‘‘সন্ত্রাসবাদকে জোরালো ধাক্কা দেওয়া আমাদের জাতীয় সংকল্প। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্বের উপরে আমাদের পূর্ণ ভরসা আছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের পদ্ধতি, লক্ষ্য এবং সময় সেনা ঠিক করুক।’’ মঙ্গলবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক উচ্চস্তরীয় বৈঠকে এই কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৈঠকে ছিলেন ভারতের স্থল, বায়ু এবং নৌ- তিন বাহিনীর প্রধানরা, চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ অনিল চৌহান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর সেনাকে ‘স্বাধীনতা’ দেওয়ার কথা সামনে আসার পরেই আলোচনা জোরালো হয়েছে যে, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে কোনও সময়ে সামরিক অভিযান করতে চলেছে। পুলওয়ামায় আধাসামরিক বাহিনীর কনভয়ের উপরে হামলার পরেও প্রধানমন্ত্রী সেনাকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দেওয়ার পরেই বায়ুসেনা বালাকোটে হামলা চালিয়েছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রী সেনাকে সময়, পদ্ধতি এবং লক্ষ্য স্থির করার কথা বলার পরে আলোচনা জোরালো হয়েছে এদিন রাতেই ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কোনও ধরনের পদক্ষেপ করবে কি না।
এর আগে এদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এনএসজি, বিএসএফ, সিআরপিএফ এবং সীমা সুরক্ষা বলের শীর্ষ আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বুধবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নিরাপত্তা বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক ডাকা আছে। অর্থনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠকও হবে বুধবার। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বেই ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক হয়। বৈঠকের সময় যদিও জানানো হয়নি। সেনা প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের পরে এদিন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে অমিত শাহের সঙ্গে যান আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। পহেলগাম পরিস্থিতি পরবর্তী নাকি দলের সভাপতি নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে কথা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
এদিকে পহেলগামে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে সাত দিন অতিক্রান্ত হলেও হামলাকারী সন্ত্রাসবাদীদের ধরতে পারেনি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। এই ঘটনার পরেই হতাহতদের পরিজনরা সহ বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই প্রশ্ন তোলেন নিরাপত্তার ত্রুটি নিয়ে। এমনকি সর্বদল বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটির কথা মেনে নেওয়া হয়। কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে আছেন প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। ঘটনার দু’দিন পরে বিহারের সভা থেকে এবং ‘মন কি বাত’-র পডকাস্টে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদী এবং তাদের মদতদাতাদের অভাবনীয় শাস্তি দেওয়ার হুঙ্কার দিয়েছেন। কিন্তু কোনও জায়গাতেই যেহেতু প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার কোনও সুযোগ নেই, ফলে নিরাপত্তার ত্রুটি নিয়ে কোনও জবাব তাঁকে দিতে হয়নি। সর্বদল বৈঠকেও আসেননি মোদী। একইভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীরে গেলেও তিনিও নিরাপত্তার ত্রুটি নিয়ে কোনও কথা বলেননি। ঘটনার পর থেকেই বিজেপি এবং সঙ্ঘের লোকেরা সন্ত্রাসবাদী হামলার থেকেও ধর্মীয় পরিচিতি দিতে বেশি উৎসাহী হয়ে ওঠে। সরকারের দিক থেকে যে গুরুতর ত্রুটি ছিল, পর্যটকদের জন্য যে কোনও সুরক্ষা ব্যবস্থা করা হয়নি, তা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু সেই সব ছাপিয়ে মোদী সরকার যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিরোধী দলগুলি পহেলগাম হামলা নিয়ে সংসদের বিশেষ অধিবেশনের দাবি জানিয়েছে। এই অবস্থায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোধরনের সামরিক অভিযান সরকারের মুখ রক্ষা করার জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ভারত এরমধ্যে যে সব ব্যবস্থা নিয়েছে, তার কোনোটাই সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে বিশেষ কার্যকরী হচ্ছে না বলে মনে করছে সঙ্ঘ-বিজেপি’র থিঙ্ক ট্যাঙ্করাও। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মোদী ‘কঠোর’ অবস্থান নিয়েছেন এবং সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন বলে সঙ্ঘ-বিজেপি’র পক্ষ থেকে যে জোরালো প্রচার রয়েছে, তাতে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে পহেলগামের ঘটনা। সন্ত্রাসবাদ শেষ হয়ে গেছে বলে মোদী-শাহদের বড় বড় বুলির মুখে কার্যত চুনকালি লেপে দিয়েছে ওই ঘটনা। এই অবস্থায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই বলে নিজেদের অভ্যন্তরীণ আলোচনায় উঠে এসেছে।
এই ক্ষেত্রে দুটি বিষয় কেন্দ্র সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। প্রথমত, আমেরিকা, চীন সহ আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে যাতে পরমাণু অস্ত্রধর দুই দেশ পুরোপুরি যুদ্ধে না জড়ায়। ভারত কোনোধরনের হামলা চালালে জবাব দেওয়া হবে বলে পাকিস্তানের তরফ থেকে লাগাতার প্ররোচনা চলছে। মন্ত্রী এবং নেতারা যথেচ্ছ এমন কথা বলছেন, যাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ফলে যুদ্ধোন্মাদনা তৈরি হয়েছে সীমান্তের দু’পাড়েই। চীন এদিনও ফের ভারত-পাকিস্তানকে সংযত হতে অনুরোধ করেছে। দুই দেশের সমন্বয়পূর্ণভাবে থাকাটা এই অঞ্চলের শান্তি, সুস্থিতি এবং উন্নয়নের জন্য জরুরি, বলেছে চীন। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প পহেলগাম হামলার পরেও একতরফাভাবে ‘বন্ধু মোদী’র ভারতের পক্ষে দাঁড়াননি। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক। অর্থাৎ পূর্ণ মাত্রায় যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি যাতে না হয়, নিশ্চিতভাবেই সেই বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘেও পহেলগামের ঘটনায় পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের জড়িত থাকার দাবি করে। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান এর বিরোধিতা করে। কিন্তু তা নিয়ে আমেরিকার বা অন্য কোনও তৃতীয় দেশ কোনও মন্তব্যই করেনি ভারতের সমর্থনে। পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার নিন্দা করলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরে কোনও দেশ প্রকাশ্যে সরব হয়নি। উলটে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী যোগের কথা অস্বীকার করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তুলেছে। চীন, রাশিয়াকে এই নিরাপক্ষ তদন্তে তৃতীয় পক্ষ করার দাবিও করেছে পাকিস্তান।
দ্বিতীয়ত, উরি বা পুলওয়ামার পরে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কম্যান্ডো অভিযান বা বিমান হানার মত ঘটনাই যদি ফের ঘটানো হয়, তাহলে এই প্রশ্নও থেকে যাবে এই ধরনের হামলা করে লাভ কী হচ্ছে? সন্ত্রাসবাদীদের নিকেশ করে দেওয়ার দাবি করে, ‘হাও ইজ দ্য জোশ’ স্লোগান দেওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে সন্ত্রাসবাদীরা কিছুদিন পরেই আরও বড় আঘাত হানছে। এই বিষয়টাই বেশি ভাবাচ্ছে মোদীদের। এমন কিছু করতে হবে যাতে সরকারে ‘কঠোর’ কিছু করেছে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ ‘অভাবনীয়’ শাস্তির কথা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পহেলগামের ঘটনার নৃশংসতার জেরে বিরোধী দলগুলি সহ সব অংশই যেহেতু সরকারকে পদক্ষেপের জন্য ‘ফ্রি হ্যান্ড’ দিয়েছে, সরকারকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জোরালো কোনও পদক্ষেপ করে দেখাতেই হবে। মোদীর এদিনের বক্তব্যের পরে স্পষ্ট হয়েছে সামরিক অভিযানের দিকে যাচ্ছেই ভারত। কিন্তু তা কতটা, কীভাবে সেই নিয়ে প্রশ্ন আছেই।
পহেলগামের ঘটনার পরে চব্বিশ ঘন্টা কাটার আগেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানানো হতে থাকে, হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসবাদীরা পাকিস্তানে চলে গেছে। দাবি করা হয়, নিরাপত্তা সংস্থার সূত্র থেকে এইসব জানা যাচ্ছে। কিন্তু সরকারীভাবে কোনও তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। শুধু প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরাই চুপ করে আছেন তা নয়। কোনও সরকারি আধিকারিকও সাংবাদিক বৈঠক করে কিছু বলছে না। এই অবস্থায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কাশ্মীরের বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসবাদী অভিযোগে বেশ কিছু বাড়ি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিয়েছে। যাদের সন্ত্রাসবাদী বলা হচ্ছে তারা সেখানে নেই বহুকাল ধরেই। এটা ওই বাড়ি ঘরে থাকা বয়স্ক, মহিলা, শিশুদের নিরাশ্রয় করে দেওয়া ছাড়া আরও কাজে লাগছে না বলেই মত বিশ্লেষকদের। কিন্তু সরকার দেখাতে চাইছে তারা কিছু করছে। একইভাবে পাকিস্তানের বাসিন্দাদের ভারত ছাড়া করা হচ্ছে। সিন্ধুর জলচুক্তি স্থগিত বলে সরকার ঘোষণা করার পরে বিজেপি’র লোকেরা পাকিস্তানকে শুকিয়ে মারবে বলে আস্ফালন করলেও বিশেষজ্ঞরা দেখিয়ে দিয়েছেন আদৌ সিন্ধুর জল আটকানোর মতো কোনও সুযোগ ভারতের কাছে এখনই নেই। সাত দিন পরে এখন বিরোধীরা সহ সাধারণ মানুষও প্রশ্ন করছে সরকার কী করছে? এই অবস্থায় প্রবল চাপের মধ্যে কেন্দ্র। মোদী সরকার যে ‘বলিষ্ঠ’- তা প্রমাণ করার জন্য মরিয়া সঙ্ঘ-বিজেপিও। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোধরনের সামরিক অভিযানই একমাত্র সরকারের মুখরক্ষা করবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এদিনের বৈঠকের পরে স্পষ্ট, কোনোধরনের সামরিক পদক্ষেপ হতেই চলেছে ভারতের দিক থেকে, তা এক প্রকার নিশ্চিত।
Comments :0