Md Salim interview

লুঠতন্ত্র ভাঙতে বাংলার মানুষ লড়াইয়ের মাটিতে আছেন

কলকাতা

লুটতন্ত্র ভাঙতে বাংলার মানুষ লড়াইয়ের মাটিতে আছেন 
প্রার্থী, ভোটার, নির্বাচন কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী— সবাই নিরাপত্তা চাইছেন। কিন্তু তাঁদের নিরাপত্তার দাবিতে কর্ণপাত না করে সরকার-কমিশন সুপ্রিম কোর্টে দৌড়াচ্ছে যাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী না আসে। কীসের এত তৎপরতা? আসলে রাজ্য প্রশাসনকে ব্যবহার করে লুটতন্ত্রকে কায়েম রাখার চেষ্টা চলছে। বিজেপি চাইছে মানুষকে ভাগ করে ক্ষমতা পেতে। তৃণমূল তাতেও দোসর। গ্রামের মানুষ তারই জবাব দিতে এবার কোমর বেঁধেছেন। বামপন্থীরা এবং তাঁদের সহযোগীরা চাইছেন মানুষের পঞ্চায়েত। গ্রাম বাঁচাতে এবারের লড়াই এখানেই। সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চন্দন দাস। 

গণশক্তি: ২০২৩ নয় ২০১৮। তফাৎ আছে। সিপিআই(এম) বলছে এই কথা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রেক্ষিতে কী পার্থক্য দুই সময়ের?
মহম্মদ সেলিম: সময় চলতে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে না। সমস্ত জিনিসের মধ্যেই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। আমি পরিবর্তনের নামে গুন্ডামি মস্তানির কথা বলছি না। ওরা ভেবেছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন বুঝি এমনিই জিতে যাবে। জ্যোতিষীর দেওয়া তারিখ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। তারপর তিনি নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে দিলেন। তারপর সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা হলো। তারপর আধিকারিকদের ট্রেনিং দেওয়া হলো। কাগজ নেই, ফর্ম নেই, ডিসিআর নেই— অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে কোনও প্রস্তুতি ছিল না। 
আমরা বুঝতে পারছিলাম অন্যভাবে প্রস্তুতি চলছিল। যেমন আমরা পিংলায় বোমা কারখানার বিস্ফোরণের পরে মৃতার মেয়ের মুখে শুনেছিলাম— পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য কাজের চাপ বেড়েছিল। এরসঙ্গে রয়েছে দলদাস পুলিশ প্রশাসন, আর তাঁদের দেওয়া মিথ্যা মামলা। বিমান বসু যথার্থই বলেছেন মূক বধির কমিশন। এই প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট, ইলেকশন কমিশনের কাজ নিয়ে কতটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কর্মচারীরা নিরাপত্তা চাইছেন। প্রার্থী, ভোটার, রাজনৈতিক কর্মী— সবাই নিরাপত্তা চাইছেন। কিন্তু তাঁদের সেই নিরাপত্তার দাবিকে কর্ণপাত না করে নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে দৌড়াচ্ছে যাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী না আসে। 
এখন প্রশ্ন হলো, কীসের এত তৎপরতা? আসলে রাজ্য প্রশাসনকে ব্যবহার করে লুটতন্ত্রকে কায়েম রাখার চেষ্টা চলছে। লুটতন্ত্র কায়েমের জন্য মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লুট করতে হয়। শাসকের ফরমান— তুমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না, তুমি মনোনয়ন তুলতে পারবে না, তুমি ভোট দিতে পারবে না। ২০১৮ সালে সার্বিকভাবে এই কাজ হয়েছিল। তার ফলে বিরোধীরা ঐতিহাসিকভাবে সবথেকে কম মনোনয়ন জমা দিয়েছিল সেই নির্বাচনে। এবং মিথ্যা মামলা এবং দৈহিক আক্রমণের চাপে সজ্জন ব্যক্তিরা রাজনীতির আঙিনা থেকে সরে দাঁড়ান। তার ফলে দুর্জন এবং মহাজনদের কারবার শুরু হয় পঞ্চায়েতগুলিকে ঘিরে। 
কিন্তু এর পালটা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। সেই মনোভাবের আঁচ পেয়েই আমরা গ্রাম জাগাও চোর তাড়াও, চোর ধরো জেলে ভরোর মতো কর্মসূচি শুরু করি। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলেন। 
আমরা বললাম লাল ঝান্ডা ঘরে ঘরে। এমন বললাম যে অমিত শাহকে এসে জিজ্ঞেস করতে হলো এত লাল ঝান্ডা কোথা থেকে এল? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সোজা নবান্নের ১৪ তলায় চলে গেলেন তিনি। মানুষের মেজাজটা এর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। 
সেই মেজাজ ভাঙতেই বিডিও অফিস, পঞ্চায়েত সমিতির অফিস তৃণমূলের লোক ঘিরে রাখল। ভাঙড়, চোপড়ায় মনোনয়ন দিতে আসা মিছিলে গুলি চালালো। নির্বাচন কমিশন বলল ১ কিলোমিটার দূর অবধি ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। সবটাই করা হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষ প্রার্থীদের সঙ্গে গিয়ে সাহস জোগাতে না পারে। 
কিন্তু এখানেই সার্থকতা, মনোনয়ন প্রক্রিয়া মেটার পরে দেখা গেল যেখানে যেখানে যতটা সম্ভব ততটা প্রতিরোধ হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা রাতারাতি হয়ে যায়নি। এটা লড়ে করতে হয়েছে। 
 গণশক্তি: বিজেপিই বিকল্প, তৃণমূলকে ঠেকাতে পারে বিজেপিই। এই বাইনারি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। আজ সেই দ্বিমেরুর ধারণা কী অবস্থায়?  
 মহম্মদ সেলিম: সেই ধারণা চোখের সামনে এটা ভেঙে পড়ছে। ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি-তৃণমূল দ্বিমেরু তৈরির চেষ্টা হয়। বাজারি মিডিয়ার একটা বড় অংশ মোদী আর মমতার ছবি ছাড়া কিছুই দেখাতো না। তারাও এখন বামপন্থীদের দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ এই দ্বিমেরু তত্ত্ব ছিল অনেকটাই বিজ্ঞাপিত। আরএসএস’র ছাপ আছে এমন কোনও বিষয়ে মমতা ব্যনার্জি মুখ খুলবেন না। মানুষের এটা বুঝতে সময় লেগেছে। কারণ তাঁদের সামনে তো নাটকটা চলছিল, আর গ্রিন রুমে অন্য কারবার চলছিল। বামপন্থীরা এই স্ক্রিপ্টটাই মানুষের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে। 
চোর কখনও চোরকে ধরতে পারে? এক অপরাধী কখনও আরেক অপরাধীর পাশে না দাঁড়িয়ে পারে? 
এখানেও তাই দেখা গিয়েছে। গ্রামে চুরি করেছে। কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তাই গ্রাম জাগাও চোর তাড়াও ডাক দিতে হয়েছে। তৃণমূল পশ্চিমবাংলায় যা করছে, বিজেপি গোটা দেশে তাই করেছে। এখন তৃণমূল বিজেপি’র সাধারণ সমর্থকরাও বলছে, কোথাও তো একটু বোঝাপড়া রয়েছে। নইলে কয়লা পাচারের চার্জশিট থেকে ভাইপো বাদ যায় না। 
এর উলটোদিকে দাঁড়িয়ে বামপন্থীরা সমস্ত বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করার কথা বলে। তৃতীয় একটা রাস্তা বের করতে হবে। তৃণমূল বিজেপি’র মতো রাজনৈতিক দলগুলি সবসময় চায় মানুষের শক্তিকে দুর্বল করতে। মানুষের শক্তিকে দুর্বল করার জন্য মানুষের ঐক্যকে ভাঙতে হয়। আসলে তৃণমূল বিজেপি রাজ্যের সম্প্রীতির বিরুদ্ধে, মানুষের অধিকারের বিরুদ্ধে। তাই তৃণমূল বিজেপি’র শক্তি খর্ব করা একান্তভাবে প্রয়োজন। 
  গণশক্তি: লুটেরাদের তাড়াওয়ের পাশাপাশি ‘জনগণের পঞ্চায়েত গড়ো’ — পার্টি এই আহ্বান জানিয়েছে। কী ধরনের পঞ্চায়েতের কথা বলা হচ্ছে? 
 মহম্মদ সেলিম: পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নামের মধ্যেই একটা গণতান্ত্রিক চরিত্র রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা পাঁচজনকে নিয়েই গড়ে উঠেছিল। বামফ্রন্ট সরকার সেটাকে আইনি রূপ দেওয়ার কাজ করে। এর মাধ্যমে সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ হলো। আর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা মানে তো শুধু প্রধান-উপপ্রধান নয়, গ্রাম সংসদ এবং গ্রামসভার মাধ্যমে সাধারণ ভোটারের কাছেও গণতন্ত্র পৌঁছে দিয়েছিল পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। গ্রামের মানুষ গ্রামসভায় বসে ঠিক করতেন গ্রামের উন্নতির জন্য কোনটা করা উচিত, কোনটা প্রয়োজন। এবং সেখানে বিরোধীদেরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল একেবারে সাংবিধানিকভাবে। কিন্তু এই গোটা ব্যবস্থাটাকে ভেঙে দেওয়া হলো। এখন শাসকের সঙ্গে না থাকলে বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতার মতো জিনিসগুলিও পাওয়া যায় না। এই ব্যবস্থা তো গণতান্ত্রিক হতে পারে না। 
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে নিয়ে তৈরি করা স্লোগানগুলি পর্যায়ক্রম রয়েছে। প্রথমে বলা হলো চোর ধরো জেলে ভরো। এটা মানুষের ভাবনার সঙ্গে মিলে গেল। মানুষ দেখছে টাকার পাহাড় উদ্ধার হচ্ছে। চোর ধরার দাবিতে আদালতে যাওয়া হলো। আদালত রাজ্য পুলিশে আস্থা রাখল না। কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিল। এটাও মানুষের ভাবনার সঙ্গে মিলে গেল। সাধারণ মানুষ দেখছে রাজ্য পুলিশ মমতা ব্যনার্জির সুরে সুর মেলায়। ধর্ষণের অভিযোগ করতে গেলে, খুনের অভিযোগ জানাতে গেলে তৃণমূলের অনুমতি লাগে। আর পুলিশ তৃণমূলের নির্দেশমতো তদন্ত করে। আনিস খান, ভোটকর্মী রাজকুমার রায় এখনও বিচার পেল না। 
তাহলে চোর কে ধরবে? ইডি সিবিআই ধরবে? তারা তো ধরলে চুনো পুঁটিদের ধরবে। এপাশ ওপাশ ঘুরবে। ওপরে তো হাত দেবে না সেটিংয়ের জোরে। এই পর্যায়ে স্লোগান দেওয়া হলো গ্রাম জাগাও চোর তাড়াও। 
যত গ্রাম জাগতে শুরু করল, তত এজেন্সিগুলির উপর চাপ বাড়ল। একইসঙ্গে মানুষও নিজের অধিকার নিয়ে সজাগ হলো। এর মধ্যেই হজরত মহম্মদ, রামনবমী, রাজবংশী-মুসলমান ইত্যাদি নিয়ে তালগোল পাকানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে বিশেষ কাজ হয়নি। তৃণমূল বিজেপি আবার দাঙ্গা ব্যবহার করে বাইনারি তৈরির চেষ্টা শুরু করল। কিন্তু সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে সাধারণ মানুষ বলল, আমরা চোরের বিরুদ্ধে লড়তে চাই। সর্বস্ব লুট হওয়া মানুষকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল হিন্দু-মুসলমান, উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ ইত্যাদির নামে। কিন্তু মানুষ সেই চক্রান্তকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
 গণশক্তি: মনোনয়ন পর্ব শেষ। এখন বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিচ্ছে তৃণমূল। আগামী দিনগুলিতে কী হবে পার্টির ভূমিকা? আপনার আহ্বান কী?
 মহম্মদ সেলিম: রাজ্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল। মিথ্যা মামলা, ঘরছাড়া, সব কিছুর মধ্য দিয়ে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল নির্বিঘ্নে লুটপাট চালানোর জন্য। সরকারের মনোভাব হলো, মিছিল-মিটিং করা যাবে না, পোস্টার লাগানো যাবে না, মুখ বন্ধ রাখতে হবে। মানুষের মুখ বন্ধ রাখতে সপ্তাহে একদিন করে সিপিআই(এম)’কে পেটাতে বলেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এখন আর তৃণমূলের সেই অবস্থা নেই। তারা চাইলেও মানুষের অধিকার লুট করতে পারবে না। সারা পৃথিবীর অভিজ্ঞতা, এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ও সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতার কেন্দ্র তৈরি করে লুটপাট বেশিদিন চলে না। মানুষের সাহসের সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন এবং পুলিশকে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে হবে। মানুষ যদি এককাট্টা থাকেন, হুমকির শক্তির মতো পুলিশের দালালি শক্তিও কমবে। জ্যোতি বসুর কথা স্মরণ করে— মানুষই ইতিহাস রচনা করে। লাল ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে বাংলার মানুষ নতুন ইতিহাস রচনার জন্য লড়াইয়ের মাটিতে আছে। সমস্ত অংশের মানুষের সহযোগিতা এবং সংহতি চাইছি আমরা।

 

Comments :0

Login to leave a comment