আসাম বিধানসভা নির্বাচনের একমাসও বাকি নেই। যত ভোট এগিয়ে আসছে ততই ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিভাজনের আগ্রাসী রাজনীতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিককালে সরকারি জমি দখলমুক্ত করার সরকারি পদক্ষেপকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র করতে। বস্তুত ২০২১ সালে হিমন্ত মুখ্যমন্ত্রী হবার পর থেকে পাখির চোখ করেছে এই বিভাজনকে। একদিকে অসমীয়া জাত্যভিমানকে উসকে দিয়ে বাংলা বিদ্বেষ অন্যদিকে অনুপ্রবেশকারী বলে জিগির তুলে মুসলিম বিদ্বেষ। এই দুইয়ের সম্মিলনে হিমন্ত চাইছে তাঁর যাবতীয় দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অপদার্থতা আড়াল করে ফের ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হতে।
গত এক মাসে অন্তত চার জেলায় ৫টি বড়সড় উচ্ছেদ অভিযান চলেছে। সর্বশেষটি গোয়ালপাড়ার পাইকর বনাঞ্চলে। বুলডোজারের নির্মম আঘাতে আশ্রয় হারিয়েছেন প্রায় ৫ হাজার পরিবার। ক্ষমতায় এসে সেই ২০২১ সালে দরং ও লামডিংয়ে, ২০২২ সালে বরপেটায় অনুরূপ অভিযানে শত শত পরিবারকে আশ্রয়হীন করা হয়েছে। গরিব মানুষকে এভাবে ভিটেমাটি ছাড়া করে পথে বসানোর প্রশ্নে সরকারের পরিবেশগত অবক্ষয়, ভূমির সদ্ব্যবহার, পরিযান-পরিচিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকতেই পারে তার অর্থ এই নয় সরকারের চরিত্র থেকে সমস্ত ধরনের মানবিকতা উবে যাবে। সরকার নিষ্ঠুর যন্ত্রে পরিণত হবে। একটা জনকল্যাণকামী নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মৌলিক বৈশিষ্ট্যই হলো অন্তর্ভুক্তিকরণ, বিযুক্তিকরণ নয়। এক্ষেত্রে হিমন্তের সরকার বিযুক্তিকরণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ স্লোগানকে আসামে বাতিল করে দিয়েছেন হিমন্ত।
যে সমস্যা ও উদ্বেগগুলিকে সামনে রেখে হিমন্ত উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছেন সেগুলি নতুন কিছু নয়, দেশভাগের পর থেকে তা বিরাজমান। কিন্তু তিনি এই উদ্বেগগুলিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে টার্গেটকরণে একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে। তাই তার এই উচ্ছেদ অভিযান সীমাবদ্ধ থাকছে সেই সব এলাকায় যেখানে প্রধানত বাস করেন বাংলাভাষী মুসলিমরা। আবার এই অভিযানের পক্ষে যুক্তি ভাষ্যও তিনি তৈরি করছেন একেবারে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি থেকে। সমস্ত মুসলিমকেই বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলিমকেই তিনি বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন। ঘৃণা ছড়িয়ে তাদের উচ্ছেদকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বৈধতা দিতে চাইছেন। বলছেন মুসলিম সংখ্যাধিক্যের আগ্রাসন, ভূমি জেহাদ ইত্যাদি নানা কথা। মুখ্যমন্ত্রী মুখে যেমন অনর্গল সাম্প্রদায়িক ভাষায় উগরে দেন তেমনি তার প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলিও সাম্প্রদায়িকতায় মোড়া।
যে মানুষগুলিকে নির্বিচারে উচ্ছেদ করা হচ্ছে তারা সকলেই বিপন্ন, নিঃস্ব, প্রান্তিক মানুষ। তাদের বিদেশি বহিরাগত দাগিয়ে দিয়ে বিপন্নতা ও অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। আসাম এমন একটি রাজ্য যেখানে ইতিমধ্যেই এনআরসি’র দৌলতে ১৯.৬ লক্ষ মানুষ সন্দেহের তালিকায়। সরকারের সহায়তা ছাড়া তাদের নিজেদেরকেই নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। তারপর গত চার বছর ধরে হিমন্তের উচ্ছেদ অভিযান। তাতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ তাদের জমি-সম্পত্তির অধিকার হারিয়েছেন। এটা নিছক উচ্ছেদ নয়, তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে মাথা গোঁজার ঠাঁই, স্কুল, ধর্মস্থল, জীবিকা, জীবনরেখা, জীবন সময়— সবকিছু। এদের বেশিরভাগই নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারা, অর্থনৈতিক প্রান্তিক মানুষ, ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত।
সরকারি জমি বেদখল হলে সরকার অবশ্যই তা উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু তা কখনই এমন নিষ্ঠুর অমানবিকভাবে না। বাসস্থানের, রোজগারের, বেঁচে থাকার অধিকার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার, তা কেড়ে নেবার অধিকার কোনও সরকারেরই নেই। সরকারের দায়িত্ব তাঁদের ভিটের ব্যবস্থা করা, তাদের রুজি সংস্থান করা, তা না করে সরকার তাদের ভিটে কেড়ে, রুজি কেড়ে নিঃস্ব করে পথের ভিখারি বানাতে চাইছে। এটা সংবিধান বিরোধী। এপথ আসাম নতুন ধরনের গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।
Editorial
অপরিণামদর্শী

×
Comments :0