গ্রাম থমথম করছে। তফসিলি প্রধান গ্রাম। উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে পা রাখা এক তফসিলি তরুণীর উপর তৃণমূলীদের এই নৃশংস বর্বরতা, মানতে পারছেন না গ্রামের মানুষ।
সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজে যে ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা, সেই তরুণীর বাড়ি কসবায় তাঁর কলেজ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে। পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, বিধানসভা— সব তৃণমূলের দখলে। বিধানসভা তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত। লাগোয়া যে বিধানসভা, সেটির বিধায়ক আবার রাজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। সেই পদাধিকারী আবার নিজেই আইনজীবী।
তরুণী যে বিধানসভা এলাকার বাসিন্দা, সেটির বিধায়কের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনি কী ওই কসবায় আইন কলেজে নির্যাতিতা মেয়েটির বাড়ি গিয়েছিলেন? জবাব এল, ‘‘কার কথা বলছেন? কসবা তো আমার বিধানসভা এলাকার মধ্যে পড়ে না।’’ এবার বলা হলো, তা ঠিক। কিন্তু সেই ছাত্রী তো আপনার বিধানসভা এলাকাতেই থাকেন। এখান থেকেই কলেজে যেতেন। বিধায়ক বললেন, ‘‘ওদের তো দু’জায়গায় বাড়ি। এখানেও আছে। আবার...-এও আছে।’’ বলা হলো, কিন্তু আপনার এলাকাতেই তো বেশি থাকে। বিধায়ক বললেন, ‘‘আমি যাইনি বুঝলেন। বাড়ির লোকও ঠিক চাইছে না...। তবে বার্তা পাঠিয়েছি। সমবেদনা পাঠিয়েছি। নোংরা ঘটনা। কতগুলো নোংরা ছেলে...।’’ বলা হলো, কিন্তু যারা ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ তারা তো আপনার দলেরই কর্মী, নেতা। এবার বিধায়ক বললেন, ‘‘এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইছি না বুঝলেন। আপনার সঙ্গে দেখা হলে বিস্তারিত বলা যাবে।’’
বিধায়কের তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যরাও চুপ। যে পঞ্চায়েতে ওই তরুণী ছাত্রীর বাড়ি, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীদের মেরেধরে তৃণমূল ওই পঞ্চায়েত দখল করেছে। ২২টি আসনের মধ্যে সিপিআই(এম)’র ৩জন এবং বিজেপি’র ২জন সদস্য জিততে পেরেছেন কোনোক্রমে। তার জন্য রীতিমতো বুথে বুথে, গণনার দিন টেবিলে টেবিলে যুঝতে হয়েছে সেই এলাকার তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের সঙ্গে।
নির্যাতিতা ওই আইনের ছাত্রীর যে সংসদীয় কেন্দ্রে বসবাস, সেটিতে অবশ্য তৃণমূল হেরে গেছে। জয়ী সদস্য এক মহিলা। তিনি শনিবার বললেন, ‘‘তৃণমূলের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ট। ওই মেয়েটির পরিবার তৃণমূলেরই সমর্থক। মেয়েটিও তো শুনলাম কলেজে তৃণমূল করতো। কী করে ওকে বাড়ির লোক তৃণমূলের মতো একটি জঘন্য দল করতে দিতো তা জানি না। তবে যে দলেরই সমর্থক, কর্মী হোক, এই অত্যাচার কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। কী নৃশংস ঘটনা। আমাদের এখানে সবাই আলোচনা করছে। কিন্তু মেয়েটির পরিবার তৃণমূল হলেও যাতে কোনোভাবে এই সময়ে মানসিকভাবে আরও আহত না হয়, আমরা খেয়াল রাখছি। কী বলবো বলুন তো, যাঁর মেয়ের উপর এই জঘন্য হামলা করেছে তাঁরই দলের লোক, তাঁকে কী বলে সমবেদনা জানাবো?’’ গ্রামের আরেক মহিলা বললেন, ‘‘আমি তো ওই বাড়ির সামনে যেতে পারছি না। এত খারাপ লাগছে। ঘেন্না হচ্ছে তৃণমূলের উপর। ছিঃ।’’
তৃণমূলের প্রতি ঘেন্নায় ফুটছে পঞ্চায়েতটির প্রতি পাড়া।
পঞ্চায়েতটির লাগোয়া রেললাইন। একটি স্টেশনও আছে। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা। তিনি বললেন, ‘‘আমরা শুনেছি ঘটনাটি। ওই মেয়েটি যে আমাদেরই এলাকার তাও জেনেছি। কিন্তু আলোচনা যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রেখেছি। মেয়েটির পরিবার ইতিমধ্যে অন্যত্র সরে গেছেন। ওদের দলের লোক, প্রশাসনের লোকই সরিয়ে দিয়েছে, তাও জানি। তৃণমূল সমর্থক পরিবারের মেয়ে বলে দেখলে ভুল হবে। একটি তফসিলি পরিবারের মেয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে, পড়তে চেয়েছে। তাঁর স্বপ্নকে ধ্বংস করতে চেয়েছে পাষণ্ডগুলো। কী করে পারলো ওরা? গ্রামের অন্যরাও একই কথা এসে জিজ্ঞাসা করছে।’’
বামফ্রন্টের যথাসম্ভব ভূমিসংস্কারের কর্মসূচি রাজ্যের গ্রামীণ পরিস্থিতির যে বিপুল উন্নয়ন করেছিল, ধর্ষিতা ছাত্রীর গ্রাম তার একটি প্রমাণ। গত বিশ-তিরিশ বছরে গ্রামে সম্পন্ন হয়েছেন অনেকে। একটি সিনেমা হল আছে পঞ্চায়েতটিতে। সেটি এখনও খোলা। লোকে সিঙ্গল স্ক্রিনে সিনেমা দেখেন। সেখানকার এক তফসিলি পরিবারের নব প্রজন্মের তরুণী আইনজীবী হতে চেয়েছিল। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তাঁর উপর নৃশংস হামলা চালানো হয়েছে, গ্রামের মানুষ সহ্য করতে পারছেন না। এক দোকানদার বললেন, ‘‘সকালে যখন জানলাম মেয়েটি আমাদেরই এলাকার, তখন আরও খারাপ লাগলো। এমনিতেই এসব ঘটনা যারা ঘটায় তারা জন্তু হওয়ার যোগ্যও নয়। এরাই নাকি তৃণমূলের নেতা, কলেজ কন্ট্রোল করে। ভাবতে পারছি না।’’
দুর্বিষহ অবস্থা তৃণমূলের দখল করে পঞ্চায়েতে জেতা সদস্যদের। ওই পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মহিলা। সেই উপপ্রধানের লাগোয়া বুথের সদস্য এক প্রৌঢ়। তাঁর স্ত্রী পনেরো বছর আগে মারা গিয়েছেন। তিনি শনিবার এসেছিলেন সেই পঞ্চায়েতটি যে ব্লকে, সেই ব্লকের সদর শহরে। সেখানেই দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আমার ঘরেও মেয়ে ছিল। তাদের বিয়ে হয়েছে। আমি ভাবতে পারছি না। আমারই দলের ছেলেরা সব এই সব করেছে। ভাবা যায়! কাদের সঙ্গে আছি!’’
Comments :0