Post Editorial

কেন্দ্রের জনবিরোধী, স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমজীবীরা রাস্তায় ৫ এপ্রিল সংসদ অভিযান

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial


অনাদি সাহু
আরএসএস, বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রের জনবিরোধী, দেশবিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিস্ত সরকারকে হটাতে ৫ এপ্রিল, ২০২৩ দিল্লিতে শ্রমিক-কৃষক সংঘর্ষ র্যা লির ডাক দিয়েছে সিআইটিইউ, সারা ভারত কৃষকসভা, সারা ভারত খেতমজদুর ইউনিয়ন। ঐদিন দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারী, কৃষক, খেতমজুর পার্লামেন্ট অভিযানে শামিল হতে প্রস্তুত হচ্ছেন। তারা ঐদিন আহ্বান জানাবেন দেশ বাঁচাতে, দেশের মানুষকে বাঁচাতে বিজেপি-কে পরাজিত করতে হবে। দিল্লি থেকে লাল ঝান্ডার আওয়াজ শুনবে সারা দেশের মেহনতি মানুষ। গত ২০ মার্চ, ২০২৩ দিল্লিতে রামলীলা ময়দানে সংযুক্ত কিষান মোর্চার বিশাল সমাবেশের পর ৫ এপ্রিলের শ্রমিক-কৃষক সংঘর্ষ র্যা লি সারা দেশে কেন্দ্র বিরোধী লড়াইকে আরও তীব্র করবে। এরপর কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকে ৯ আগস্ট ভারত ছাড়ো দিবসে দেশজুড়ে কেন্দ্র বিরোধী মহাপড়াও কর্মসূচি পালিত হবে। আমাদের রাজ্যের শ্রমিক কর্মচারী সংগঠনগুলি ৯-১০ আগস্ট, ২৩ কলকাতায় বিরাট শ্রমিক সমাবেশ ও ৪৮ ঘণ্টা অবস্থানের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই সরকারকেই পরাজিত করার আহ্বান জানিয়ে।

৯০-এর দশকের প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির স্বার্থে পরিচালিত উদার অর্থনীতির বিরুদ্ধে দেশে সিআইটিইউ সহ বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি লড়াই করে আসছে। আইএনটিইউসি, এইচএমএস এবং বিএমএস পরে ঐক্যবব্ধ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে শামিল হয়। নরেন্দ্র মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর আরএসএস, বিজেপি’র পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, দেশবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বেসরকারিকরণ, শ্রমআইন সংশোধন সহ বিভিন্ন ইস্যুতে শ্রমিক শ্রেণির লড়াই আন্দোলন ধর্মঘটের পথে অগ্রসর হলে বিএমএস (বিজেপি শ্রমিক সংগঠন) নিজেদের যুক্ত আন্দোলন থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু এতদ্‌সত্ত্বেও দেশের শ্রমিক আন্দোলন আরও প্রসারিত হয়েছে এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গত ৪ বছরে চারটি সর্বভারতীয় ধর্মঘট সফল হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষকরাও রাস্তায় লড়াইতে শামিল হয়েছেন। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি পরিচালিত কর্পোরেট পুঁজির দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ মোদী সরকার তার দেশ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতির পরিবর্তন ঘটাতে সম্মত নয়।

আজ শুধু দেশের স্বনির্ভর অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা, রাষ্ট্রায়ত্ত‍‌ ক্ষেত্র, শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত অধিকার আক্রান্ত নয়, দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্রীয়নীতি, গণতন্ত্র সবই আক্রান্ত।
গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের স্বার্থে, উদার অর্থনীতির নামে আর্থিক সংস্কারের কর্মসূচি চলছে। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার গত নয় বছর ধরে দেশবাসীর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে জনগণের জীবন-জীবিকার উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি, তীব্র বেকারি, কলকারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি হ্রাস, কৃষকের আত্মহত্যা ঘটেই চলেছে। দেশজুড়ে অভুক্ত মানুষের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। মোদী জমানায় দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকার সৃষ্টি করেছে। খাদ্য সুরক্ষার সূচকে ভারত বর্তমানে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নিচে।


আন্তর্জাতিক ক্ষুধার সূচকে ভারতের স্থান ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম স্থান। যদিও বিজেপি, আরএসএস এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের বর্তমান সময়কে অমৃত মহোৎসব পর্ব হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। দেশের সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কৃষকরা যখন গভীর সঙ্কটে, তখন কেন্দ্রীয় সরকার জনস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে বর্তমান অর্থবর্ষে (২০২৩-২৪) কেন্দ্রীয় বাজেটে খাদ্য, সার, রেগা প্রকল্পে এবং সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ ব্যাপকভাবে ছাঁটাই করেছে। শিক্ষাখাতে সেই অর্থে কোনও অর্থ বৃদ্ধি করা হয়নি। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ বা দেশের তীব্র বেকার সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন। কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরে ১০ লক্ষ পদ শূন্য, ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, প্রতিরক্ষা সহ রাষ্ট্রায়ত্ত  ক্ষেত্রেও লক্ষ লক্ষ যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিয়োগের ব্যবস্থা না করে সর্বত্র কর্ম সঙ্কোচনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্প রেগাতে ৩৩,০০০ কোটি টাকা, সারে ৫০,০০০ কোটি টাকা, কৃষিতে ১০,০০০ কোটি টাকা, গরিব মানুষের জন্য খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পে ৫৯,৭৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ হ্রাস করা হয়েছে। স্কুলে শিশু-কিশোরদের মিড ডে মিল প্রকল্পে ৯.৪ শতাংশ বরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে ৩৪ শতাংশ অর্থবরাদ্দ ছাঁটাই করা হয়েছে। অক্সফামের রিপোর্ট অনুযায়ী মোদী জমানায় দে‍‌শের ১০ শতাংশ সবচেয়ে ধনী বিত্তশালী মানুষের তুলনায় দেশের দরিদ্রতম ৫০ শতাংশ জনগণকে বর্তমানে ছয়গুণ বেশি পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এই সময়ে জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী, ওষুধের ওপর জিএসসি বিপুল পরিমাণে চাপানো হয়েছে। উচ্চবিত্ত ও কপেরারেটের ট্যাক্স হ্রাস করা হয়েছে। আদানি, আম্বানিদের মতো পুঁজিপতিদের ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া কর্পোরেট ঋণ বিপুলভাবে মকুব করা হয়েছে (প্রায় ১০ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা) যা দেশ ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী।

এই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ওপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের দেশের স্বনির্ভর অর্থনীতির মেরুদণ্ড, গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেসরকারিকরণ নির্বিচারে চলছে। ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, প্রতিরক্ষা, কয়লা, ইস্পাত, বিদ্যুৎ, রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহণ ব্যবস্থা যা কেন্দ্রীয় সরকারকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ করতে সাহায্য করছে, যা মহারত্ন, নবরত্ন, মিনিরত্ন সংস্থা, সেগুলিকে দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের  হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইনের নামে পরিকল্পনা ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে, যা জনবিরোধী।
আজ  শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত অধিকার ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত। মালিকশ্রেণির স্বার্থে ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে চারটি শ্রমিক-বিরোধী শ্রম কোড তৈরি করা হয়েছে পার্লামেন্টে কোনও আলোচনা ছাড়াই। মালিক‍‌ শ্রেণির বিরুদ্ধে ২০০ বছর ধরে শ্রমিক লড়াই করে যে অধিকারগুলি অর্জন করেছিল, দেশের সংবিধান, পার্লামেন্ট, সুপ্রিম কোর্ট যে অধিকার শ্রমিকদের দিয়েছিল, আজ বিজেপি,  আরএসএস এবং মালিক শ্রেণির চক্রান্তে তা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়নগুলির মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। শিল্প-কারখানায় মধ্যযুগীয় বর্বর শোষণ ব্যবস্থা কায়েমের চক্রান্ত চলছে।  বিভিন্ন শিল্পে, কল-কারখানায় শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া,   ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা, মালিকদের সাথে দর-কষাকষি করা, ৮ঘণ্টা কাজ, ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা, বোনাস, পেনশন, মেটারনিটি বেনিফিট কাজের স্থায়িত্ব বা জীবিকার নিরাপত্তা সবই আক্রান্ত। মালিক ‍‌ শ্রেণির ‍ অবাধ লুণ্ঠনের জন্যে নতুন শ্রম আইনে (লেবার কোড) দেশের ৭০ শতাংশ শিল্প ও কল-কারখানার শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। নতুন শ্রম আইন তথা লেবার কোডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবিষ্যতে এঁরা শ্রম দপ্তর বা কোনও লেবার কোর্টে যাওয়ার অধিকারও পাবেন না। শিল্প কারখানার শ্রমিক, যাঁরা দেশের সম্পদ সৃষ্টির মূল কারিগর, কৃষক, খেতমজুর আমাদের অন্নদাতা, তাঁরাই আজ আক্রান্ত, লুণ্ঠিত, অবহেলিত বিজেপি-আরএসএস এবং দেশি-বিদেশি  পুঁজিপতিদের ভয়ঙ্কর চক্রান্তের শিকার। আজ শুধু শ্রম আইন সংশোধন নয়, পূর্বেই কেন্দ্র প্রতিরক্ষা শিল্পে শ্রমিক ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে এসমা জারি করেছিল। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘটও নিষিদ্ধ করেছে।


নরেন্দ্র মোদীর জমানায় কর্পোরেট কমিউনাল নেকশাস এদের অশুভ জোট ধান্দার ধনতন্ত্রের হিংস্র আক্রমণ ও লুটকে আরও তীব্র করেছে, শুধু তাই নয়, একইসাথে দেশজুড়ে শ্রমিক‍‌শ্রেণি ও জনগণকে ধর্ম, ভাষা, জাতপাতের ভিত্তিতে বিভক্ত করে আরএসএস, বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদের বিভাজনের রাজনীতির বিপদ বেড়েছে। সম্প্রতি আরএসএস প্রধান মোহন ভগত হিন্দুরাষ্ট্রের কথা ঘোষণা করেছেন। সেই লক্ষ্যে তারা অগ্রসর হচ্ছেন। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব আইন তৈরি করেছে। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, প্রতিবাদী ও বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন বার বার আক্রান্ত। সিবিআই, ইডি, এনআইএ সহ বিভিন্ন এজেন্সি ও বিনাবিচারে আটক আইন, ইউএপি আইনকে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশের ‍‌ ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে  জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি নাগরিকত্ব আইনের যারা বিরোধিতা করেছিল, তাদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে জেলবন্দি করা হয়েছে, মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোটা দেশে ভয়ভীতির একটা পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।


আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি, আদানীদের কোম্পানিতে এলআইসি, এসবিআই, ইপিএফ’র হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং আদানি কোম্পানির উত্থানে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধীদের জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করে তদন্ত করার দাবিতে জোটবদ্ধ লড়াই এবং অতীতের একটি মন্তব্যের জন্য সাংসদ রাহুল গান্ধীর জেল এবং সাংসদ পদ খারিজের ঘটনায় কেন্দ্রের শাসকদলের অসন্তোষ তৎপরতা ও ভূমিকা দেশের গণতন্ত্রের সামনে বিপদ। দে‍‍‌শের সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ আক্রান্ত।
গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে স্বৈরতন্ত্র ও  ফ্যাসিবাদের পথে দেশকে নিয়ে  যাওগা আরএসএস, বিজেপি’র চক্রান্তকে পরাজিত করতে দেশের সমস্ত বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে  শ্রমিক‍‌শ্রেণিকে জোটবদ্ধ করেই অগ্রসর হতে হবে। এই  লক্ষ্যেই শিল্প কারখানায়, এলাকায় এলাকায় সর্বত্র মানুষের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই লক্ষ্যে সিআইটিইউ, কৃষকসভা, সারাভারত খেতমজুর ইউনিয়ন থেকে পার্লামেন্ট অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে।

তাই ৫ এপ্রিল, ২০২৩-এর কর্মসূচি সফল করতে বিজে‍‌পি, আরএসএস’র জাতীয় স্বার্থবিরোধী, দেশবিরোধী নীতিকে পরাজিত করতে সর্বত্র সোচ্চার হতে হবে। শ্রমিক, কৃষক ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে দেশের সর্বত্র আমাদের পথে নামতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment