রাষ্ট্রসঙ্ঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভারত সমর্থন না করায় মোদী সরকারকে বিঁধেছেন বিরোধীরা। যে প্রস্তাবে সমস্ত ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা হয়েছে, বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির কথা বলা হয়েছে সেখানে মানবিক কারণে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাতে ভারতের আপত্তি কোথায়, এই প্রশ্নের কোনও সঙ্গত উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। তবে, ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের মধ্যে গিয়ে হামাসের আক্রমণের পর থেকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশন পর্যন্ত ভারতের অবস্থান থেকে স্পষ্ট হয়েছে ইজরায়েল সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা থেকে ভারত বিরত থাকছে।
এই অবস্থানের একটি কারণ মার্কিন রণনীতির সঙ্গী হয়ে ভারত আমেরিকা-ইজরায়েল-ভারত অক্ষ তৈরির প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে। নয়াদিল্লির চিরাচরিত অবস্থান বদলে নিয়ে প্যালেস্তাইনের অধিকারের পাশ থেকে ভারত কার্যত সরেই এসেছে। কিন্তু আরেকটি বড় কারণ কি আদানি গোষ্ঠীর স্বার্থ? একটি কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থ দেখেই কি ভারতের বিদেশনীতি নির্ধারিত হচ্ছে? উঠেছে এই প্রশ্নও।
ইজরায়েলে আদানি গোষ্ঠীর বিনিয়োগ ক্রমশ বেড়েছে গত কয়েক বছরে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ হয়েছে ইজরায়েলের অন্যতম বড় বন্দর হাইফা পোর্ট আদানি গোষ্ঠী কিনে নেওয়ায়। এ বছরের জানুয়ারিতেই আদানি পোর্ট অ্যান্ড স্পেশাল ইকনমিক জোন লিমিটেড ১২০ কোটি ডলারে হাইফা বন্দর কিনে নিয়েছে। স্থানীয় একটি লজিস্টিক সংস্থা গ্যাডটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই বন্দর কিনেছে তারা। আদানিদের অংশীদারি ৭০ শতাংশ। ভূমধ্যসাগরে এই বন্দর আদানিদের হাতে হস্তান্তরের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন স্বয়ং ইজরায়েলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তিনি এই হস্তান্তরকে ‘স্ট্র্যাটেজিক’ এবং ‘বিরাট মাইলফলক’ বলেও চিহ্নিত করেন। অনুষ্ঠানে গৌতম আদানিও বলেন, হাইফাকে ঘিরে রিয়েলটি গড়ে তোলা হবে। হাইফার ‘আকাশরেখা’ বদলে দেওয়া হবে। এমন সময়ে এই অনুষ্ঠান হয় যখন আদানিদের শেয়ার লেনদেনে বিপুল কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
আদানিরা হাইফা বন্দর কেনার পরেই ভারত থেকে সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, সৌদি আরব, ইজরায়েল হয়ে ইউরোপের প্রান্তে পৌঁছানোর একটি পণ্য করিডর নিয়ে পরিকল্পনা হতে থাকে। জি-২০’র সাম্প্রতিক শীর্ষ বৈঠকে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ঘোষণাও করা হয়েছে। ভারত থেকে মধ্য প্রাচ্য হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর এই করিডরকে বিরাট অগ্রগতি হিসাবে দেখিয়েছে ভারত, ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সম্ভাব্য এই করিডরের এক প্রান্তে থাকছে মুম্বাই ও মুন্দ্রা বন্দর—যা এখন আদানিদের হাতে। সমুদ্রপথে তা সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতে পৌঁছানোর পরে ওই দেশ, জর্ডান ও সৌদি আরবে রেলপথে পণ্য যাবে ইজরায়েলের হাইফা বন্দরে। সংযুক্ত আরব আমীরশাহী থেকে হাইফার দূরত্ব ২৯১৫ কিলোমিটার। তার মধ্যে ৮২৫ কিলোমিটার রেলপথ হয় আংশিক ভাবে তৈরি হয়ে গেছে অথবা নির্মাণকাজ চলছে। হাইফা থেকে ফের এই পণ্য সমুদ্রপথে যাবে গ্রিসের বন্দরে। গ্রিসের পিয়েরেস বন্দর সহ তিনটি বন্দরই আদানিরা কেনার চেষ্টায় রয়েছেন। পিয়েরেসের বিষয়ে কথা চূড়ান্তও হয়ে গেছে। উত্তর গ্রিসের কাভালা এবং এথেন্স থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দূরের ভোলোস বন্দরও কিনতে আলোচনা চালাচ্ছে আদানি গোষ্ঠী। এই কথাবার্তা চূড়ান্ত করতে ব্রিকস সফর সেরে হঠাৎই একদিনের জন্য গ্রিসে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর সঙ্গে গ্রিসের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে বন্দর কেনার কথাই জোর পায়।
সাম্প্রতিক সংঘাত শুরুর আগে রাষ্ট্রসঙ্ঘের অধিবেশনে নেতানিয়াহু হাতে একটি মানচিত্র নিয়ে ইজরায়েলের মধ্যে দিয়ে করিডরের কথা বলেন। পেন্সিল দিয়ে নেতানিয়াহু করিডরের যে পথ দেখান এবং যাকে তিনি ইজরায়েল বলে চিহ্নিত করেন তার বিরাট অংশই আসলে প্যালেস্তাইনের অধিকৃত অঞ্চল। প্যালেস্তাইনের নাম স্বভাবতই তিনি উচ্চারণ করেননি, ভারত সরকারও এই করিডরের কথা বলতে গিয়ে কখনও প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ডের কথা বলেনি।
শুধু হাইফা বন্দরই না, ইজরায়েলে আদানির বিনিয়োগ দ্রুতগতিতে বেড়েছে। এর মধ্যে ইজরায়েল থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি ও যৌথ ভাবে প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের ব্যবসাও রয়েছে। ইজরায়েলী সংস্থা এলবিট সিস্টেমস, ইজরায়েল উইপনস সিস্টেম, ইজরায়েল ইনোভেশন অথরিটির মতো সংস্থার সঙ্গে যৌথ অংশীদারিও রয়েছে আদানিদের। তেল আভিভে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ল্যাবরেটরি তৈরির কথাও জানিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারত-ইজরায়েল সম্পর্কের তিরিশ বছরের অনুষ্ঠানে ভারতে ইজরায়েলের দূত নায়োর গিলন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আদানিরা ইজরায়েলে আরও প্রকল্পের বরাত পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমি আশা করব, তারা সেই বরাত পাবে। অন্যদিকে, ইজরায়েলের সঙ্গে আদানিদের প্রতিরক্ষা ব্যবসা সম্পর্কে সংসদেই প্রশ্ন তুলেছিলেন রাহুল গান্ধী। আদানিরা ইজরায়েলের প্রযুক্তিতে ড্রোন তৈরির বরাত পাওয়ায় রাহুল প্রশ্ন করেছিলেন, আদানিরা কোনোদিনই ড্রোন তৈরি করেনি, হ্যাল এবং অন্য সংস্থা তা করে থাকে। অথচ প্রধানমন্ত্রী ইজরায়েলে যাবার পরেই আদানিরা ড্রোন তৈরির বরাত পেল কীভাবে?
এই অবস্থায় আদানিদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নও ভারতের বিদেশনীতির অন্যতম উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের অনুমান। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ১২০ দেশ সমর্থন জানালেও ভারত বিরত থেকেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই একমাত্র দেশ যারা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি।
Adani Group Israel
ভারতের অবস্থানের পিছনে আদানিদের স্বার্থও, উঠছে প্রশ্ন

×
Comments :0