মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এমন এক ভুল ধারণা সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দেবার চেষ্টা হচ্ছে যে সুদের হার কম থাকলেই শিল্প-বাণিজ্যে বিনিয়োগ বাড়ে। কর্পোরেট সংস্থা বা বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি ব্যাঙ্ক থেকে কম সুদে ঋণ নিয়ে পুরানো প্রকল্প সম্প্রসারণে বা নতুন প্রকল্প গড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। সাধারণ মানুষও বেশি বেশি করে ঋণ নিতে শুরু করবে গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদি কিনতে শুরু করবে। অর্থনীতির সাধারণ জ্ঞান অবশ্য তেমন কোনও ধারণা দেয় না।
মূলত এই প্রশ্নেই মোদী সরকারের সঙ্গে স্বশাসিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিরোধ বাধে গোড়াতে। সাধারণভাবে সব দেশেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের গভর্নর হন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। ভারতেও তাই হতো বরাবর। মোদী যখন ক্ষমতায় আসেন তখন গভর্নর ছিলেন রঘুরাম রাজন। রাজনের ওপর প্রবল চাপ আসতে থাকে সুদের হার কমানোর জন্য। নরেন্দ্র মোদীদের অতি সরলীকৃত ধারণা সুদের হার কমলে শিল্প সংস্থাগুলি সস্তায় পুঁজি সংগ্রহ করে বিনিয়োগ করবে। কিন্তু রঘুরামরা তাতে রাজি হতেন না। কারণ মূল্যবৃদ্ধির হার সহনশীলতার সীমার উপর থাকলে কম সুদের হার মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই দায়িত্বশীল কোনও গভর্নরই সরকারের চাপের কাছে মাথা নত করে সুদের হার কমান না। রাজন কমাননি তাই তাঁকে সরে যেতে হয়। সেই জায়গায় গভর্নর হয়ে আসেন মোদীদের পছন্দের অর্থনীতিবিদ উর্জিত প্যাটেল। প্যাটেল এসে প্রথম দিকে মোদীদের আবদার মেনে সুদের হার কমানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু অনতিবিলম্বে সুদের হার বাড়তে থাকলে তিনি বাধ্য হয়ে সুদের হার ফের বাড়াতে থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই সঙ্ঘাত শুরু হয়ে যায় সরকারের সঙ্গে। আদতে উর্জিত যেহেতু অর্থনীতিবিদ তাই মোদীভুক্ত হলেও মোদীদের সব আবদার মানতে পারছিলেন না। ফলে তাঁকেও বিদায় নিতে হয়।
এরপর মোদী আর অর্থনীতিবিদদের গভর্নর করার ঝুঁকি নেননি। দায়িত্ব দিলেন অতি ঘনিষ্ঠ আমলা শক্তিকান্ত দাসকে। পাশাপাশি আইন বদল করে স্বশাসিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ বাড়ানো হয়। নতুন ঋণ নীতি কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করে গভর্নরের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য। অর্থাৎ সুদের হার নিয়ন্ত্রণের সরকারের মতামত আইনি বৈধতা পায়। এত করেও শেষ পর্যন্ত শক্তিকান্তকে একশোভাগ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তিনিও উচ্চ মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে যথেচ্ছভাবে সুদের হার কমাতে পারেননি। অতএব শক্তিকান্তকেও বিদায় নিতে হয়।
বর্তমানে গভর্নর পদে এসেছেন মোদী ঘনিষ্ঠ আর এক আমলা সঞ্জয় মালহোত্রা। সঞ্জয়কে দিয়ে মোদীরা সুদের হার কমানোর চেষ্টা শুরু করেন। আসলে নানা ধরনের নীতি পদক্ষেপ নেবার পরও অর্থনীতির গতি বাড়ছে না। বৃদ্ধির হার বাড়ছে না। এই অবস্থায় মোদী সরকার চাইছে সুদের হার অনেকটা কমিয়ে কর্পোরেটের হাতে সস্তার পুঁজি জোগান দিতে। সঞ্জয় প্যাটেল দায়িত্ব নিয়ে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে ব্যাঙ্কের ভাঁড়ারে যেমন বিপুল নগদের জোগান বাড়িয়েছেন তেমনি সুদের হারও অনেকটা কমিয়ে দিয়েছেন। তাতে সরকার উৎসাহিত হয়েছে বটে কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেবার প্রবণতা বাড়েনি। বরং দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই ঋণ দেবার হার কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ কর্পোরেট সংস্থা ঋণ নিচ্ছে না। আসলে মানুষের হাতে টাকা নেই, কাজ নেই, আয় বাড়ছে না তাই বাজারে পণ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়ছে না। তাই উৎপাদন বৃদ্ধির বা উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির উৎসাহ নেই। সুদের হার কমলেই, ঋণ দেবার জন্য ব্যাঙ্ক বিপুল অর্থ নিয়ে বসে থাকলেও বিনিয়োগ বাড়ে না।
Editorial
সুদ কমলে বিনিয়োগ বাড়ে না

×
Comments :0