চন্দন দাস
‘চেনা ছেলেপিলে অচেনা হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত সব কথা বলছে। গ্রামের ছাওয়াল, ছোট থেকে চিনি। এখন মনে হচ্ছে চিনি না।’
যিনি বললেন, তাঁকে আমি বেশ কয়েক বছর চিনি। যে জেলার যুবক তিনি, সেই জেলার লড়াকু ঐতিহ্যই বহন করেন। অনেক ঘাত প্রতিঘাত, রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে সেই জেলার বামপন্থী আন্দোলনের নেতা, কর্মী, সংগঠকদের যেতে হয়েছে। যে এলাকার মানুষ মাত্র কয়েক মাস আগে ব্লক অফিস ঘিরে সারারাত অবস্থান করেছে তৃণমূলের চুরি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, এখন সেই এলাকারই কাউকে কাউকে অচেনা ঠেকছে আন্দোলনের সংগঠকের।
যাঁরা চেনার চেষ্টা করেন তাঁদেরই ছোট, মাঝারি পরিবর্তন চোখে পড়ে। যেমন নন্দীগ্রামের এক বামপন্থী কর্মী ২০০৬-এর ডিসেম্বর থেকে খেয়াল করছিলেন নন্দীগ্রামের বাজারে দ্রুত সুতলি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ‘সুতলি’ বোমা বানানোর কাজে লাগে। এখন চেনা মানুষের গলায় অচেনা স্বর বলে দিচ্ছে পাকিস্তান-বিরোধিতা দ্রুত মুসলমান-বিদ্বেষে পরিণত হচ্ছে। উগ্রজাতীয়তাবাদের বারুদে মিশে যাচ্ছে ধর্মের মশলা। আসলে জাতীয়তাবাদ আর হিন্দুত্বকে সমার্থক করার এই কৌশল সঙ্ঘের দীর্ঘদিনের। দ্বি-জাতি তত্বের এই ধারণায় জিন্নাহ্র নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ আর সাভারকার-গোলওয়ালকার-হিন্দু মহাসভা-আরএসএস খুবই কাছাকাছি ছিল এবং আছে থাকবেও। দেশভাগের ক্ষত পশ্চিমবঙ্গকে কখনই ভুলতে দেওয়া হয়নি। আমাদের রাজ্যে সুযোগ পেলেই সেই উগ্রজাতীয়তাবাদ-হিন্দুত্বর মিশ্রণের তীব্র বিষক্রিয়ায় উন্মত্ত করে তোলার চেষ্টা করেছে দেশের শাসক শ্রেণি। এখন বিগত ১৪ বছর ধরে রাজ্যে তৃণমূলের মদতে সঙ্ঘের পক্ষে গড়ে ওঠা অনুকূল পরিস্থিতিতে মারাত্মক এবং আত্মঘাতী ‘বোমা’ ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে নানা ধরনের মিডিয়ার প্রচারে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ঘটনা, বিশেষত সেখানে মৌলবাদীদের দাপাদাপি এই দেশ,এই রাজ্যে উগ্রজাতীয়তাবাদকে হিন্দুত্বের মতবাদ প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।
বামপন্থী আন্দোলনের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ফের পরীক্ষাগার হয়েছে। এবার লড়াই কঠিনতর।
আমাদের রাজ্য এর আগে কিছুটা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল ১৯৯৯-এ। কারগিলে সংঘর্ষের সময়।
সেই সময়েও কেন্দ্রে বিজেপি’র সরকার ছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জির বাড়িতে মালপোয়া খেয়ে যাওয়া অটলবিহারী বাজপেয়ী। সেই সময়েও শত্রু-হানার খবর পেতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের আশ্চর্যজনকভাবে দেরি হয়েছিল। সেবার পাকিস্তানের সেনা, ভাড়াটে হামলাবাজ, উগ্রপন্থীরা কাশ্মীরের একটি অংশে ঢুকে পড়েছিল মে মাসের গোড়ায়। প্রথমে সশস্ত্র উগ্রপন্থীরা ঢুকেছিল। পরে এসেছিল পাকিস্তানী সেনা। কেন্দ্রীয় সরকার সেই বিপদের কথা প্রকাশ্যে এনেছিল প্রায় কুড়ি দিন পর। ২৬ মে প্রথম সেই হামলাবাজ বাহিনীকে পিছু হটাতে ভারতীয় সামরিক বাহিনী কারগিল সেক্টরে বোমা বর্ষণ করে। পরের দিনই সিপিআই(এম)’র তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিৎ বলেছিলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার অনুপ্রবেশ রুখতে আরও আগে পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি এইদিকে মোড় নিত না। জাতীয় সংহতির স্বার্থে অনুপ্রবেশ রুখতে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সিপিআই(এম) সব সময়েই সরকারের পাশে থাকবে।’’ সেই সময় লন্ডনে ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। তিনি সেখানে বলেছিলেন, ‘‘কাশ্মীরে পাকিস্তানের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপের প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া ভারতের অন্য কোনও পথ ছিল না। পাকিস্তান কখনই কাশ্মীরে তাদের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করেনি। এটা সকলেরই জানা যে, অনেক বছর ধরে কাশ্মীরে পাকিস্তান আইএসআই’র মাধ্যমে তাদের সশস্ত্র কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।’’
১৯৯৯-এর ১২-১৩ জুলাই সেই সীমান্ত সংঘর্ষ কার্যত শেষ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী, উগ্রপন্থীদের বেঁচে থাকা অংশ পিছু হটে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরতে বাধ্য হয়। এই লড়াইয়ে ভারতের অনেক সেনানী বীরের মতো লড়াই করে প্রাণ দেন। তাঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাও ছিলেন। কিন্তু যখন হানাদাররা হেরে যাচ্ছে, ফেরত যেতে বাধ্য হচ্ছে, তখন একজনের বক্তব্যে দেশ আলোড়িত হয়। তিনি জর্জ ফার্নান্ডেজ। সেই সময়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। তিনি হঠাৎ বলে বসেন, হানাদারদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। তাঁর সেই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন বিরোধীরা। হাজরা মোড়ে ডিওয়াইএফআই’র জনসভায় রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘‘ফার্নান্ডেজ দেশদ্রোহী।’’ মমতা ব্যানার্জি অবশ্য ফার্নান্ডজের সেই রহস্যময় দাবির প্রশ্নে কোনও কথা বলেননি।
এই জর্জ ফার্নান্ডেজকে আমরা দেখেছিলাম কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরিতে বিশেষ উৎসাহদাতার ভূমিকায়। মমতা ব্যানার্জিও ১৯৯৭-৯৮-এ মার্কিন প্রশাসনের বিশেষ বন্ধু জর্জ ফার্নান্ডেজের তাঁকে সহায়তার কথা বারবার স্বীকার করেছেন। পরে আমরা মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টকে দেখেছি মহাকরণে, মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে বৈঠক করতে। সংসদীয় রাজনীতির কিছু ঘটনা রহস্যময়। বিশেষত ভারত সেই রহস্যের বারবার মুখোমুখি হয়েছে বিজেপি-শাসনে। আর এবারের মতো বারবার সেই রহস্যের একটি প্রান্ত থেকেছে ওয়াশিংটনে বাঁধা।
পহেলগামের ঘটনার পর সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময়ে সিপিআই(এম)’র যে অবস্থান দেখা গেছে, কারগিল-সংঘর্ষের সময়েও পার্টি সেই লাইনেই ছিল। কারগিল সংঘর্ষের সময়, ১৯৯৯-এর মে মাসে সিপিআই(এম) তার মুখপত্র পিপলস ডেমোক্রেসিতে জানায় তার অবস্থান, ‘‘৬ মে থেকে অনুপ্রবেশ শুরু হয়। অথচ পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে এবং ব্যবস্থা নিতে সরকারের একপক্ষকালের বেশি সময় লেগে গেল।...প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখা আজ জরুরি কর্তব্য এবং পরিস্থিতিকে এমনদিকে যেতে দেওয়া যায় না যাতে ভারত ও পাকিস্তান বৃহত্তর সংঘাতে জড়িত হয়ে পড়ে। বাইরের শক্তিগুলি ঠিক এটাই ঘটাতে চাইবে। আর এটাও সুবিদিত যে, পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফ সরকার যেমন নানা সমস্যায় ভুগছে, তেমনই ভারতেও বিজেপি উগ্র মনোভাব উসকে দিয়ে রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা করবে।’’ বিজেপি এবং তৃণমূলের মতো তাদের সহযোগীদের পরিস্থিতি থেকে ভোটের ধান্দাপূরণের চক্রান্তের বিষয়ে পার্টি তখনই সতর্ক করেছিল।
একইসঙ্গে সেদিন সিপিআই(এম) বলেছিল, ‘‘দেশের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার প্রশ্নটাই আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিকে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে দেওয়া আটকাতে হবে।’’ পাশাপাশি পার্টি প্রশ্ন তুলেছিল, ‘‘দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনরকম আপস সম্ভব নয়।...ব্যাপক পাকিস্তানী অনুপ্রবেশের এই গুরুতর ঘটনা কীভাবে হলো তার জবাব ভারত সরকারকে দিতে হবে। আর কেনই বা তাদের আগেভাগে আটকানোর চেষ্টা করা হলো না এবং আমাদের সেনাবাহিনীকে সেইভাবে প্রস্তুত রাখা হলো না তাও জানাতে হবে।’’
এবারও পার্টি প্রশ্ন রেখেছে, পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলার চক্রান্তের খবর কেন ভারতের গোয়েন্দারা পাননি? সন্ত্রাসবাদীরা হামলার আগে পাকিস্তান থেকে ভারতে ঢুকেছে, পহেলগামে রেইকি করেছে, পালানোর পথ বেছে রেখেছে। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আওতায় থাকা গোয়েন্দারা কী করছিলেন? কী করছিলেন প্রধানমন্ত্রী? সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক এমএ বেবি দাবি করেছেন, ‘‘পহেলগামের সন্ত্রাসবাদীদের ভারতের হাতে প্রত্যাপর্ণের জন্য পাকিস্তানকে চাপ দিতে হবে।’’ সিপিআই(এম) কাশ্মীর তথা দুই দেশের বিষয়ে মার্কিন প্রশাসনের নাক গলানোর বিরোধী। স্বাভাবিকভাবেই ফার্নান্ডজের থেকে সাহায্য পাওয়া, বাজপেয়ীকে মালপোয়া খাওয়ানো, সঙ্ঘের ভরসা তৃণমূল নেত্রী মার্কিন হস্তক্ষেপ, মধ্যস্থতার বিরুদ্ধে একটি কথা বলেননি। অথচ দীঘার মন্দিরের নিম ডাল নিয়ে ওডিশা সরকারের সঙ্গে মাত্র ক’দিন আগে কী ঝগড়াটাই না তিনি করলেন! আরও আশ্চর্যজনক হলো, মধ্য প্রদেশের বিজেপি’র মন্ত্রী কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের বোন’ বলার পর সারা দেশ প্রতিবাদে সোচ্চার হলো। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি চুপ!
কারগিলের ঘটনার প্রভাব পড়েছিল সেবারের লোকসভা নির্বাচনে। যখন কারগিল থেকে কার্যত পাকিস্তানের বাহিনী পিছু হটেছে, তখনই, ১১ জুলাই পাঁচ দফায় লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। কারণ বিজেপি, সঙ্ঘ তাই চেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশজুড়ে তখন প্রবল উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রচার। রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপি জোট বেঁধে লড়েছিল। বিজেপি ২টি আসনে জিতেছিল। বিজেপি’র শরিক হিসাবে তৃণমূল জিতেছিল ৮টি আসন। কংগ্রেস পেয়েছিল ৩টি আসন। বামফ্রন্ট জিতেছিল ২৯টি আসনে, তার মধ্যে সিপিআই(এম) পেয়েছিল ২১টি আসন।
তৃণমূল তৈরি হয়েছিল তার দেড় বছর আগে। বিজেপি’র তোলা দেশজোড়া উগ্রজাতীয়তাবাদের পালের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে না থাকলে তৃণমূল ৮টি আসন পেতো না। মমতা ব্যানার্জি এখন যাই দাবি করুন, বাস্তব এটিই। লক্ষ্যণীয় হলো কোন আসনগুলিতে তৃণমূল, বিজেপি জিতেছিল? তৃণমূল জিতেছিল নবদ্বীপ, বারাসত, যাদবপুর, কলকাতা উত্তর পশ্চিম, কলকাতা উত্তর পূর্ব, কলকাতা দক্ষিণ, শ্রীরামপুর, কাঁথি। বিজেপি জিতেছিল নবদ্বীপ লাগোয়া কৃষ্ণনগর এবং বারাসত লাগোয়া দমদম আসনে। দমদম লাগোয়া শ্রমিক প্রধান বারাকপুরে কিন্তু বিজেপি-তৃণমূলের জোট প্রার্থী জিততে পারেননি। উত্তরবঙ্গে ওই জোট দাঁত ফোটাতে পারেনি। তেমনই সংখ্যালঘু নিবিড় মুর্শিদাবাদ-মালদহের ৪টি আসনের একটিতেও জিততে পারেনি তৃণমূল-বিজেপি। আবার কলকাতা এবং তার লাগোয়া গঙ্গার পূর্ব পাড়ের মূলত মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, ছোট ব্যবসায়ী-প্রধান আসনগুলিতে তারা জিতেছিল। ভোটিং-প্যাটার্ন একটি ভৌগোলিক-সামাজিক মনস্তত্ত্বর হদিশ দেয়। সেবারের নির্বাচনেও তার প্রতিফলন ছিল।
দুটি বিষয় সেই সময়ের থেকে আজকের পরিস্থিতির থেকে আলাদা। প্রথমত, রাজ্যে তখন বামফ্রন্ট সরকার ছিল। এখন তৃণমূলের সরকার। এখন সরকারের মুখ্যমন্ত্রীই হিন্দুত্বের পালে হাওয়া দিচ্ছেন, সঙ্ঘের নির্ধারিত পথে এগচ্ছেন। সরকারের টাকায় মন্দির, পুজো, সন্ধ্যা আরতির মতো অনুষ্ঠান হচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকার রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখার পথ ধরে এগিয়েছে। বামফ্রন্ট লাগাতার ধর্মনিরপেক্ষতা, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে আন্দোলন, প্রচার চালাচ্ছে। যদিও সেই সময়ে কেশপুরে বামপন্থীদের নিকেশ করতে তৃণমূল-বিজেপি-জনযুদ্ধর সশস্ত্র হানাদারি বন্ধ হয়নি। সেই আক্রমণ প্রতিহত করেই উন্নয়নের লক্ষ্যে এগচ্ছেন বামপন্থীরা। কারগিল-সংঘর্ষ যখন শেষ, তখন বক্রেশ্বরে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। দিনটি ছিল ১৯৯৯-এর ১৭ জুলাই। রাজ্যে তার আগেই শিল্পনীতি গৃহীত হয়েছে। নতুন নতুন কারখানা তৈরি শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ভূমিসংস্কারের কাজও চলছে পুরোদমে। সচল পঞ্চায়েত। এই পরিস্থিতিতে উগ্রজাতীয়তার প্রচার, হিন্দুত্বের আস্ফালন, মুসলমান-বিদ্বেষ রাজ্যের বড় অংশের মানুষ প্রত্যাখান করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, আজ পরিস্থিতি আলাদা। তাই তা বামপন্থীদের কাছে আরও বেশি কঠিন। কেন্দ্র এবং রাজ্যের, দুই সরকারের শাসক দলই হিন্দুত্বের প্রচারক। তবে দু’জনের কৌশল আলাদা। দুই দলই হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মাধ্যমে ভোটে জিততে মরিয়া। রাজ্যের শাসক দল দুর্নীতিপরায়ণ, উচ্ছৃঙ্খল। কর্মসংস্থান, শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো, কৃষিজীবীদের জন্য রাজ্যের বর্তমান সরকারের কোনও কর্মসূচি নেই। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপন্ন। এই অবস্থায় সঙ্ঘের মতো বিপজ্জনক বিভিন্ন শক্তি রাজ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। খাগড়াগড়, ধুলাগড়, বসিরহাট, উলুবেড়িয়া, জঙ্গিপুরের মতো অনেকগুলি সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ঘটনা গত ১৪ বছরে ঘটেছে রাজ্যে, যা রাজ্যের দীর্ঘ ঐতিহ্য লালিত সম্প্রীতির পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছে। পাশাপাশি লাগোয়া বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থান পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুতর অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং সেই ঘটনার সূত্র ধরে ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘর্ষ হয়েছে। যাকে তৃণমূল এবং বিজেপি ধর্মীয় বিভাজনের অঙ্কে ব্যবহার করে ফয়দা তোলার চেষ্টা করছে।
সেদিক থেকে দেখলে ১৯৯৯ এবং এবারের পরিস্থিতির একটি মিল আছে। এবারও বিজেপি, তৃণমূল একই দিকে আছে। একই হাওয়ায় পাল তুলেছে। একইভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ, হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের অঙ্কে ফয়দা লুটতে নেমেছে। নিজেদের মুখোমুখি দেখালেও তারা আসলে একই সাপের দুটি মুখ। এর বিপরীতে সেই বামপন্থীরা এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।
বামপন্থীদের খুন করে, চিট ফান্ডের টাকা এবং সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির সহায়তায় বামফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করার চক্রান্ত বাস্তবায়িত করে, বামপন্থীদের ঘরছাড়া করে, মিথ্যা মামলায় জেলে পুরে আজকের পরিস্থিতির মুখোমুখি রাজ্যের মানুষকে উপস্থিত করেছে তৃণমূল, বিজেপি। বামপন্থীরা দুর্বল এখন। বামপন্থীরা দেশপ্রেমিক ছিল এবং আছে। কিন্তু দিশাহারা মানুষের কাছে পরিত্রাণের পথ সোচ্চারে কিন্তু যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরার এটাই সময়। যে মানুষ ‘অচেনা’ হয়ে যাচ্ছে ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের উৎকট মিশেলের প্রচারে, তাঁকে বলার এটিই সেরা সময়— বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান আমাদের মডেল নয়। আমাদের সম্প্রীতিই আমাদের অগ্রগতির ধারক।
এই ক্ষেত্রে উৎসাহজনক উপাদান আছে। ২০১৯-র ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামা এবং বালাকোটের ঘটনার পরও উগ্র জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলা হয়েছিল। সেই ক্ষেত্রেও সেই প্রচারে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল তীব্র মুসলিম-বিদ্বেষ। সেবার সঙ্ঘের সেই কৌশলের বিরুদ্ধে মানুষের স্বর যতটা শোনা গিয়েছিল, এবার সোচ্চার মানুষ তার চেয়ে বেশি। দেশের বেশিরভাগ মানুষ একদিকে পহেলগামের হামলার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, উগ্রপন্থীদের মদত দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ভূমিকার সমালোচনা করেছেন, ভারতের সামরিকবাহিনীর সাফল্য কামনা করেছেন, সামরিকবাহিনীর দুর্দান্ত ভূমিকায় তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। আবার সেই মানুষই কেন্দ্রীয় সরকার কেন আগে খবর সংগ্রহ করতে পারেনি সেই প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি মুসলিম-বিদ্বেষ যে মাত্রায় নিয়ে যেতে চেয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা, মানুষের সতর্কতায় সেই চক্রান্ত সফল হতে পারেনি। সোসাল মিডিয়ায় সঙ্ঘের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন দেশের অনেকে। দেশকে সাহস জুগিয়েছে কাশ্মীর, ‘কাশ্মীরিয়ৎ’। পাকিস্তানের ভূমিকার বিরুদ্ধে, উগ্রপন্থীদের হামলার নিন্দায় কাশ্মীরের মানুষ সোচ্চারে মুখ খুলেছেন।
সঙ্ঘের চক্রান্ত সফল হয়নি। যে মানুষ সঙ্ঘের প্রচারে বদলে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে, তাঁদের কাছে তুলে ধরতে হবে কাশ্মীরের সেই সুর, দেশের সেই স্বর। মনে করিয়ে দিতে হবে, উগ্রজাতীয়তাবাদ আর দ্বি-জাতি তত্বের সমার্থক করে তোলার মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক চক্রান্তের সময়ে এই দেশে, এই রাজ্যে বারবার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারতীয়রা— সেই বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে ছিলেন অনেক ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং মুসলমানরা, তাঁদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। এই ইতিহাস স্মরণে রেখেই সমবেত করতে হবে সব গণতান্ত্রিক ধর্মনরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশপ্রমিক মানুষকে মানুষকে।
Comments :0