sports 2025

আশা-নিরাশার ছন্দে— ভারতের ক্রীড়া জগৎ, একঝলকে ২০২৫

খেলা ফিচার পাতা

সুমিত গাঙ্গুলি

২০২৫ সালটি ভারতীয় ক্রীড়ার ইতিহাসে সাফল্য ও ব্যর্থতার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাস, বিস্তার এবং পরিণতির বছর। এই বছর ভারতীয় ক্রীড়া শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি খেলায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং অলিম্পিক স্পোর্টস থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী দেশজ খেলা, প্যারা স্পোর্টস ও বিশেষ অলিম্পিক—সব ক্ষেত্রেই নিজেদের উপস্থিতির জানান দিয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার তীব্রতার মধ্যেও এক পরিণত ক্রীড়া-জাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে ভারত। এই ঘটনাবলী তারই ইঙ্গিত।

বছরের শুরুতেই ভারতের ক্রীড়া অভিযান শুরু হয় এশিয়ান উইন্টার গেমসে। চীনের হারবিনে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় ৫৯ জন ক্রীড়াবিদ নিয়ে ভারত অংশগ্রহণ করে। যদিও পদক আসেনি, তবু আলপাইন স্কিইং ও ক্রস-কান্ট্রি স্কিইংয়ের মতো খেলায় ভারতের অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এই প্রতিযোগিতায় ফলের চেয়ে অভিজ্ঞতাই ছিল বড় প্রাপ্তি। ঠিক এর পরেই ইতালির তুরিনে অনুষ্ঠিত স্পেশাল অলিম্পিক ওয়ার্ল্ড উইন্টার গেমসে ভারত ইতিহাসের সেরা সাফল্য অর্জন করে। ৩৩টি পদক, যার মধ্যে ৮টি সোনা। এই সাফল্য শুধু পদকের সংখ্যা দিয়ে বোঝা যাবে না। বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্রীড়ার ক্ষেত্রে ভারতের দৃঢ় অঙ্গীকারকেই তুলে ধরছে।

ভারতের ক্ষেত্রে ক্রিকেট সবচেয়ে জনপ্রিয়। সেখানে ফেব্রুয়ারি–মার্চে অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জয়ী ভারত। রোহিত শর্মা’র নেতৃত্বে ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো শিরোপা জেতে তারা। ভারতই প্রথম দল যারা তিনবার এই ট্রফি জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করল। বছরের শেষে এশিয়া কাপ জয় এই আধিপত্যকে আরও দৃঢ় করে।

মহিলা ক্রিকেটে ২০২৫ ছিল ঐতিহাসিক। ভারতে আয়োজিত আইসিসি মহিলা একদিনের বিশ্বকাপে, হরমনপ্রীত কৌরের নেতৃত্বে ভারত প্রথমবার বিশ্বকাপ জয় করে। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে হারানো ছিল দীর্ঘদিনের কাঠামোগত উন্নয়নের স্বীকৃতি। এর আগেই অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা টি-২০ বিশ্বকাপে ভারত টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শক্ত ভিতের পরিচয়।

অবশ্যই কোনোভাবে ভুলে যাওয়া চলবে না ভারতের দৃষ্টিহীন মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে জয়। প্রথম প্রতিযোগিতাতেই এই সাফল্য মহিলা ক্রিকেটের আরও এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

অ্যাথলেটিক্সে বছরের সবচেয়ে আলোচিত মুহূর্ত হলো নীরজ চোপড়ার  ৯০ মিটারের গণ্ডি পেরোনো। এই থ্রো ভারতীয় ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইতিহাসে এক নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে। প্যারা অ্যাথলেটিক্সেও বছরটি ছিল স্মরণীয়। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব প্যারা অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ভারত ২২টি পদক জিতে নিজেদের সেরা পারফরম্যান্স দেয়।

দাবায় ২০২৫ সাল ভারতের আধিপত্যকে আরও স্পষ্ট করে। মহিলা দাবায় দিব্যা দেশমুখ বিশ্বকাপ জিতে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন। ভারতীয় মহিলা দাবার ইতিহাসে এ এক বিরাট মাইলফলক। একই বছরে টাটা স্টিল দাবা প্রতিযোগিতায় ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টারদের আধিপত্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের শক্ত অবস্থান তুলে ধরে।

ব্যাডমিন্টনে বছরটি ছিল ওঠানামার। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সাত্বিক সাইরাজ রাঙ্কি রেড্ডি ও চিরাগ শেট্টি জুটি ব্রোঞ্জ জিতে ভারতের মুখ রক্ষা করে। পাশাপাশি বিডব্লিউএফ ওয়ার্ল্ড ট্যুরে একাধিক ভারতীয় খেলোয়াড় শিরোপা ও ফাইনালে পৌঁছে ধারাবাহিকতার পরিচয় দেন। যদিও বড় ট্রফি আসেনি।

হকিতে ২০২৫ ছিল প্রত্যাবর্তনের বছর। বিহারের রাজগীরে অনুষ্ঠিত পুরুষদের এশিয়া কাপে ভারত দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এর ফলে ২০২৬ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন করে। মহিলা এশিয়া কাপে ভারত রানার্স-আপ হলেও এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ে নিজেদের উপস্থিতি বজায় রাখে। তবে জুনিয়র হকি বিশ্বকাপে ভারত তৃতীয় হয় পুরুষদের বিভাগে। মহিলা বিভাগে দশম স্থান অধিকার করে।

ফুটবলেও ঐতিহাসিক সাফল্য আসে যখন যোগ্যতার মাধ্যমে এএফসি মহিলা এশিয়ান কাপের মূলপর্বে জায়গা করে নেয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। অনূর্ধ্ব-২৩, অনূর্ধ্ব-১৭ দু’টি বিভাগেই ভারত এশিয়ান কাপ খেলবে। তাছাড়া পুরুষদের অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়া কাপেও খেলবে ভারত। তাছাড়া ইস্টবেঙ্গলের মহিলা দল প্রথম সাফ ক্লাব ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

দেশজ খেলাতেও ২০২৫ ছিল গর্বের বছর। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম খো-খো বিশ্বকাপে ভারত পুরুষ ও মহিলা—দু’টি বিভাগেই চ্যাম্পিয়ন হয়। তারা দেখিয়ে দেয় যে ঐতিহ্যবাহী খেলাও বিশ্বমঞ্চে ভারতের পরিচয় হতে পারে। শুটিংয়ে আইএসএসএফ বিশ্বকাপ ও এশিয়ান শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের পদকপ্রাপ্তি ধারাবাহিক সাফল্যের ধারাকে আরও শক্ত করে।

তার মানে এই নয় যে সমস্যা নেই ভারতে। ফুটবলে চলছে চরম অচলাবস্থা। আইএসএল নিয়ে সম্পূর্ণ জট কাটেনি। বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে এশীয় স্তরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে শুরু করা ভারত এখন ক্রমতালিকায় ১৪০’র নিচে। টেস্ট ক্রিকেটে ক্রমাগত দেশের মাটিতে হারছে ভারত। সেই হার আসছে স্পিন খেলতে গিয়ে, যা ভারতের কাছে একদা শক্তি ছিল। ক্রীড়া জগতে অতিরিক্ত কর্পোরেট বিনিয়োগ ক্রমশ বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছেছে।

সব মিলিয়ে, ২০২৫ সাল ভারতীয় ক্রীড়ার জন্য কোনও একক সাফল্যের গল্প নয়, বরং একটি রূপান্তরের বছর। এখানে যেমন আছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ক্রিকেট দল, তেমনই আছে পদকহীন উইন্টার গেমস থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতা। আছে ঐতিহ্যবাহী খেলার বিশ্বজয়, আবার আছে প্যারা ও বিশেষ অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্তির শক্ত বার্তা। এই বছরটি প্রমাণ করে দিয়েছে যে ভারতীয় ক্রীড়া এখন আর শুধু আবেগনির্ভর নয়, বরং পরিকল্পিত, বহুমুখী এবং ভবিষ্যৎমুখী। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই আগামী বছরগুলোতে আরও বড় স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছে ভারতের ক্রীড়া জগৎ।

Comments :0

Login to leave a comment