নতুনপাতা : গল্প
রিস্ট-ওয়াচ
সৌরীশ মিশ্র
"কি রে তোরা কিছু বলবি আমায়? তখন থেকে দেখছি উশখুশ-উশখুশ করছিস।"
ক্লাস নেওয়া শেষ। টেবিলের উপর থেকে ডাস্টার, চক আর অ্যাটেনডেন্স খাতাটা গুছিয়ে হাতে তুলে নিতে নিতে সামনে বসে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের কথাগুলো বললেন এই ক্লাস টুয়েল্ভ বি-র ক্লাস টিচার সুশোভনবাবু।
সুশোভনবাবুর পড়ানো শেষ হওয়ার পর থেকে সারা ক্লাস জুড়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা ফিসফাস চলছিল টানা। সেটা বন্ধ হল সুশোভনবাবুর কথায়। কেউ কিছু বললও না সুশোভনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে।
সুশোভনবাবু উঠে দাঁড়ালেন এবার চেয়ার থেকে। ছাত্র-ছাত্রীরাও সবাই দাঁড়াল।
সুশোভনবাবু সবে এগিয়েছেন কয়েক পা ক্লাসরুমের দরজার দিকে, তখুনি পিছন থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, "স্যার, একটু দাঁড়ান, প্লিজ, একটু দাঁড়ান..."
সুশোভনবাবু থমকান। তিনি ঘুরে দেখেন, ক্লাসের সব ছাত্র-ছাত্রীরা এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর পিছনে। আর, সবার সামনে এই ক্লাসের মনিটর জ্যোৎস্না। তিনি ভীষণই অবাক হন।
"ব্যাপার কি তোদের? কিছু বলবি তো বল্ না।"
"স্যার, আপনার বাঁ হাতটা একটু বাড়াবেন?" বলে জ্যোৎস্না।
সুশোভনবাবু আগেও দেখেছেন, এই মেয়েটা বেশ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড আছে।
"স্যার বাড়ান না হাতটা, বাড়ান না।" সমস্বরে বলে ওঠে পুরো ক্লাসও সাথে সাথে।
কি যে হচ্ছে, কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না সুশোভনবাবু। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকও তিনি। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের সন্তান ছাড়া অন্য কিছু ভাবেন না। যেমন ভালবাসেন, তেমনই দরকারে শাসনও করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় তিনি। তাই, তাঁর সাথে একজন আপনজনের মতোই কথাবার্তা চালাতে অভ্যস্ত এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা।
"স্যার, কি ভাবছেন এতো? হাতটা বাড়ান না প্লিজ।" ফের বলে জ্যোৎস্না।
ছাত্র-ছাত্রীরা যে হাত না বাড়ানো অবধি ছাড়বে না তাঁকে তা বুঝেই আর কথা না বাড়িয়ে তাঁর বাঁহাতখানা বাড়ান সুশোভনবাবু।
জ্যোৎস্না এবার ওর ঠিক পিছনে দাঁড়ানো সহপাঠী অর্কর দিকে তাকিয়ে বলে, "দে।"
সুশোভনবাবু দেখেন অর্ক একটা ক্যারিব্যাগ জ্যোৎস্নার হাতে দিল। জ্যোৎস্না ব্যাগটা থেকে চটপট একটা নতুন হাতঘড়ি বের করে। সেটা সযত্নে সুশোভনবাবুর হাতে পড়িয়ে দেয় সে, পুরোনো ঘড়িটা খুলে নিয়ে।
সুশোভনবাবুর বিস্ময়ের অন্ত থাকে না যেন। ঐ বিস্ময়ের ঘোর একটু কাটতে তিনি বলেন, "কি করেছিস কি তোরা! ঘড়ি নিয়ে এসেছিস আমার জন্য!"
"স্যার, বেশ কয়েক মাস ধরে দেখছি আমরা, আপনার রিস্ট-ওয়াচটার কাঁচ ভাঙ্গা। তাই আমরা সবাই মিলে..." এটুকু বলেই থামে জ্যোৎস্না।
আর তখুনি, "হ্যাপি টিচার্স ডে, স্যার" বলে ওঠে সমস্বরে গোটা ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা।
ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি যে বড় প্রিয়, একথা সুশোভনবাবুর অজানা ছিল না। তবে, তাঁর জন্য এতোটা ভাবেও যে স্টুডেন্টরা, এটা জানা ছিল না আগে সুশোভনবাবুর।
ততক্ষণে ঢিপ্ ঢিপ্ করে ছাত্র-ছাত্রীরা প্রণাম করে চলেছে সুশোভনবাবুকে একের পর এক।
সুশোভনবাবু তাঁর আশীর্বাদের হাত রাখতে থাকেন প্রত্যেকের মাথায়। তাঁর দু'চোখ জলে ভরা।
Comments :0