মহম্মদ সেলিম
কোনও ঘটনা, দিবস, ব্যক্তিকে আমরা স্মরণ করি প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, যে নির্দিষ্ট ঘটনা আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরণের সূচক হয়ে ওঠে, যার প্রভাব সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী প্রভাব সৃষ্টি করে, সেই ঘটনাকে স্মরণ করতে হয়। সেই স্মরণ আসলে বিশ্লেষণের জন্য, স্মৃতি রোমন্থন কিংবা শুধুমাত্র ইতিহাস জানার জন্য নয়। দ্বিতীয়ত, সেই ঘটনা কিংবা দিনের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে কয়েকটি শিক্ষা উপস্থিত করে। যা আমাদের এগিয়ে চলার পাথেয় হয়। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই শিক্ষা তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। স্বাভাবিকভাবেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনার নেতৃত্বদানকারী সংগঠন এবং ব্যক্তির ভূমিকাও সেই সূত্রে আমাদের কাছে স্মরণীয় হয়ে ওঠে। ১৯১৭-র ৭ থেকে ১৭ নভেম্বর, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনকে সেই কারণেই আমরা স্মরণ করি। স্মরণ করি কমরেড লেনিনকে এবং বলশেভিক পার্টির অবদান, শিক্ষাকে। পাশাপাশি সেই বিপ্লবে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের ভূমিকাও আমাদের কাছে শিক্ষণীয়।
নভেম্বর বিপ্লবের দিশা
নভেম্বর বিপ্লব এক যুগান্তকারী ঘটনা। যার মাধ্যমে রাশিয়ায় শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতন্ত্র। তার আগেও লেনিন এবং তাঁদের পার্টি বিপ্লবের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯০৫-এ সে বিপ্লব সফল হতে পারেনি। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বলশেভিক পার্টি এগিয়েছিল। দমে যায়নি, ভেঙে পড়েনি। বিপ্লবের জন্য, বিপ্লবী আন্দোলনের জন্য তত্ত্বের প্রয়োজন। কৌশলের প্রয়োজন। প্রয়োজন হয় দৃঢ় সংগঠনের। পাশাপাশি নভেম্বর বিপ্লবের অন্যতম শিক্ষা হলো, পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, সমাজগুলির সঙ্কট বিচার করে বিপ্লবী আন্দোলনে যত বেশি সংখ্যায় মানুষকে যুক্ত করার উপর সংগ্রামের সাফল্য নির্ভর করে। একটি দৃঢ়, আন্দোলনমুখী সংগঠন সেই সাফল্য আনতে পারে। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা তাই।
নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল অনেকগুলি দেশে। ইতিহাস বলছে, সেই বিপ্লবের প্রভাবে একদিকে ১৯২০-র জুলাইয়ে লন্ডনে তৈরি হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেন (সিপিজিবি), আবার সেই বছরেরই অক্টোবরে তাশখন্দে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে অত্যাচারিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। এমন আরও উদাহরণ আছে। তবে লেনিন যাকে সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থি বলেছেন সেই উপনিবেশগুলিতে তার প্রভাব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার আগে সাম্রাজ্যবাদের অধীনে নিষ্পেশিত দেশগুলির অবস্থার বিচার বিশ্লেষণ কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের লেখায় দেখা গেছে। যেমন ভারতে ১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশ্লেষণ আমরা দেখতে পাই মার্কসের রচনায়।
ভারতের মতো চীন, তুরস্ক, ইরানের মতো সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনে বিধ্বস্ত দেশগুলিতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবে বিশেষ মাত্রা সংযোজিত হয়েছিল। আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কখনও মাৎসিনি, কখনও আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহ, কখনও ফরাসি বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হতে দেখা গেছে। ফরাসি বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল ‘স্বাধীনতা সাম্য সৌভ্রাতৃত্ব।’ নভেম্বর বিপ্লব নির্দিষ্ট করেছিল সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্যর কথা, ভেদাভেদহীন সমাজের কথা। ১৯১৭-তে রাশিয়ার সংলগ্ন দেশগুলিতে, রাশিয়ায় নানা কারণে যাওয়া ভিন দেশের মানুষের মধ্যে সামাজিক ভেদাভেদ মুছে দেওয়ার এই প্রক্রিয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। জারের শাসনে মেহনতি মানুষ, ভিন দেশগুলি থেকে যাওয়া শ্রমজীবীরা নানাভাবে নিপীড়িত হতেন। গুরুত্ব ছিল শুধু ব্যবসায়ী আর মহাজনদের। নভেম্বর বিপ্লবের সামাজিক সাম্যের আহ্বান স্বাভাবিকভাবেই সেই শ্রমজীবীদের আকৃষ্ট করেছিল।
আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, দেশপ্রেমিক। তাঁদের একটি বড় অংশ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ এবং জাত, ধর্ম, লিঙ্গের নামে বিভাজনের বিরোধী। তাঁরা সবাই কমিউনিস্ট ছিলেন না। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লব তাঁদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। যা পরবর্তীকালে আমাদের সংবিধান রচনার সময় পরিলক্ষিত হয়েছে। সংবিধান সামাজিক ন্যায়, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নারী-পুরুষ সমানাধিকারকে মান্যতা দিয়েছে। লক্ষণীয়, যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারা এই সামাজিক ক্ষেত্রে সমতার ধারণার বিরোধী ছিল এবং আজও আছে। স্বাধীনতার এতগুলি বছর পর দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও যখন উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটেছে, তখন সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু হওয়া সেই শক্তিই দেশের সংবিধানকে আক্রমণ করছে। আজও তারা সাম্রাজ্যবাদের পক্ষেই থাকে, নতজানু হয়েই থাকে। স্বভাবতই সেদিনও তারা নভেম্বর বিপ্লবে অনুপ্রাণিতদের নিজেদের প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিল। আজও সেই নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তির আক্রমণের লক্ষ্য মানবতাবাদী, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনকারীরা, কমিউনিস্টরা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীর নানা দেশের উপর চাপ তৈরি করছে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। চীন যখন সেই চাপ অস্বীকার করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে, তখন আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে বারবার।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলত তিনটি ধারা আছে। সেগুলির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই দেশপ্রেমিক, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একাংশ ভেবেছিলেন বাইরে থেকে শক্তি সঞ্চয় করে দেশকে স্বাধীন করা সম্ভব। কেউ চেয়েছিলেন বাইরে থেকে অস্ত্র দেশে পাঠিয়ে স্বাধীন করতে। একাংশ ভেবেছিলেন সাম্রাজ্যবাদের উপর বিভিন্ন সংগঠনের এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীর লাগাতার সশস্ত্র আক্রমণের পথে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তাঁদের আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, শৌর্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লব পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের সামনে যে পথ হাজির করল তা হলো, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে সমাজের আর্থিক, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ, শ্রমিক, কৃষক সহ বিভিন্ন শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণ ছাড়া সাফল্য অর্জন হতে পারে না। স্বাধীনতার আন্দোলনকে হতে হবে প্রকৃত অর্থেই গণসংগ্রাম। কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অভিজ্ঞতা হলো, সেই গণসংগ্রামের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণি না থাকলে ভূস্বামী, বুর্জোয়ারা তার রাশ বারবার টেনে ধরতে পারে নিজেদের স্বার্থে। নভেম্বর বিপ্লব আমাদের শিখিয়েছে শ্রমিক শ্রেণি এবং তার সহযোগী শ্রেণি, সমাজগুলিকে সংগঠিত করতে পারলে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম হয়ে উঠতে পারে প্রকৃত অর্থে মানবমুক্তির সংগ্রাম। লড়াইয়ের পরিসর বাড়াতে হবে, বৃত্ত বৃহত্তর করতে হবে। যা ভারতের মতো আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা পুঁজিবাদী দেশে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ সম্পূর্ণ করে এগিয়ে যেতে পারে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে।
নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাবে গড়ে ওঠা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার সংগ্রামে রেল, বস্ত্র, চটকল সহ নানা ক্ষেত্রের শ্রমিকদের যুক্ত করার লক্ষ্যে প্রথম থেকে পরিচালিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষক সংগ্রামগুলি গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও কমিউনিস্টরা ভূমিকা পালন করেছেন। আবার নভেম্বর বিপ্লবের আলোকে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষকেও স্বাধীনতার সংগ্রামকে গণআন্দোলনে পরিণত করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। নভেম্বর বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া সাম্রাজ্যবাদী শিবিরেও পড়েছিল। গোড়া থেকেই দেশে দেশে একদিকে সাম্রাজ্যবাদ চেয়েছে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনকে দমন করতে। আমাদের দেশেও তাই হয়েছে। দেশে ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর দাবি তোলা, শ্রমজীবী মানুষদের সংগঠিত করতে সক্রিয় কমিউনিস্টদের উপর প্রথম থেকেই নানা আক্রমণ নেমে এসেছে। ব্রিটিশ শাসনে বারবার নিষিদ্ধ হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন কমিউনিস্টরা। অনেক মামলা হয়েছে। অন্যদিকে যারা সাম্রাজ্যবাদকে সহযোগিতা করেছে, সেই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তারা নিষিদ্ধ হয়নি, জেলে গেলেও মুচলেকা দিয়েছে। ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে, স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে আসা শ্রমজীবীদের মধ্যে ধর্মের নামে বিভাজন তৈরি করতে, দাঙ্গা বাঁধাতে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি লাগাতার চক্রান্ত করেছে।
নভেম্বর বিপ্লবের এই সব শিক্ষার ভিত্তিতে সিপিআই(এম) এগিয়েছে। আবার সমাজতন্ত্রের সাময়িক বিপর্যয়ের পর তার কারণ চিহ্নিত করে নিজেদের পথ নির্দিষ্ট করার কাজও সিপিআই(এম) করেছিল। সেক্ষেত্রে আমাদের পার্টির প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ভারতের মাটিতে কিভাবে খেটে খাওয়া মানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা হবে সেটাই সিপিআই(এম)’র কাজ। ভারতের সমাজের বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই সেই পথ তৈরি করতে হবে। আমরা সেই কাজই করে চলেছি। কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রথম পর্যায়ে অনেকেই ভেবেছিলেন যে রাশিয়ার পথই আমাদের পথ। পরবর্তীকালে আর একটি ছোট অংশ চীনের অভিজ্ঞতাকে হুবহু নিজেদের দেশে প্রয়োগের কথা বলেছিলেন। তারা এও বলেছিলেন যে ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।’ কিন্তু আমরা বরাবর স্পষ্ট বলে এসেছি যে, ভারতের সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে সংগ্রামের পথ হবে ভারতের বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। এমনকি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও সেই কাজ একই রকম হতে পারে না। উত্তরণের কোনও মডেল হয় না। তত্ত্ব এক হলেও তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংগ্রামের কোনও সিলেবাস হয় না।
আমাদের পথ
আমাদের দেশে জাতের ভিত্তিতে নিপীড়ন এক প্রবল সঙ্কট। আদিবাসী, তফসিলি জাতি, দলিত অংশের মানুষ নানাভাবে নিষ্পেষিত হন। অত্যাচারিত হন মহিলারাও। আমাদের রাজ্যে বামপন্থীরা দীর্ঘদিন এর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। তবে শুধু বামপন্থীরা নন, আমাদের সমাজের অনেক প্রগতিশীল মানুষ এবং সংগঠন এর বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁদের সবার সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্কের প্রয়োজন। বামফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠার পরে ভূমিসংস্কার সহ নানা কর্মসূচির ভিত্তিতে সমাজের আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মানুষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার গণতান্ত্রিক কাঠামোকেও দৃঢ় করেছে। বিশেষত পঞ্চায়েত, পৌরসভাগুলি পরিচালনার ক্ষেত্রে তা দেখা গেছে। গত ১৫ বছরে রাজ্যে তৃণমূলের শাসনে পিছিয়ে থাকা মানুষের সেই অধিকার মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। আবার এই সময়েই দেশের ক্ষমতায় পৌঁছে গেছে নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি, যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী ছিল। এই দুই শক্তিই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সঙ্কুচিত করতে চায়। আমাদের পার্টি গণতান্ত্রিক অধিকার সম্প্রসারিত করার জন্য লড়াই করি। আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা। ওরা ভোট চুরি করে, লুট করে, এমনকি নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক সংস্থাও কুক্ষিগত করতে চায়। এমনকি মানুষের ন্যূনতম ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চায়। ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন(এসআইআর) প্রক্রিয়ায় আমরা দেখছি দক্ষিণপন্থীরা সমাজের সেই আর্থিক, সামাজিক, শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের শুধু ভোটাধিকার নয়, নাগরিকত্বই কেড়ে নিতে চাইছে। আমরা এর তীব্র বিরোধী। আমরা চাই প্রকৃত ভোটাররা ভোট দিক। ভোটার তালিকার সঙ্গে নাগরিকত্বর কোনও সম্পর্কই নেই, সে কথা আমরা জোরের সঙ্গে বলছি। আমাদের অবস্থান হলো এসআইআর’র বিরোধিতা করাই যথেষ্ট নয়, তার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার পাশাপাশি মানুষের পাশে আমাদের থাকতে হবে। কোনও সহানুভূতি থেকে নয়। যাঁরা নিজেদের হীনবল মনে করছেন, তাঁদের বলবান করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। তাঁদের সশক্ত করতে হবে। লড়াইয়ে শামিল করতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে তাঁদের সংগঠিত করতে হবে।
আমাদের দেশে আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে। বাড়ছে দারিদ্র, ক্ষুধা, বেকারি। দেশের সম্পদের সিংহভাগ কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থার মালিকের হাতে। দেশে নয়া আর্থিকনীতি প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই প্রবণতা বেড়েছে। তবু তারই মধ্যে দেশে বিকল্পের সন্ধান করেছে বামপন্থীরাই। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীনই অনেকগুলি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু হয়েছে। আবার স্বনির্ভরতা, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর কাজও বামফ্রন্ট সরকারই করেছে। দেশে একশো দিনের কাজ নিশ্চিত করতে আইন চালু হয়েছিল বামপন্থীদের নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগে। আজ সেই কাজের অধিকার কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কারণে রুদ্ধ। এই সময়েই আমরা দেখলাম কেরালায় দেশে প্রথম চরম দারিদ্র নির্মূল করার সাফল্য অর্জন করল। কেরালার বাস্তবতার নিরিখে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করছে সেখানকার বামপন্থী সরকার, তাই এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
এমন লক্ষ্যের ভিত্তিতেই বামপন্থীরা এগিয়ে চলে। চলার পথে নানা ঘটনা থেকে তাঁরা শিক্ষা নেন। সম্প্রতি নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ‘ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্টস অব আমেরিকা’র প্রার্থী জোরহান মামদানি। ট্রাম্পের প্রতিদিনকার হুমকির মুখে জোরহান মামদানির জয় একটি ইঙ্গিত, একটি আশার স্ফূরণ। সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষ, শ্রমজীবী, পরিযায়ী, মহিলাদের দাবিগুলির কথা তুলে ধরেছেন মামদানি। পাশাপাশি এই ভরসা জুগিয়েছেন যে, তাঁদের দাবিগুলির সমাধান সম্ভব, অর্থাৎ আদায়যোগ্য। মামদানিকে অভিবাসী বলে, মুসলমান বলে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে ঠেলে দিতে চেয়েছে দক্ষিণপন্থীরা। ট্রাম্প তাঁকে ‘ পাগল কমিউনিস্ট’ বলে অভিহিত করেছিলেন। মামদানি জিতলে প্রাপ্য থেকে নিউইয়র্ককে বঞ্চিত করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প, যা গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর এবং উগ্র দক্ষিণপন্থার মনোভাবকেই স্পষ্ট করেছে। তবু মামদানি জিতেছেন। উগ্র দক্ষিণপন্থা যেখানে প্রবলতম, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শহরে মেয়র নির্বাচনের শিক্ষা হলো, দক্ষিণপন্থীরা যেগুলিকে মামদানির দুর্বলতা বলে মনে করেছে, সেগুলিই তাঁর শক্তি হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ লক্ষ্যে স্থির থেকে ধাপে ধাপে, বাস্তবের সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করা যায়।
সময়ের দাবি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তা সাফল্য অর্জনে সহায়ক হবে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আরএসএস’র সংগঠনকে পরাজিত করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির জয় তার প্রমাণ। আমাদের রাজ্যেও আমাদের পরাজিত করতে হবে বিজেপি’কে। একইসঙ্গে পরাস্ত করতে হবে আরএসএস’র সাহায্যে তৈরি হওয়া তৃণমূলকে। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বদলাতে পারলে দেশের রাজনীতিতে তার বিপুল প্রভাব পড়বে। বিশেষত অনুপ্রাণিত হবে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত মানুষ। উজ্জীবিত হবে গণআন্দোলন। সেই ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নপূরণ, মহিলাদের স্বনির্ভরতা, সুরক্ষা, কৃষকের সঙ্কট দূর করা, ঋণের দায়ে জর্জরিতদের সমাধান, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং সুদৃঢ় করা, পরিবেশ রক্ষার মতো বিষয়ে আমরা আন্দোলন করছি। তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবো। সেই লক্ষ্যে নির্দিষ্ট বিকল্প হাজির করে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা আমাদের আজকের দায়িত্ব।
Comments :0