Editorial

নিশানা যেন ভুল না হয়

সম্পাদকীয় বিভাগ

পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুর পর কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে সমস্ত রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিল। যদিও সেই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকা প্রয়োজন মনে করেননি। বদলে তিনি চলে গিয়েছিলেন ভোটমুখী বিহারে নির্বাচনী হাওয়া গরম করতে। সেখানে তিনি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে অকল্পনীয় ব্যবস্থা নেবার হুঙ্কার ছেড়েছিলেন। অবশ্য এখনও পর্যন্ত পহেলগামের সন্ত্রাসবাদীদের টিকির সন্ধানও পায়নি সরকার। এই ব্যর্থতার মধ্যেই জোরালোভাবে ছড়ানো হয় যুদ্ধ জিগির। কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে এবং দেশের সমগ্র মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সীমাহীন মাত্রায় ছড়িয়ে এমন এক উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঝড় তোলা হয় যে মনে হয় যে কোনও সময় ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে পাকিস্তানকে ধূলিসাৎ করে দেবে। সরকারের তরফে বার বার বলা হয় ঠিক সময়ে প্রত্যাঘাত হানা হবে। তবে প্রত্যাঘাতটা ঠিক কেমন হবে স্পষ্ট ছিল না। উরির ঘটনার পর সীমান্তের ওপারে ভারতের সেনারা ঢুকে যেমন কিছু সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি  ধ্বংস করেছিল তেমন কিছু হবে নাকি পুলওয়ামার পর ভারতীয় যুদ্ধ বিমান পাকিস্তানে ঢুকে বালাকোটে বোমা বর্ষণ করেছিল তেমন কিছু হবে আন্দাজ করা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত পহেলগামের হামলার পর ১৪ দিনের মাথায় ভারত প্রত্যাঘাত করেছে।
ভারতের সেনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ৯ সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে। তবে এই হামলার কোনও সামরিক লক্ষ্য ছিল না। হামলাগুলি ছিল নির্দিষ্ট লক্ষ্য ভিত্তিক, পরিমিত এবং উত্তেজনাবৃদ্ধিকারী নয়। এমন প্রচারও হয়েছে যে সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি ও সন্ত্রাসবাদীদের নিকেশ করে ভারত উচিত জবাব দিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান দাবি করেছে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে ৬ জায়গায় এবং কোনটাই সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি নয়। সবকটিই সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের এলাকা। এই হামলায় সব মিলিয়ে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত ৪৬ জন। কেউই সন্ত্রাসবাদী নয়। নিহতের মধ্যে শিশু ও মহিলাও আছে। ভারতের হামলার পরপরই সীমান্তে ভারতের ভূখণ্ড লক্ষ্য করে পাক সেনারা ব্যাপক গোলা-ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করে। তাতে ১৫ জন ভারতীয় প্রাণ হারিয়েছে। আহত ৪৩জন।
দু’দেশের মধ্যে সামরিক সংঘাত তীব্র হবার ফলে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি ছড়িয়েছে সীমান্তের দু’পারেই। সীমান্তের কাছে জম্মু-কাশ্মীরের গ্রামগুলিতে পাক হামলায় অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। দলে দলে মানুষ সব হারিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। গোটা কাশ্মীর এলাকা নির্জন-স্তব্ধ। খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি জিনিসের আকালের ভয় ছড়িয়েছে। দু’দেশের মিলে পাঁচ শতাধিক বিমান বাতিল হয়েছে। অন্তত এক ডজন ভারতীয় বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সীমান্তের জেলাগুলিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ। উদ্বেগ ছড়িয়েছে গোটা বিশ্বে। বে‍‌শিরভাগ দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে সংযত হতে বলেছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদীর নেতৃত্বে ভারত বদলা নিয়েছে বলে মোদীভক্ত হিন্দুত্ববাদীরা আনন্দে বিভোর। কিন্তু পহেলগামে ২৬জন নিরীহকে যে সন্ত্রাসবাদীরা মেরেছে তাদের নাগাল কিন্তু মোদী-শাহরা পায়নি। এদিকে পাকিস্তান দাবি করেছে তারা ৫টি ভারতীয় যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করেছে। ভারত এই প্রশ্নে কোনও মন্তব্য করেনি। যদি পাকিস্তানের দাবি সত্য হয় তবে তা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। তেমনি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যদি কোনও‍‌ সন্ত্রাসবাদী না মরে থাকে সেটাও অস্বস্তির। তাই আমাদের আরও মেপে হিসাব করে পা ফেলতে হবে। ভারত দায়িত্বহীন যুদ্ধবাজ এমন বদনাম যেন না হয়। কথায় ও কাজে সমান হতে হবে। নিখুঁত পরিকল্পনা ও সর্বোচ্চ দক্ষতা ছাড়া সাফল্য আসে না। তেমনি জীবনহানিতেও কোনও গৌরব নেই। শান্তির পথে জয়ই সবচেয়ে সেরা জয়। ধ্বংসের পথে নয়, শান্তির পথেই ভারত বিশ্ব জয় করুক।

Comments :0

Login to leave a comment