বই — মুক্তধারা, বর্ষ ৩
রবীন্দ্রনাথ : অনুভূতিতে উপলব্ধিতে বিশ্লেষণে
পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথকে জানার চেষ্টা ফুরানোর নয়। তাঁকে ঘিরে অব্যাহত অন্বেষণ, নতুনতর তথ্য আবিষ্কার। প্রাজ্ঞজনের গবেষণার আলোকে দিনে দিনে আরও বেশি করে তিনি আলোকিত হচ্ছেন। আলো পড়ছে তাঁর সাহিত্য জীবনে, ব্যক্তিজীবনে। সমাজের কাছে, মানুষের কাছে, জীবনের কাছে কতখানি দায়বদ্ধ ছিলেন, তা পুনঃপাঠে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখনো দুর্দিনে, অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যায়। প্রয়াণের এত বছর পরেও তাঁর সৃষ্টির সম্ভার ঘিরে আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। মুগ্ধতায় চিড় ধরেনি। স্রষ্টা হিসাবে কত বড়, তাঁর চিন্তন-মননের প্রসারণ তাঁকে নিয়ে কেউ কেউ বানানো গল্প ফেঁদেছেন। পারলে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের জোব্বা ধরেও টানাটানি করেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির যে বিপুল সম্ভার, তা আমাদের আজও পথ দেখায়। আরও বেশি করে সেই বিস্ময়কর সম্ভার আলোকিত হোক। আলোকিত হোক মানুষ রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চাই আরও নিবিষ্ট চর্চা। এ রকম এক প্রেক্ষাপটে ‘ট্রান্সপারেন্সি ইনিসিয়েটিভ’ ও ‘জাতীয় গ্রন্থাগার কর্মী সমিতি’ সম্মিলিতভাবে ‘প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ’ নামে এক মহাগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। মূল্যবান এই বইটির সম্পাদনা কে বা কারা করেছেন তাঁদের নাম নেই। কাজটি যে অভিনন্দনযোগ্য, মুক্তকণ্ঠে তা স্বীকার করতে হয়। চার শতাধিক পৃষ্টার মহাগ্রন্থে অজস্র মূল্যবান প্রবন্ধ গ্রন্থিত হয়ছে। একালের প্রবন্ধ-সাহিত্যে খ্যাতিমান বহু বিশিষ্টজনের লেখা রয়েছে। জীবিত লেখকদের পাশাপাশি প্রয়াত লেখকদের ভালো লেখাটি খুঁজেপেতে উদ্ধার করে এ বইতে গ্রন্থিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা, নতুনতর ব্যাখ্যার পাশাপাশি এসেছে কবির মনন-দীপ্ত ভাবনার প্রসঙ্গ, তাঁর দূরদর্শিতা নিয়ে আলোকপাত। রয়েছে সমসাময়িক বিশিষ্টজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের খতিয়ান, রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের সাহচর্য-লাভের বিবরণ। রবীন্দ্র-সংস্পর্শের অভিজ্ঞতা মানুষ রবীন্দ্রনাথকে চিনতে সাহায্য করে। স্মৃতিমিশ্রিত এক মরমি রচনা দিয়ে এ গ্রন্থের সূচনা। লেখাটির শিরোনাম ‘কাছে দেখা রবীন্দ্রনাথ’। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় আছে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি কত গভীর ও সুদূরপ্রসারিত ছিল, সে পরিচয়। হিটলারের সোভিয়েট আক্রমণের পর কলকাতায় বিবেকানন্দ-ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে সভাপতি করে ‘সোভিয়েট সুহৃদ সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই সমিাতির পৃষ্টপোষক হবেন, পরামর্শ দেবেন, এমন প্রত্যাশা নিয়ে সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী কবির সঙ্গে দেখা করতে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেননি, সম্মতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো, ইংরেজকে বিশ্বাস কোরো না।’ এ লেখায় রয়েছে টুকরো টুকরো কতো মাহার্ঘ্য স্মৃতি। একবার হীরেন্দ্রনাথ জনা পাঁচছজন মিলে কবির কাছে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গান শুনিয়েছিলেন। পরপর বেশ ক’টি গান। সদ্য লেখা ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি’ গানটিও ছিল। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন অতুলনীয়। হীরেন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘পরে অনেকবার বহুজনের কণ্ঠে এই অপরূপ গানটি শুনেছি, কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের গলায় যা শুনেছিলাম, তা আজও ভুলতে পারিনি।’
স্মৃতিচারণমুলক লেখা আছে আরও কয়েকটি। লীলা মজুমদারের লেখাটির কথা বলতে হয়। সে লেখার নাম ‘গুরুদেব’ নয়, ‘গুরু’। উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব ছিল। লীলা মজুমদারের ‘বড়দা’ সুকুমার ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘যুবক বন্ধু’। সেই পরিবারের লীলা শন্তিনিকেতনে পড়াতে গিয়েছিলেন। পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য। সে এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথকে প্রথম তিনি অবশ্য দেখেছিলেন শৈশবে, ছ’সাত বছর বয়সে শিলং পাহাড়ে। তারপর অনেকবারই দেখা হয়েছে । সে সব স্মৃতির ঝলকের পাশাপাশি এসেছে সুকুমার রায়ের প্রসঙ্গ। লীলা মজুমদার শান্তিনিকেতনে পড়ানোর চাকরি একসময় ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ভালো পড়াতেন লীলা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, পড়ানোর দায়িত্বে থাকুন তিনি। বিদায়বেলায় লীলাকে কবি জানিয়েছিলেন, ইচ্ছে হলেই যেন আবার তিনি চলে আসেন, এলেই পড়ানোর কাজে যোগ দিতে পারবেন। মৈত্রেয়ী দেবীকেও অত্যন্ত স্নেহ করতেন কবি। মৈত্রেয়ীর পাহাড়-বাংলোয় বড় আনন্দে ছিলেন বেশ কিছুদিন। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে মৈত্রেয়ীর মনে অনেক স্মৃতি। সেসব নিয়ে তিনি বইও লিখেছিলেন। এই সংকলনভুক্ত তাঁর স্মৃতিকথাটি সুখপাঠ্য, পরম আন্তরিক। শুনিয়েছেন শান্তিনিকেতনের কথা। শান্তিনিকেতনের তিনি ছাত্রী ছিলেন না। সেই প্রকৃতিময় প্রাণোচ্ছল পরিবেশে প্রথম উপস্থিত হয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘আমি যদি শান্তিনিকেতনে থাকতে পারতাম।’
এই বইতে স্মৃতিমিশ্রিত লেখা আরও কয়েকটি আছে। কবিকে প্রথম দেখা, কবির সান্নিধ্যলাভ— সেইসব স্মৃতিকথা পড়তে পড়তে আমারাও পৌঁছে যাই সব পেয়েছির এক দেশে। এই বইতে প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের লেখা স্মতিকথাটিও ভারী সুন্দর, স্পর্শময়। তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন আট বছর বয়সে, তাঁরই এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
স্মৃতিকথা সংখ্যায় যৎসামান্য, এই বইতে রয়েছে বহু গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে চমৎকার সব প্রবন্ধ। বিদগ্ধজনের রবীন্দ্র-মূল্যায়ন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভালো প্রবন্ধ একত্রিত করার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যাঁরা লেখার অধিকারী, তাঁদের অনেককে দিয়েই নতুন প্রবন্ধ লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। নিশীথরঞ্জন রায়, হীরেন্দ্রনাথ দাস, হরপ্রসাদ মিত্র প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, দেবীপদ ভট্টাচার্য, অবন্তীকুমার সান্যাল, কুমার রায়, অমিতাভ চৌধুরী, রবীন্দ্র গুপ্ত, অসীম দাশগুপ্ত, শোভন সোম, পূর্ণেন্দু পত্রী, অরুণকুরমার বসু, হোসেনুর রহমান, চিত্তরঞ্জন ঘোষ, প্রণবরঞ্জন রায়, চিত্রা দেব—এমন সব খ্যাতনামাদের প্রবন্ধ রয়েছে এই সংকলনে। কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা, বিশ্লেষণের আলোকে আলোকিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির সম্ভার।
যে লেকা ভাবায়, চিন্তার রসদ জোগায়, তেমন লেখার অভাব নেই এই বইতে। রম্যাঁ রলাঁ ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে অবন্তীকুমার সান্যালের প্রবন্ধটি সহজেই আমাদের মুগ্ধ করে। গান্ধীজী ও প্রেমচন্দের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক, পরস্পরের চিন্তা-চেতনার সাদৃশ্য, নিয়েও দুটি পৃথক প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়েছে। পড়তে পড়তে মুগ্ধতা তৈরি হয়। প্রাপ্তির আনন্দে মন ভরে ওঠে। এমনই মুগ্ধ করে রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে কুমার রায়ের প্রবন্ধটি। রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের প্রবন্ধটিও মূল্যবান। আমরা কয়েকটি লেখার শুধুমাত্র উল্লেখ করলাম। এ বইতে অনেক ভালো প্রবন্ধ রয়েছে, যা নতুনতর ভাবনার আলোকে দীপ্ত, বিশ্লেষণমুখী, রবীন্দ্রনাথকে জানতে-বুঝতে সহায়তা করে। আমাদের ভাবায়, চেতনার দরজা খুলে দেয়, এমন প্রবন্ধের অভাব নেই এই সংকলনে। পার্থ রাহা, অনির্বান চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারকনাথ দাস, প্রফুল্লকুমার দাস—এঁদের প্রবন্ধগুলিও মুগ্ধ হয়ে পড়তে হয়। অনেক নতুন তথ্যে অনুসন্ধিৎসু-মন উজ্জীবিত হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তার সৃষ্টির সম্ভার নিয়ে আগ্রহ-কৌতুহল ফুরানোর নয়। তিনি চিরআধুনিক। দু-মলাটে বন্দি প্রবন্ধগুলি পড়তে পড়তে অনুভূতিতে, উপলব্ধিতে, বিশ্লেষণে আমরা নতুন করে পাই তাঁকে। তিনি আজও ভাবান, আলো দেখান। রবীন্দ্রনাথের দেখানো আলোতে সামনে প্রসারিত পথ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ (পরিবর্তিত সং) । পরিবেশক : র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা— ৭০০ ০০৯। ৬৫০ টাকা।
Comments :0