয়েই বেশি কাজ করেছেন।
রবার্ট ড্রেফাস তাঁর বিখ্যাত বই 'Devil's Game: How the United States Helped Unleash Fundamentalist Islam' (২০০৫)- বইতে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে পাকিস্তান এবং ভারতের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু বিস্ফোরক পর্যবেক্ষণ উপস্থিত করেছেন।
দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ইসলামিস্ট’ কার্ড ব্যবহার - ড্রেফাস দেখিয়েছেন, ১৯৫০-এর দশক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ায় বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক প্রভাব (বিশেষ করে নেহরুর ভারত বা তৎকালীন সোভিয়েত ঘনিষ্ঠতা) কমানোর জন্য ধর্মীয় কট্টরপন্থাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করে। তিনি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে একটি 'ফ্রন্টলাইন স্টেট' হিসাবে ব্যবহার করে সেখানকার মৌলবাদী দলগুলোকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছে। কারণ এই দলগুলো কমিউনিজমকে ‘ধর্মের শত্রু’হিসাবে প্রচার করত, যা আমেরিকার পক্ষে সুবিধাজনক ছিল।
জামায়েত-এ ইসলামী ও সিআইএ সংযোগ - ড্রেফাস তাঁর গবেষণায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় জামায়েত-এ ইসলামী-এর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর রাজনৈতিক মতাদর্শ কীভাবে পশ্চিমীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আমেরিকা মনে করত, মওদুদীর ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ ধারণাটি মস্কোপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ঠেকানোর মোক্ষম অস্ত্র। যদিও মওদুদী সরাসরি সিআইএ’র এজেন্ট ছিলেন না, তবে ড্রেফাসের মতে, পশ্চিমী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রমের জন্য একটি ‘অনুকূল পরিবেশ’ তৈরি করতে এই গোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সুরক্ষা দিয়েছে।
আফগান মুজাহিদিন ও চরমপন্থার বিষবৃক্ষ— ড্রেফাসের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানের যে উগ্র মৌলবাদ, তার সূতিকাগার ছিল আশির দশকের আফগান যুদ্ধ। সিআইএ এবং সৌদি আরবের আর্থিক সহায়তায় তৈরি হওয়া হাজার হাজার কেবলমাত্র ধর্ম শিক্ষার মাদ্রাসা কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন সশস্ত্র প্রজন্ম তৈরি করেছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি একে বলেছেন "The Frankenstein Effect"— অর্থাৎ এমন একটি দানব তৈরি করা, যা পরে তার স্রষ্টাকেই আক্রমণ করে।
ভারতের হিন্দুত্ববাদ নিয়ে পর্যবেক্ষণ— যদিও ড্রেফাসের অনুসন্ধানের মূল বিষয় ছিল ইসলামপন্থী মৌলবাদ, তবে তিনি তাঁর বিশ্লেষণে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এক ধরনের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান অন্য ধরনের উগ্রতাকে উস্কে দেয়। তাঁর মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে পশ্চিমী শক্তির যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল, তা পরোক্ষভাবে এই অঞ্চলের সামগ্রিক ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে দুর্বল করে দিয়েছে, যার ফলে হিন্দুত্ববাদী বা অন্যান্য ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান সহজতর হয়েছে।
তাঁর মতে– “মৌলবাদ কোনও শূন্যস্থান থেকে জন্ম নেয় না; একে যত্নে লালন-পালন করা হয়েছে এমন এক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, যেখানে পরাশক্তিগুলো (Superpower) মনে করেছিল ধর্মকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা যাবে।” রবার্ট ড্রেফাস তাঁর গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ‘মব-জাস্টিস’ বা উগ্রবাদের শেকড় কেবল স্থানীয় নয়। ১৯৪৬-এর দাঙ্গার ক্ষতকে সারিয়ে তোলার বদলে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সিআইএ’র মতো সংস্থাগুলো রাজনৈতিক স্বার্থে এই ধর্মীয় উন্মাদনাকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে। আজকের বাংলাদেশে ১৮ ডিসেম্বরের কালো রাত বা ভারতে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ আসলে সেই পুরানো 'শয়তানের খেলার' (Devil's Game) একটি আধুনিক সংস্করণ।
কে জোগাচ্ছে অর্থ?
এই উন্মত্ত মৌলবাদীদের অস্ত্র ও রসদ জোগায় কারা? বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির যে সমান্তরাল অর্থনীতি (ব্যাঙ্ক, বিমা, এনজিও), আর ভারতে আরএসএস’র পেছনে যে কর্পোরেট ফান্ডিং — এই সবই পরোক্ষভাবে এই ঘৃণার বাজারকে টিকিয়ে রাখে।
মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক উসকানি। ভারতের আরএসএস এবং বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো একে অপরের অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করে। আরএসএস যখন ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ায়, তখন বাংলাদেশে মৌলবাদীরা হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হওয়ার অজুহাত পায়। ১৮ ডিসেম্বরের মতো কালো রাতগুলো আসলে এই ‘মিরর ইমেজ’ রাজনীতিরই ফসল, যেখানে সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয়।
শান্তির পথ কী?
নোয়াখালির সেই রক্তস্নাত পথে গান্ধীজী যে শান্তির ডাক দিয়েছিলেন, ২০২৫-এর এই অস্থির সময়ে তার গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ১৯৪৬ থেকে ২০২৫— প্রায় শতাব্দীর এই ব্যবধানে প্রযুক্তি বদলেছে, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে ধর্মকে ব্যবহার করার কৌশল বদলায়নি। যদি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা না করা যায় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা বা ভারতের স্বাধীনতা সেনানীদের সম্মান পুনরুদ্ধার না হয়, তবে এই ‘কালো রাত’গুলো বারবার ফিরে আসবে। দক্ষিণ এশিয়াকে বাঁচাতে হলে এই ‘ঘৃণার অর্থনীতি’ এবং ‘বিদেশি গোয়েন্দা ফাঁদ’ থেকে বেরিয়ে আসাই এখন সময়ের দাবি।
মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের রক্তক্ষয়ী উপাখ্যান দ্বারা চিহ্নিত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে ধর্মকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৪৬ সালের কলকাতার ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ এবং ‘নোয়াখালির দাঙ্গা’ যেমন এই অঞ্চলের মানচিত্র বদলে দিয়েছিল, তেমনই বর্তমান সময়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর আক্রমণ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মানের মধ্য দিয়ে সেই একই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
ঐতিহাসিক ক্ষত
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লিগের ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ ছিল আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম বড় মাপের সাম্প্রদায়িক বিভাজন। ১৬ থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত চলা এই দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই ১০ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ববঙ্গের নোয়াখালি ও টিপরা (বর্তমান কুমিল্লা) জেলায় শুরু হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। মহাত্মা গান্ধীর শান্তিযাত্রাও এই দীর্ঘমেয়াদি অবিশ্বাসকে পুরোপুরি দূর করতে পারেনি।
বর্তমান ও অতীত— একটি সমাজতাত্ত্বিক তুলনা
১৯৪৬ সালের দাঙ্গা এবং বর্তমানের অস্থিরতার মধ্যে কিছু গভীর সমাজতাত্ত্বিক মিল লক্ষ্য করা যায়।
ধর্মীয় মেরুকরণ ও গুজব— সে সময় যেমন পাড়ায় পাড়ায় গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা বাঁধানো হতো, বর্তমানে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে ‘ডিপফেক’ (ভুয়ো) খবর ও ভিডিও নির্মাণ করে একই কাজ করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য— ‘পাকিস্তান’ বনাম ‘অখণ্ড ভারত’-এর লড়াই আজ দেশভেদে ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ বা ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।
হিংসার ধরন— সংবাদমাধ্যমের দপ্তরে হামলা বা ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর ‘মব জাস্টিস’ বর্তমানের একটি নতুন রূপ হলেও, এর মূল সুরটি সেই পুরানো অসহিষ্ণুতা। ১৯৪৬-এর মতোই বর্তমানের সাম্প্রদায়িক সংঘাতেও নারীরাই প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয় এবং দরিদ্ররাই সর্বস্ব হারায়।
মৌলবাদের ‘মিরর ইমেজ’— ভারতের হিন্দুত্ববাদী আরএসএস এবং বাংলাদেশ-পাকিস্তানের ইসলামপন্থী উগ্র মৌলবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি অদ্ভুত আদর্শগত মিল রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানে একেই ‘মিরর ইমেজ’ বা প্রতিচ্ছবি বলা হয়।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ: আরএসএস যেমন ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ হিসাবে দেখতে চায়, তেমনি ওপার বাংলার মৌলবাদীরা বাংলাদেশকে কেবল ইসলামের নীতিতে চালাতে চায়।
সংস্কৃতি ও ইতিহাস— উভয় পক্ষই নিজ দেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে বিরুদ্ধ ধর্ম বা আদর্শের ঐতিহাসিক অংশ মুছে ফেলতে চায়।
সাংগঠনিক কাঠামো— উভয় পক্ষই শক্তিশালী ক্যাডার ভিত্তিক ছাত্র-যুব সংগঠন ও সমান্তরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমাজসেবা ও শিক্ষার আড়ালে নিজেদের মৌলবাদী ধর্মান্ধতার আদর্শ প্রচার করে।
অর্থায়নের উৎস ও পদ্ধতি
মৌলবাদের এই উত্থান কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এর পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী ‘সমান্তরাল অর্থনীতি।
কর্পোরেট ও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ— ভারতে বিজেপি-কে দেওয়া বিশাল অঙ্কের নির্বাচনী বন্ড কিংবা বাংলাদেশে জামাত সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক ও হাসপাতালের মুনাফা— এগুলোই রাজনৈতিক ফান্ডিংয়ের বড় উৎস।
রেমিট্যান্স ও হুন্ডি— মধ্যপ্রাচ্য বা পাশ্চাত্য থেকে ধর্মীয় এনজিও’র নামে আসা বিপুল অর্থ অনেক সময়েই উগ্র মৌলবাদীদের নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা— স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই সিআইএ বা সমজাতীয় সংস্থাগুলো কমিউনিস্টদের ঠেকাতে কিংবা ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রয়োজনে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে আসছে। আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে সিআইএ’র ‘মুজাহিদিন’ প্রজেক্ট, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বিদেশি হস্তক্ষেপ ও ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ
বর্তমানে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিরতাকে অনেক বিশ্লেষক ‘রেজিম চেঞ্জ’ বা ‘কৌশলগত স্বার্থের’ অংশ হিসাবে দেখেন। ইসকন ইস্যু বা সীমান্ত অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে বড় শক্তিগুলো বাংলাদেশকে তাদের আঞ্চলিক আধিপত্যের ‘গুটি’ হিসাবে ব্যবহার করতে চায়।
মৌলবাদের পুনরুত্থান
১৯৪৬-এর দাঙ্গা আমাদের দেখিয়েছে যে, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা কেবল ধ্বংসই ডেকে আনে। বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ায় মৌলবাদের যে পুনরুত্থান আমরা দেখছি, তা মূলত এক দেশ থেকে অন্য দেশে প্রবাহিত হয়। ভারতের উগ্রতা বাংলাদেশে জ্বালানি জোগায়, আর বাংলাদেশের অস্থিরতা ভারতের কট্টরপন্থীদের হাতে অজুহাত তুলে দেয়। এই চক্র থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন স্বাধীন মুক্তচিন্তার সংবাদমাধ্যম, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে গণতান্ত্রিক নাগরিকত্ববোধ।
১৯৪৬-এর দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বা নোয়াখালির দাঙ্গা আর ২০২৫-এর ১৮ ডিসেম্বরের কালো রাত — মাঝখানে আট দশকের ব্যবধান থাকলেও উভয়েই একই রাজনৈতিক প্রকল্পের ফসল। এই দীর্ঘ সময়ে অসত্য আর গুজবের জায়গা নিয়েছে কিবোর্ড আর সোশাল মিডিয়া, কিন্তু ঘৃণার চাষ-আবাদ রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। রবার্ট ড্রেফাসের সেই ‘শয়তানের খেলা’ আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান, তা কোনও আকস্মিক ‘মব জাস্টিস’ নয়। বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ছক।
একদিকে আরএসএস’র মতো কর্পোরেট-পুষ্ট হিন্দুত্ববাদী শক্তি, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় শিকড় গেঁড়ে বসা ইসলামপন্থী উগ্র মৌলবাদ— এরা কেউ কারোর শত্রু নয়, বরং আদর্শগতভাবে একে অপরের পরিপূরক। যখনই এই অঞ্চলের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতা বা গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলতে চায়, তখনই অদৃশ্য সুতোর টানে এই ‘উন্মত্ত জনতা’কে প্ররোচিত করে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরাধীন অবিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং পরবর্তীতে সিআইএ’র মতো সংস্থাগুলো যে বিষবৃক্ষের চাষ করেছিল, তার বিষময় ফল আজ আমাদের প্রজন্মের সংবাদকর্মী আর মুক্তচিন্তার মানুষদের ভোগ করতে হচ্ছে।
প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঘৃণা
ইতিহাসের এই রক্তক্ষরী চক্র থেকে বেরোতে হলে কেবল সরকার বদল যথেষ্ট নয়; দরকার সেই ‘সমান্তরাল অর্থনীতি’র মূলে আঘাত করা, যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে দাঙ্গার রসদ জোগায়। ১৮ ডিসেম্বরের অন্ধকার রাত আমাদের মনে করিয়ে দেয় — যদি আমরা আমাদের চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঘৃণার চেতনা শাণিত করতে না পারি, তবে ১৯৪৬-এর সেই বিষাক্ত ইতিহাস বারবার ফিরে আসবে ভিন্ন কোনও ক্যালেন্ডারের পাতায়। মুক্তির একমাত্র পথ হলো বিভাজনের এই সাম্রাজ্যবাদী ও স্থানীয় চক্রকে চেনা এবং মানুষের ঐক্যের মাধ্যমে তাকে প্রতিরোধ করা। এর জন্যই প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শাণিত তীব্র ঘৃণা। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী চেতনা ও লড়াই ছাড়া, সাম্প্রদায়িক উগ্র মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা যায় না।
Post Editorial
রক্তক্ষয়ের চক্র— ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
×
Comments :0