CRISIS IN EDUCATION

ধ্বংসের পথে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদকীয় বিভাগ

crisis in education bengali news

প্রভাত পট্টনায়েক
 

অশোকা ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক ঘটনাবলী থেকে যা প্রকাশিত হচ্ছে তা একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের উত্থানকেই  প্রতিফলিত করে। কোনও দেশই আত্মনির্ভর হতে পারে না যদি সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে  সেগুলিকে কেবলমাত্র কোচিং সেন্টারে পরিণত করে দেওয়া হয়। 
কোনো সন্দেহ নেই যখন এই দেশ থেকে কেন্দ্রের ভারতীয় জনতা পার্টির শাসনের অবসান হবে, তখনই এই অপশাসনে ভারতীয় সমাজ,  রাজনীতি এবং অর্থনীতির যে চূড়ান্ত ক্ষতি হয়েছে, তার বৃহদাংশে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। কিন্তু অন্তত দুটি এরকম ক্ষেত্র আছে যেখানে এই পুনরুদ্ধারের কাজ অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে; তার মধ্যে একটি হলো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ধ্বংস করার যে অপরাধ এই দল করেছে! এই ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছিল বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়ার  মধ্য দিয়ে, যেটি একাধারে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করা  ছাড়াও বর্বরতার একটি জাজ্জ্বল্যমান নিদর্শনও বটে। কোনও সভ্য সংবেদনশীল দলই একটি চারশো বছরের পুরানো স্থাপত্যকে এইরকম উচ্ছৃঙ্খলভাবে ধ্বংস করতে পারে না।
এই ধ্বংসলীলা আজও চলেছে কিছুদিন আগেই পুরানো সংসদ ভবনের পাশেই নতুন একটি কাঠামো খাড়া করার মধ্য দিয়ে। পুরানো স্থাপত্যটি ছিল একটি সুচিন্তিত নকশার ভিত্তিতে নির্মিত, যা কার্যত ধ্বংস হয়ে গেল। বস্তুত ঔপনিবেশিক শাসনের একটি নিদর্শন বলে এই স্থাপত্যকে ধ্বংস করতে হবে, এটি কোনও বৈধ কারণ হতে পারে না।
আর অন্য যে প্রশ্নে বিজেপি সরকারের আমলে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ  চলেছে, যার পুনর্নির্মাণ একান্তই দুঃসাধ্য, সেটি হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সর্বনাশ; এবং এটাই  এই পরিসরে আমাদের সমূহ উদ্বেগের বিষয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু কতগুলি  ইট-কাঠ-পাথরের সমন্বয় নয় যেখানে  শিক্ষা  প্রদান  করা হয়ে থাকে, যেকোনও কোচিং সেন্টারেরও সেসব থাকতে পারে। সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেই পরিসর যেখানে চিন্তাচেতনার মূল্যায়ন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করতে হয় চিন্তার মূল্যায়ন করার জন্যই, যে পরিবেশ সৃষ্টি করাটা অনেকটাই সময়সাপেক্ষ। এই ধরনের পরিসর বিশেষ করে একটি তৃতীয় বিশ্বের সমাজে গড়ে তোলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, এবং এটাই ভারতবর্ষের কৃতিত্ব যে এইরকম বেশ কয়েকটি পরিসর এদেশে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।


সন্দেহের অবকাশ নেই যে এর একটি উপাদান অবশ্যই আমাদের দেশের ভৌগোলিক  আয়তন। প্রতিবেশী দেশের শিক্ষায়তনগুলি প্রায়শই এই বলে খেদ প্রকাশ করে যে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য যে পরিকাঠামোর প্রয়োজন হয়,  তাদের দেশে তার অভাব আছে। বরং ভারতবর্ষে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উপাদান হচ্ছে এদেশের সমাজে গভীর চিন্তাচেতনার প্রতি সাধারণভাবে গড়ে ওঠা সম্ভ্রমবোধ; এমনকি মতপার্থক্য  থাকলেও তখনো একথা সত্য।
ফ্যাসিস্ত সংগঠনগুলি, যাদের নিজেদেরই কোনও সুগভীর চিন্তাচেতনার ভিত্তি থাকে না, তারা অর্থবহ চিন্তাভাবনার প্রতি কোনও শ্রদ্ধাও দেখাতে পারে না। সুতরাং এখানে বিস্ময়ের সামান্য অবকাশও নেই যে বিজেপি সরকার দেশের ভেতর সুগভীর চিন্তাচেতনার যে কয়েকটি পরিসর আছে, তাকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপরে এই সরকারের এই ধরনের আক্রমণ দেশের জন্য অপরিসীম ক্ষতি করে দেবে।
এই আক্রমণ যা শুরু হয়েছিল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপর আক্রমণের মাধ্যমে, সেটি এমনকি এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ওপরেও প্রসারিত হয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়,  যেটি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতে পারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্নাতকশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অন্যতম  হিসাবে গণ্য হয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি ভারতবর্ষে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন শিক্ষাগত চর্চার পথ খুলে দিয়েছে এবং প্রধাণ পাশ্চাত্য শিক্ষাকেন্দ্রগুলির সঙ্গে অনায়াসে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে ও বিশ্বভারতী, যেটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবাদর্শে সম্পৃক্ত ছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এখন তাদের অতীত সত্ত্বার কেবলমাত্র কঙ্কালে পর্যবসিত হয়েছে।


যাদের প্রাথমিক গুণগত মান হচ্ছে যে তারা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অনুগত, তাদের উপাচার্যের পদে নিযুক্ত করে, বশংবদ লোকে ভরিয়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করার প্রচেষ্টায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে, ছাত্রভর্তির ব্যাপারে একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন পরিষদ বা কমিটিগুলি যাতে অনুগত লোক দিয়ে ভরিয়ে  তোলা যায় তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন বা চেয়ারপার্সন পদে অনৈতিক পদ্ধতিতে নিয়োগ করে ও তাদের সেইসব পদে একাধিকবার রেখে দিয়ে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলি এদেশের  বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সজীব গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যা আগে প্রবলভাবে বিদ্যমান থাকতো, তাকেই ধ্বংস করছে; এরা এদের পছন্দের ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী দিয়ে অনায়াসে বিরোধীদের কেবল সন্ত্রস্তই করছেনা, একদা মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষায়তনগুলির শিক্ষার মানও নির্দ্বিধায় নামিয়ে দিচ্ছে।  আর সর্বোপরি, এইসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আজ অর্থের জোগানের  অভাবে ধুঁকছে।
পাবলিক  বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্রমাবনতির এই সময়ে দাঁড়িয়ে এখন অনুরূপ পরিস্থিতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও  ছড়িয়ে পড়ছে। যা অশোকা ইউনিভার্সিটিতে ঘটে গিয়েছে তেমন ঘটনা অন্যত্র যথেষ্ট বিরল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক একটি গবেষণানির্ভর প্রবন্ধ লেখেন যেখানে তিনি বিভিন্ন পরিসংখ্যানের যত্ন সহকারে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইঙ্গিত দেন যে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে কিছু কিছু লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপি হয়ে থাকতে পারে।
যথাযথভাবে বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ই হচ্ছে সেই পরিসর যেখানে এই ধরনের গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রবন্ধ লেখার কারণে বিজেপি’র আইটি সেলের পদাতিক বাহিনী শুধু যে ঐ শিক্ষকের চরম সমালোচনা করতে লাগলো তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়  কর্তৃপক্ষও  ঐ গবেষণানির্ভর  প্রবন্ধটির ব্যাপারে  নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করলেন এবং  একটি ন্যক্কারজনক বিবৃতি হাজির করলেন।
এরপরে আরও স্পষ্ট  হলো যে ইউনিভার্সিটির পরিচালন সমিতি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা  অনুদান বা অর্থের জোগান দিয়ে থাকেন তাঁরাও প্রতিনিধিত্ব করছেন, পুরোপুরি গবেষণালব্ধ এই প্রবন্ধটির ওপরে বিচারসভা বসালেন এবং এমনকি এই প্রবন্ধটিতে  কিছু  কিছু  কাটাছেঁড়া করার  পক্ষেও সওয়াল করলেন। এরপরে সেই অভিযুক্ত শিক্ষক পদত্যাগ  করলেন। কিন্ত তাঁর বিভাগীয় সহকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূমিকায় আপত্তি জানান এবং সতর্ক করেন  যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে যদি  পুনর্বহাল না করা হয়, তাহলে তাঁরা প্রতিবাদ করতে বাধ্য হবেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাধারণভাবে অর্থের  জোগান দেন সেইরকম একদল ব্যবসায়ী একটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের বিচার করতে বসে গেছেন, এটি  একেবারেই  অশ্রুতপূর্ব  একটি  ঘটনা।  এমনও নয় যে অশোকা ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ বা এমনকি ঐ অর্থের জোগানদাররা নিজেরাও এ বিষয়ে অবগত নন! তা সত্ত্বেও  সরকারের ভয়েই তাঁরা পঠনপাঠনের বিষয়ে মাথা গলানোটাই বেছে নিলেন।
এইটিই যেকোনও ধরনের সমালোচনার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অসহনীয়তার নিদর্শন, এমনকি যদি তা একটি গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধ প্রকাশনাও হয়; সহনশীলতার  এই  অভাবই বিশ্ববিদ্যালয়  পরিচালন সমিতি ও কর্তৃপক্ষের  ভূমিকার মধ্যে দিয়ে সেখানকার শিক্ষকদের প্রতি বর্ষিত হয়েছে। 
এটি পরিষ্কার যে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় যারা তাদের সুনামের প্রতি যত্নশীল, তারা কখনোই এই পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে পারে না।  এই একইভাবে, উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ এটি প্রতিপন্ন করে যে ভারতবর্ষে দারিদ্র হ্রাস পেয়েছে বলে যে দাবি করা হয়, আসলে সে কথা সঠিক নয়; কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আমলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে দারিদ্র বৃদ্ধি পেয়েছে, তাহলে সেই প্রবন্ধের রচয়িতাকে ভর্ৎসনা করা হবে এবং তাঁকে ঐ প্রবন্ধের সিদ্ধান্তগুলিকে সংশোধন করতে বলা হবে।
যদি কোনও গবেষণাধর্মী  প্রবন্ধ পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে প্রতিপন্ন করে যে মোটামুটিভাবে বিজেপি’র শাসনকালে কৃষির সঙ্কটের কারণে ভারতবর্ষের গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছে, তাহলে সেই প্রবন্ধটিকেও সরকারের ইচ্ছার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সংশোধন করতে হবে।


এই পরিবেশের মধ্যে গবেষণা করা বলতে গেলে বিজেপি সরকারের নিজের সাফল্যগুলিকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার নামান্তর হয়ে পড়বে। যেহেতু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান অতি আবশ্যিকভাবে সমৃদ্ধ হয় গবেষণার মাধ্যমে, সুতরাং গবেষণার সর্বনাশের অর্থ হলো পঠনপাঠনের অবক্ষয় এবং তার পরিণতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবধারিত মৃত্যু।
কেউ কেউ এটিকে একটি অতিকথন মনে করতে পারেন; কারণ সমস্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই অর্থের জোগানদাররা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ (সঠিক দায়িত্ব নির্ধারণ প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে) সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বিপুল প্রভাব খাটিয়ে থাকেন। তাঁরা নিঃসন্দেহেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করেন।
উত্তর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পুরানো দিনে ইহুদি বংশোদ্ভূত পড়ুয়ারা প্রায়ই বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতেন। আর এখন প্যালেস্তাইনের প্রতি সহানুভূতিশীল যে কোনও ছাত্রই অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন। অবশ্যই মার্কসবাদীরা সবসময় বৈষম্যের শিকার হন। এমনকি এতদূর যে পল সুইজি বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক হওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ তিনি শুনেছিলেন যে তাঁর এই অধ্যাপনা গ্রহণ করাকে দৃষ্টান্ত হিসাবে খাড়া করে মার্কসবাদী পড়ুয়াদের, যাঁদের ইতিপূর্বে পড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ীরূপে নিয়োগ করা হয়েছিল, তাঁদের বাতিল করার কারণ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থের জোগানদাররা কর্তৃক বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বৈষম্যের নজির অথবা বিদেশের বহু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে চলা নিপীড়নমূলক আচরণ এবং ভারতে আমরা আজকে যার সাক্ষী হলাম, এই দুইয়ের মধ্যে দুটি মৌলিক পার্থক্য আছে।
প্রথমত, এইরকম ধরনের বৈষম্যমূলক বা নিপীড়নমূলক ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজকর্মের পিছনে সরকারের হস্তক্ষেপ বা সরকারের দিক থেকে ভয়ভীতি থাকার প্রমাণ পাওয়ার নজির বিরল। এই ধরনের কাজকর্মে সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগানদারদের পক্ষপাতমূলক আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ হতে পারে, যার মধ্যে অবশ্যই শাসক শ্রেণির প্রতি পক্ষপাতিত্বও ধরা যেতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিশোধ স্পৃহা কখনোই এগুলির কারণ হয় না।
দ্বিতীয়ত, বিদেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যের বা নিপীড়নের উদাহরণগুলিতে এমনটা কদাচিৎ ঘটে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগানদাররা বা কর্তৃপক্ষ কোনও একটি গবেষণাপত্র নিয়ে তদন্ত করছেন এবং তার লেখককে সেটির মধ্যে রদবদল করত বলছেন।
গবেষণাপত্রগুলি সমকক্ষ  শিক্ষক/গবেষকরা মূল্যায়ন বা সমালোচনা করেন (পিয়ার-রিভিউ) এবং সেগুলি প্রকাশিত হওয়ার পথে, সে যেখানেই হোক না কেন, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এগিয়ে চলে; অবশ্যই বিষয়বস্তুতে কিছু রদবদলের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পরামর্শ থাকে, কিন্ত এটি কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ  বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগানদারদের চাপে হয় না।
এই কারণে বলা যায় অশোকা ইউনিভার্সিটির যে ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ পেল, তেমনটা সচরাচর একেবারেই ঘটে না। এই ঘটনার মধ্যে দিয়েই এটিই প্রতিভাত হয় যে একটি ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রের উত্থান হচ্ছে, যারা নাকি তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বা তারা কী পদ্ধতিতে ক্ষমতায় এসেছে এইসব নিয়ে বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করতে পারে না, সে পরোক্ষ সমালোচনাই হোক বা  গবেষণাপত্রই হোক, এবং সেই সমালোচনা প্রত্যাহার করতে চাপ দিয়ে থাকে।
আসলে এই ধরনের ঘটনা বাস্তবে সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সমস্তরকম গবেষণারই পথ অবরুদ্ধ করে দেবে। সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে সমাজব্যবস্থা নিয়ে মাথা ঘামানো হয় এবং আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় সরকার গঠনের রীতিনীতি বা প্রক্রিয়া ও সরকারের কাজকর্মের বা নীতিগুলির পরিণতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হয়। যদি পড়ুয়ারা তাঁদের সিদ্ধান্ততে, যে সিদ্ধান্তকে তাঁরা সত্য বলে মনে করেন, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য যথাযথ  পড়াশোনাই না করতে পারেন (যখন সিদ্ধান্তের সত্যতা যাচাই করার নিজস্ব বন্দোবস্ত শিক্ষাজগতের কাছে আছে), তাহলে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে গবেষণা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে!


এর পরিণামে একইরকম ঘটনা ঘটবে প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও। যখনই কোনো গবেষণার বিষয়বস্তু হিন্দুধর্মের কুসংস্কারগুলির ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করবে, দাবি উঠবে সেই গবেষণা প্রত্যাহার করবার। এইরকম ঘটনাগুলি ক্রমশ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অস্তিত্বের ভিত্তিটিকেই ধ্বংস করে দেবে এবং সেগুলিকে খুব বড় জোর, কোচিং সেন্টারে পরিণত করে ফেলবে।
নরেন্দ্র মোদী সরকার ভারতবর্ষকে ‘আত্মনির্ভর’ দেশ হিসাবে প্রতিপন্ন করার জন্য প্রবল ঢ্যাঁড়া পেটাচ্ছে; কিন্ত কোনও দেশই আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে পারে না যদি সেই  দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কার্যকরীভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়।


 

Comments :0

Login to leave a comment