সেখ সাইদুল হক
সারা দেশে এবং সেই সাথে আমাদের রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগণ, বিশেষ করে মুসলিম জনগণের, মধ্যে আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা, পরিচিতি সঙ্কট এবং নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি বড় আকারে উপস্থিত হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘটনা এবং সরকারের পদক্ষেপ যেমন নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, দিল্লি ও হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশে পরিকল্পিত দাঙ্গা, বুলডোজার রাজনীতি, উত্তর প্রদেশের সংখ্যালঘুদের ধর্মান্তরকরণ আইনের মাধ্যমে নিশানা বানানো, আসামে হুমকি প্রদান,সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দানবীয় কালাকানুন ইউএপিএ, এনএসএ প্রয়োগ করে বিনা বিচারে জেলবন্দি করে রাখি,ওয়াকফ আইনের সংশোধন, ভোটার লিস্টে নিবিড় সংশোধনের নামে সংখ্যালঘু মুসলিম জনগণের উপর আক্রমণ নামিয়ে আনা ইত্যাদি । সেই সাথে ভিন রাজ্যে কাজ করা বাংলা ভাষী সংখ্যালঘু পরিযায়ী শ্রমিকদের পুশ ব্যাক করা ইত্যাদি বিষয়গুলি সংখ্যালঘু মননে ভীতি, আতঙ্ক এবং ক্ষোভের উদ্রেক ঘটিয়েছে। আর একে ব্যবহার করে সংখ্যালঘু মৌলবাদীরা যেমন সক্রিয় হয়ে উঠেছে, মেকি সংখ্যালঘু দরদি সাজা কিছু দল সংখ্যালঘুদের মসিহা সাজতে চাইছে।
রাজ্যের অবস্থা
বর্তমানে আমাদের রাজ্যে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত তৃণমূল দল ও তার সরকার বিভেদ বিভাজনের রাজনীতিতে ফুঁ দিয়ে চলেছে। এই দলের সরকার একদিকে সংখ্যালঘু উন্নয়নে বাম সরকারের সাফল্যগুলিকে অস্বীকার করে চলেছে, অপরদিকে সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে এমন সব কথা বলছে, ভাঁওতা দিচ্ছে যা সুপ্ত সম্প্রদায়িকতাকে জাগিয়ে তুলে, ধর্মীয় বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতিকে বাড়াতে সাহায্য করছে। প্রতিযোগিতা মূলক সম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরির ফলে বিপজ্জনক শক্তি, ফ্যাসিবাদী সংগঠন আরএসএস আমাদের রাজ্যে তাদের কার্যকলাপের পরিধিকে বাড়িয়ে বিভিন্ন জেলাতে অসংখ্য শাখা খুলেছে, ট্রেনিং দিচ্ছে, বিদ্যালয় খুলছে। সেই লক্ষ্যেই গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে দুই দল সাম্প্রদায়িক তাস খেলছে। আমাদের রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম জমানার দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রাজ্যে পরপর কয়েকটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে এবং বেশ কিছু জায়গায় দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকদের ঐক্য গড়ে তাদের পথে নামানো এবং ঘৃণ্য সম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলার পরিবর্তে রাজ্যের শাসক দল নিজেরাই রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে শামিল হয়েছে। বিজেপি এবং তৃণমূল দল এইসব করছে ভোট রাজনীতিকে মাথায় রেখে। তাই সংখ্যালঘু উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আওয়াজ তুলতে হবে। এইসব নিয়ে বহু প্রবন্ধাবলী প্রকাশিত হয়েছে, তাই এখানে ইসুগুলি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোকপাত করতে চাইছি।
ওবিসি ইস্যু
২০২৪ সালের ২২ মে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ ২০১০ সালের পরে দেওয়া এই রাজ্যের প্রায় ১০ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল করেছে। মোট ১৮০ টি ওবিসি গোষ্ঠীর মধ্যে ১১৪ টি বাতিল করে। ওই ১১৪ টির মধ্যে ১১০টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভুক্ত। পুরাতন ৬৬ টি গোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র বারোটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভুক্ত। পশ্চাৎপদতার নিরিখে বাম সরকার ২০১০ সালে সংখ্যালঘু ওবিসিদের জন্য এ ক্যাটাগরিতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ ঘোষণা করে। বি ক্যাটাগরি সব অংশের ওবিসি মিলিয়ে ৭ শতাংশ। মোট সংরক্ষণ হয় ১৭ শতাংশ। হাইকোর্টের রায়ে তা বাতিল করা হয়েছে। তারপর মামলা সুপ্রিম কোর্টে গড়ায়। রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টকে জানাই তারা নতুন করে সমীক্ষা করে তালিকা তৈরি করবে। সেই মতো ১৪০টি গোষ্ঠীকে ওবিসি বলে ঘোষণা করেছে। এই প্রশ্নে বর্তমান রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কে আওয়াজ তুলতে হবে। উচ্চ আদালতে রায় নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে এবং থাকবে। বাম সরকার সাচার ও রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশের উপর ভিত্তি করে, পশ্চাৎপদতার নিরিখে সংখ্যালঘুদের জন্য ওবিসি সংরক্ষণ ১০% করেছিল। তৃণমূল সরকার যেটা করল তা হলো ওবিসি কমিশনের ভূমিকাকে বাদ রেখে নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে ২০১২ সালে ত্রুটি পূর্ণ আইন প্রণয়ন করল। বর্তমানে যে ১৪০টি গোষ্ঠীকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করল তাতে বহু সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে বাদ দেওয়া হলো। তৃণমূল সরকার এ এবং বি-কে মিশিয়ে দিয়ে এ ক্যাটাগরি হতে কিছু গোষ্ঠীকে বি ক্যাটাগরিতে নিয়ে গেল এবং বি ক্যাটাগরি হতে কিছু গোষ্ঠীকে এ ক্যাটাগরিতে আনল। উদাহরণ স্বরূপ বাম জমানায় পুরাতন ওবিসি লিস্টের এ ক্যাটাগরিতে ৫৬ টি সংখ্যুলঘুগোষ্ঠী ছিল, বর্তমান তালিকায় এ ক্যাটাগরিতে মাত্র ৩৫ টি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আছে। এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বঞ্চনার শিকার হয়েছে। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে সারা দেশে জাতি গণনা এবং আর্থ-সামাজিক সমীক্ষার জন্য।
ওয়াকফ ইস্যু –
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের উপর বেশ কিছু সংশোধনী এনে তাকে আইনে রূপান্তরিত করেছে। এই সংশোধনীগুলি শুধু সংখ্যালঘুদের অধিকারের উপর আক্রমণ শুধু তাই নয়, তা দেশের সংবিধানের মর্মবস্তুকে এবং ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে আঘাত করেছে। নতুন সংশোধিত আইনে ওয়াকফ বোর্ডের হাত হতে ক্ষমতা কেড়ে জেলাশাসককে দিতে চাওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ৫ বছরের বেশি ইসলাম ধর্ম পালন করছেন এমন ব্যক্তিই ওয়াকফ সম্পত্তি দান করতে পারবেন, ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারের অধীনে থাকলে তা আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না, ওয়াকফ বোর্ডে এবং ওয়াকফ কাউন্সিলে কমপক্ষে দু’জন অমুসলিম সদস্য থাকবেন ইত্যাদি। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে দু’-তিনটি বিষয় আপাতত স্থগিত আছে। কিন্ত আমাদের আওয়াজ তুলতে হবে সমস্ত সংশোধনীগুলি বাতিল করানোর জন্য। কেননা এই সংশোধিত আইন সংবিধানের ১৪ এবং ১৫ নং ধারা এবং ২৫ ও ২৬ নং ধারাকে লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে যাতে এই আন্দোলন কোনও হঠকারী পথে, হিংসাত্মক পদ্ধতিতে পরিচালিত না হয়। আমাদের রাজ্যে ১ লক্ষের বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। যার মধ্যে বাম সরকারকে আমলে রেকর্ড ভুক্ত হয় ৮০৪৮১টি। গত ১৪ বছরে তৃণমূল জমানায় রেকর্ডভুক্ত হয়েছে মাত্র ৩০৯টি। এর মধ্যে ৩৭৬টি ঘিরে মামলা আছে এবং বেদখল হয়ে আছে ৩৩৬৫টি যার বেশির ভাগই আছে শাসক দলের নেতা ও কর্মীদের কবজায় রাজ্যে গত ১৪ বছরে বহু ওয়াকফ সম্পত্তির বেআইনি হস্তান্তর হয়েছে। এসবের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ওয়াকফ নিয়ে রাজ্যে কোনও আন্দোলন করা যাবে না। আন্দোলন করতে গেলে দিল্লিতে গিয়ে করতে হবে। কিন্তু রাজ্যটা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়। তাই ওয়াকফের মতে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
এসআইআর ইস্যু
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গে ৪ নভেম্বর হতে ভোটার লিস্টের বিশেষ নিবিড় সংশোধন হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিহারে হয়ে গেছে। আরও ১২টি রাজ্যে হবে। এর আগে ২০০২ সালে হয়েছিল। কিন্তু এত হই চই হয়নি। এখন হচ্ছে। কেননা নির্বাচন কমিশন বিষয়টিকে জটিল করেছে। ২০০২ সালে কোনও ব্যক্তিকে প্রমাণপত্রের জন্য দৌড় ঝাঁপ করতে হয়নি। কোনও আতঙ্ক ছিল না। এখন মেরুকরণে লক্ষ্যে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। যে ১১টি নথির কথা বলা হয়েছিল তার সাথে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ১২ নং নথি হিসাবে পরিচয়পত্র হিসাবে আধার কার্ড যুক্ত হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের কাজ নির্ভুল, ত্রুটিমুক্ত ভোটার লিস্ট বানানো– নাগরিকত্ব নির্ধারণ নয়। তাছাড়া ২০০২ সালকে এখন ভিত্তি করা হচ্ছে কেন? ঐ সালের পর বহু ভোট হয়েছে। আর সেই ভোটেই সরকার তৈরি হয়েছে। তাহলে তো সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। আসলে সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের, দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিশানা বানিয়ে তাদেরকে বাদ দিতে চাইছে। প্রাথমিক পর্বে বিহারে যে ৬৯ লক্ষ বাদ পড়েছিল, তার মধ্যে সংখ্যালঘু প্রধান পাঁচটি জেলায় বাদ গেছে ১০ লক্ষ ভোটারের নাম। বিহারে যে সাড়ে ৩৬ লক্ষকে মিসিং বলে বাদ দেওয়া হয়েছে এরা বেশির ভাগই হয় পরিযায়ী শ্রমিক, না হয় তারা যে নথি দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন তা গ্রহণ করেনি। আমাদের রাজ্যে ২০০২ সালে ভোটার ছিল ৪ কোটি ৯৬ লক্ষ, ২০১১ সালে ছিল ৫ কোটি ৬২ লক্ষ, ২০২৫ সালে হয়েছে ৭ কোটি ৬৩ লক্ষ, ১৪ বছরে অনেকটাই বেড়েছে। রাশি বিজ্ঞান এবং পরিসংখ্যানের মাপকাঠিতে হওয়া উচিত ছিল ৬ কোটি ৮২ লক্ষ। অর্থাৎ ৮১ লক্ষ বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে অনেকেই মৃত থাকতে পারেন। দু’-জায়গায় নাম আছে এমন থাকতে পারেন। তৃণমূল সরকার এদের নিয়েই ভোট করাতে চায়। বিজেপি বলছে এরা সবাই অনুপ্রবেশকারী। হয় বাংলাদেশী মুসলমান না হয় রোহিঙ্গা। তা আদৌ ঠিক নয়। বিহারের অভিজ্ঞতা বলছে সেখানকার ৭ কোটি ৪২ লক্ষ ভোটারের মধ্যে মাত্র সাড়ে ন’ হাজার বিদেশি নাগরিক বলে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ ১ শতাংশেরও নিচে। বাস্তবে আরও কম হতে পারে। যেমন আসামে এনআরসি-তে হয়েছিল। তাছাড়া ২০০১ থেকে ২০১১ জনগণনায় সারা দেশে মুসলিম বেড়েছে ২৪.৬ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে ২১.৮শতাংশ। যদি মুসলিম অনুপ্রবেশ হতো তাহলে এটা বাড়ার কথা। অমিত শাহ বলছেন, সীমান্তে ৯টি জেলায় মুসলিম ভোটার ৭০ শতাংশ হয়ে গেছে। সর্বৈব মিথ্যা। ২০১১ জনগণনা অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে ৬৭ শতাংশ, মালদায় ৫১ শতাংশ, উত্তর দিনাজপুরে ৫০ শতাংশ মুসলিম। বাকি ৬টি সীমান্ত জেলায় ৩০ শতাংশের কম। তাছাড়া বাস্তব ঘটনা হলো আতঙ্কিত হয়ে বাংলাদেশ হতে কিছু হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষ আসতে পারেন, কিন্তু মুসলিমরা আসতে যাবেন কেন, যেখানে ভারতের অর্থনীতি দারুণ উজ্জ্বল এমন নয়।
আমাদের যে আওয়াজ তুলতে হবে তা হলো, মৃতদের, দ্বৈত বা স্থানান্তরিত ভোটারদের, ভূতুড়ে ভোটারদের নাম বাদ দিয়ে ত্রুটি মুক্ত ভোটার লিস্ট নির্বাচন কমিশন বানাক। আওয়াজ তুলতে হবে বিএলও-রা যেন শাসক দলের ক্যাডারদের পরামর্শ বা নির্দেশ মতো কাজ না করে।
মাদ্রাসা শিক্ষা ও আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
রাজ্যের মাদ্রাসা শিক্ষা এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে। বাম জমানায় মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তার এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল রাজ্যের গর্বের তালিকায়। এরা এখন অবজ্ঞা ও বঞ্চনার শিকার। আলিয়ার জমি নিয়ে নেবার ছক কষেছিল এই সরকার। আলিয়াকে রক্ষা করার আন্দোলনে শহীদ হয়েছে আনিস খান। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ১০ হাজার আন রেজিস্ট্রার্ড মাদ্রাসাকে অনুমোদন দেওয়া হবে। ১৪ বছরে দেওয়া হয়েছে মাত্র ২৩৫টিকে। তাও আর্থিক অনুদান ছাড়া। এইসব প্রশ্নে আওয়াজ তুলতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে বাম জামানায় সংখ্যালঘু উন্নয়নের সাফল্যগুলি সম্পর্কে, ভূমি আন্দোলনে এবং পঞ্চায়েত ক্ষমতায়নে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণের বিষয়টিকেও।
নিরাপত্তা ইস্যু
সংখ্যালঘু জনগণের নিরাপত্তার ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর হতেই সারা দেশে পরিকল্পিতভাবে হিন্দুত্ববাদী শক্তি সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। আমাদের রাজ্যেও সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নন। তৃণমূল সরকারের সুপ্রিমো নিজেকে সংখ্যালঘু মসিহা বলে প্রচার করেন। অথচ আমাদের রাজ্যেই গত দশ বছর সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। বছর কয়েক আগে রামনবমীকে কেন্দ্র করে দাঙ্গায় আসানসোলের ইমামের ছেলে খুন হয়েছে। উত্তর প্রদেশে ২২ বছরের যুবক জুনেইদ জয়শ্রীরাম না বলায় তাকে চলন্ত ট্রেন হতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। একইভাবে এই রাজ্যে কয়েকবছর আগে হুগলীর মাদ্রাসার শিক্ষক ক্যানিং লোকাল ট্রেনে যখন ফিরছিলেন পার্ক সার্কাস স্টেশনে জয় শ্রীরাম না বলায় হিন্দুত্ব সংগঠনের সদস্যরা তাকে ট্রেন হতে ঠেলে ফেলে দেয়। হরিয়ানায় দুধের ব্যবসায়ী পেহেলুখাঁকে গোরক্ষক বাহিনী পিটিয়ে মারে। আমাদের রাজ্যে এই বছর দুর্গাপুরে গ্যামন ব্রিজের কাছে গোরু ব্যবসায়ীদের আটকে কোমরে দড়ি বেঁধে গোরক্ষক বাহিনী মারধর করে। মালদহের কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষক সরকারি কাজে বিকাশ ভবনে এলে দাড়ি, টুপি থাকার কারণে তাদেরকে গেস্ট হাউস হতে বের করে দেওয়া হয়। বাম জমানায় এসব ভাবাই যেত না। আসলে এসব ঘটছে কেন? কারণ একদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রামনবমী, হনুমানজয়ন্তী, দুর্গাকার্নিভাল, পুজো কমিটিকে অর্থ প্রদান, দীঘায় জগন্নাথ মন্দির, শিলিগুড়িতে মহাকাল মন্দির বানানোর কাজ চলছে। অপরদিকে ঈদের দিনের রেড রোডে হাজি বিবি বেশে খোদা হাফেজ বলা হচ্ছে। এটা মেরুকরণের মাত্রা বাড়াচ্ছে এবং রাজ্যে সংখ্যালঘু নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা হচ্ছে। রাজ্যে সংখ্যালঘু যুবকদের একটা অংশকে লুম্পেন বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। লুটের ভাগ নিয়ে এদের মধ্যে খুনোখুনি হচ্ছে। বগটুই, ক্যানিং,ভাঙড় সহ বহু জায়গায়। এইসব বিষয়ে সোচ্চারে আওয়াজ তুলতে হবে।
ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ঐক্য
ধর্মীয় ঐক্য নয়– ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষের ঐক্য গঠনের মাধ্যমেই সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হবে। বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি আমাদের রাজ্যকে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। রাজ্যে ধর্ম নিরপেক্ষতা যে সুমহান ঐতিহ্য আছে তা রাজ্যের শাসক দল এবং প্রধান বিরোধী দল ভেঙে ফেলতে চাইছে। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু জনগণকে এটা বোঝাতে হবে যে সংখ্যালঘু জনগণ ভিক্ষুক নন, তাঁরা অনুকম্পা চান না। তাঁরা দাবার বোড়ে নন। তাঁরা চান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাক্ষরতা, কর্মসংস্থান ও পরিকাঠামো গঠনে আরও উন্নয়ন। সেটা পেতে হবে সংঙ্কীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ হতে নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টিকোণ হতে।
Comments :0