ভাস্করানন্দ রায়
আদালতের নির্দেশে রেল ও রাজ্য প্রশাসন ১২ বছর শীতঘুম কাটিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে ভাবাদিঘিতে থমকে থাকা রেল লাইন করার জন্য। ঘনঘন প্রশাসনের সভাও হচ্ছে। গত কয়েকদিন আগে ‘ভাবাদিঘি বাঁচাও কমিটির’ প্রতিনিধিদের নিয়ে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে ভাবাদিঘি বাঁচাও কমিটির প্রতিনিধিদের সম্মতিক্রমে ভাবাদিঘি জরিপের সিদ্ধান্ত হয়। গত ২৩ ও ২৪ মে ২০২৫ তারিখে ভাবাদিঘি জরিপ হয়। জরিপের বিষয়ে ভাবাদিঘি বাঁচাও কমিটির সম্পাদক সুকুমার রায় বলেন,‘‘এতদিন প্রশাসন তাদের বৈঠকগুলিতে বারবার দাবি করছিল, রেলপথ অধিকাংশটাই দিঘির উত্তরপাড় দিয়ে যাচ্ছে। আমরা নাকি অন্যায়ভাবে বাধা দিচ্ছি। সরকারি মাপজোকের পর দেখা যাচ্ছে প্রকৃত দিঘির প্রায় মাঝখান দিয়ে রেল পথ নিয়ে যেতে চাইছে রেল। আমরা আইনি পরামর্শ নিচ্ছি।’’
এলাকার মানুষের প্রশ্ন, তাহলে কি বিনা জরিপেই রেলদপ্তর লাইনের নকশা বানিয়েছিল? সেই জন্য ভাবাদিঘির মানুষ জলাশয়কে রক্ষা করে উত্তর দিক দিয়ে রেললাইন করার জন্য এখনো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্য প্রশাসন ও রেল দপ্তরের সদিচ্ছার অভাবেই রেল লাইনের কাজ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। অযথা ভাবাদিঘির মানুষদের আসামির কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। আদালত মীমাংসার সূত্র দিয়েছেন। সেই সূত্র নিয়ে প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে।
হুগলীর গোঘাট-১ ব্লকের গোঘাট পঞ্চায়েতের অধীন ভাবাদিঘি গ্রাম। আরামবাগ- গোঘাট (এ জি আর রোড) হাই রোড ধরে কাঁটালির পচাখালি বাসস্ট্যান্ডে নেমে উত্তর দিকে গির্জাতলা। এই গির্জাতলাতে তৎকালীন সময়ে তৃণমূলের মুকুল রায় তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে,বাইরে থেকে লোকজন নিয়ে এসে সভা করেছিলেন ধমকানো ও চমকানোর জন্য। গির্জাতলা থেকে পশ্চিমদিকে মোড় নিয়ে আজকের লড়াইয়ের শিরোনাম ভাবাদিঘি গ্রামে ঢুকতে হয়। আগে গির্জাতে অসংখ্য টিয়া পাখির বাসা সমৃদ্ধ গ্রামের প্রাকৃতিক বৈচিত্রে ভরা, পরিবেশের সঙ্গে মানানসই ছিল এই বিশাল দিঘি। এই দিঘিতেই টিয়া পাখির ঝাঁক জল খেতে আসত। আর এই যে গির্জা সম্ভবত মোঘল আমলের স্মৃতি বহন করছে। প্রাচীন ঐতিহ্যের এই স্তম্ভ থেকে চুন সুড়কির ইট খসে খসে পড়ছে। আগের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি আর আসে না। এখন যা আসে তারাও এখন এই দিঘিতেই জল খেতে যায়। দীঘিতে টলটলে স্বচ্ছ জলে পদ্মপাতা -পদ্ম ফুলের সমারোহ এখন আর নেই। পরিবেশের নানান প্রভাবে পরিযায়ী পাখিদের কলরব আর শোনা যায় না। কলরব শোনা যায়, দিঘির জলে চড়ে বেড়ানো কয়েকশো নানান রঙের হাঁসের প্যাঁকপেকানি। এই মনোরম পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গ্রামবাসীরা দিঘিতে মাছ চাষ ও অন্যান্য কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
এই জলাশয়কে রক্ষা করার জন্যই গ্রামের উত্তরাংশ বরাবর রেলপথ করার দাবিতে ভাবাদিঘির মানুষ,‘ভাবাদিঘি বাঁচাও কমিটি" তৈরি করে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন। তারকেশ্বর ও বিষ্ণুপুরের সংযোগকারী রেলপথের মধ্যে গোঘাট ও কামারপুকুর রেল স্টেশন অবস্থিত। এই স্টেশন দুটির মধ্যবর্তী এলাকায় ভাবাদিঘি জলাশয়। এই জলাশয়কে রক্ষা করার জন্যই আন্দোলন। রেললাইনকে ভাবাদিঘির উত্তর পাড় দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা প্রাথমিক নকশাতে ছিল বলে জানা গেছে। গ্রামের অন্যতম সম্পদ হলো জীব বৈচিত্রে ভরা ৫২ বিঘার এই দিঘি। প্রাথমিক নকশার ছবি গুগুল মানচিত্রে দেওয়া হয়েছিল ও ডিমারকেশন পিলার দিয়ে সীমানাও নির্ধারণ করা হয়েছিল। কোন এক অজ্ঞাত কারণে রাতের অন্ধকারে পিলার সরে গেল, গুগল ম্যাপ থেকে নকশাও মুছে গেল। দিঘির উত্তর দিকে পাড় লাগোয়া নব্য জমিদারদের বড় বড় তিন থেকে চার বিঘা কাঁদি জমি বাঁচাতেই হয়ত কোন প্রভাবশালী আমলা দিঘির মাঝখান দিয়ে নকশা করিয়ে নিয়েছিলেন। এইদিকে গ্রামের জীবন জীবিকার মূল উৎস ভাবাদিঘি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। এখনকার নকশা অনুযায়ী লাইন হলে ভাবাদিঘির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। তাছাড়া অন্য কোন স্থানে পুকুর কেটে দিলে ভাবাদিঘির বিকল্প হয় কি ! হয় না। ভাবাদিঘি - ভাবাদিঘিই। তফসিলি বর্গ ক্ষত্রিয় কৃষকদের বসবাস এই গ্রামে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে মোট পরিবার ১৯৮ টি । এখন প্রায় আড়াইশো ছাড়িয়ে গেছে ।পেশাগত জীবিকার বিন্যাস বৈচিত্র্যপূর্ণ। খেতমজুর ,পাট্টাদার ,গরিব কৃষক,মাছ চাষি,রাজমিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি থেকে প্রাথমিক শিক্ষক, মাধ্যমিক শিক্ষক। এই বর্গক্ষত্রীয় গ্রামের নারী পুরুষ জান প্রাণ দিয়ে লড়াই করে "দিঘি চুরি" রুখে দিয়ে গ্রামটিকে চিনিয়ে দিয়েছে রাজ্যের মানুষের কাছে। এই দিঘির জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণিকুল পরিবেশের ভাণ্ডারকে পুষ্ট করে চলেছে। তাই এর ক্ষতি, স্থানীয় পরিবেশ ও বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থানের গুরুতর রূপান্তর ঘটাতে পারে।
‘ভাবাদিঘি জলাশয়ের উপর দিয়ে রেল লাইনের নকশা অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক একটি কর্মকাণ্ড*
গোঘাট স্টেশন থেকে যে কেউ লাইন ধরে হেঁটে গেলে তার চোখ যাবে সোজা উত্তরপাড় বরাবর। লাইনটি এইভাবেই হওয়া স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত। গির্জাতলা থেকে গোলপুর রাস্তায় যেখানে রেলের আন্ডারপাস হয়েছে সেখান থেকে কি কারণে সোজা নকশা করার পরিবর্তে, বাঁকতে বাঁকতে লাইনের নকশা চলে গেল জলাশয়ের উপর দিয়ে। সোজা উত্তর পাড়ের শক্ত মাটি লাগোয়া ২০-২৫ বিঘার মতন জমি অধিগ্রহণ করলেই রেললাইন পাতা হয়ে যেত। যা আর্থিক দিক থেকেও সাশ্রয়ী ও গ্রহণযোগ্য হতো। তা না করে কিংবা কিসের স্বার্থে কয়েক গুণ খরচ বাড়িয়ে দিঘির মাঝখান দিয়ে করার অপচেষ্টা করা হলো। পরীক্ষামূলকভাবে অন্য এলাকার সাধারণ মানুষকে নিয়ে একটি কমিটি ও বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি প্রশাসন গঠন করুক। দুটি কমিটির মধ্যেই প্রশাসনেরর আধিকারিকরা থাকুন। তারপর গোলপুর রাস্তার আন্ডারপাস থেকে সোজা হাঁটা শুরু করুন। দুটি পৃথক রিপোর্ট নিয়ে প্রশাসন বসুক। সমাধান সূত্র অবশ্যই বেরিয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও যুক্তি, তথ্য নিয়েই ভাবাদিঘির মানুষ লড়ে যাচ্ছে। ২০১০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তদানীন্তন রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে স্পিড পোস্টের মাধ্যমে ভাবাদিঘির মানুষ আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। ওই একই বছরে ২৮ এপ্রিল স্বপন রায় ও অন্যান্যরা চুঁচুড়ার অধিগ্রহণ বিভাগের কালেক্টরকে চিঠি পাঠান, রেলপথ গ্রামের উত্তর অংশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে দিঘি বাঁচাও কমিটি গড়ে উঠেছিল সেই কমিটির পক্ষ থেকে প্রশাসনের কাছে গত ২৭ /০৩/২০১৭ ও ৬/৫/২০১৭ তারিখে গণদরখাস্তের মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়। ভাবাদিঘি বাঁচাও কমিটির পক্ষ থেকে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দিয়ে সামগ্রিক বিষয়টি জানানো হয়েছিল। এমনকি যখন লাইনের কোনও কাজ হয়নি তখন থেকেই তাঁরা এই দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কেন্দ্রর ও রাজ্য প্রশাসনের বিভাগীয় আধিকারিকদের সঙ্গে দেখা করে এমনকি খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও বিষয়টি জানানো হয়। সেই সময়ে যদি গুরুত্ব দেওয়া হতো তাহলে আজকে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না। তখন ভাবাদিঘির এই গরিব গুর্বো মানুষগুলোকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করা হয়েছে। তৎকালীন সাংসদ ও বিধায়ক অকুস্থলে দাঁড়িয়ে সমাধানের মৌখিক আশ্বাসও দিয়েছিলেন। সেই আশ্বাসে স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করে ২০১৪ ২০১৬ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীদের জিতিয়ে দেন। এরপর গ্রামে ঢোকার মুখে একটি কালভার্ট শুরু হয়। গ্রামের মানুষ বাধা দিতে গেলে তখনও দিঘির উত্তরপাড় দিয়ে রেললাইন হবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কালভার্টের কাজ করিয়ে নিলেন। পরবর্তীকালে শুরু হলো বিরাট ষড়যন্ত্র। অবশেষে এল সেই কালো দিন। ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ রাজ্য প্রশাসন ও রেল দপ্তর গরিব মানুষের দাবিকে পাত্তা না দিয়ে দিঘি ভরাট করার উদ্দেশ্যে গায়ের জোরে মাটি ফেলতে শুরু করলেন। বিশ্বাসভঙ্গ ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিণতি হলো গ্রামবাসীদের প্রবল প্রতিরোধ। শুরু হলো তুমুল লড়াই। এই লড়াইয়ে মুখ্য ভূমিকা নিলেন গ্রামের মহিলারা। ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ধাক্কায় বেসামাল প্রশাসন ও শাসক দলের লোকেরা পিছু হটতে বাধ্য হলো। সেই থেকেই লাইনের কাজ বন্ধ । এই লড়াইয়ের বার্তা গোটা রাজ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।সেভ ডেমোক্রেসি, আক্রান্ত আমরা ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা গ্রামে এলেন। তাঁরাও ভাবাদিঘির মানুষদের লড়াইয়ে সাথি হলেন। তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী বাম বিধায়কগণ সহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিনিধিবৃন্দ গ্রামে পরিদর্শনে এলেন ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রথমদিকে পুলিশ প্রশাসনের বাধা পেলেও বিতর্কের মধ্য দিয়েই তাঁরা গ্রামে ঢুকতে পেরেছিলেন। কোনও স্থায়ী পরিকাঠামোর মূল কথা হলো টেকসই উন্নয়ন বা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট । সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবাদিঘির মানুষ দীঘির উত্তর পাড়ের শক্ত মাটির উপর দিয়ে লাইন তৈরি হোক এটাই দীর্ঘদিন দাবি করে আসছেন এবং সেটাই হবে যথার্থই উন্নয়ন। আইনি লড়াইয়ে সহায়তা করেছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাবাদিঘি যাবার পথে, ভাবাদিঘি গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে উল্লাসপুর বাসস্ট্যান্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতীরা প্রকাশ্য রাস্তার উপর ফেলে মারে। সেভ ডেমোক্রেসি প্রতিনিধি দলে ছিলেন সাহিত্যিক, মহিলা আইনজীবী ও চিত্রশিল্পী, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি। তাঁরাও হেনস্তার শিকার হন। গ্রামবাসীরাও শাসকদলের রক্ত চক্ষু থেকে বাদ যায়নি। তাঁদেরও হুমকি, অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি ঐ সময়ে দোকানদানিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাতেও তাঁরা নিজেদের হকের লড়াই থেকে সরে আসেনি। এটাই তাদের অসীম ইস্পাত কঠিন ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মানসিকতার পরিচয়।
রেলের তরফ থেকে বলা হচ্ছে রেলের নকশা পরিবর্তন করা যায় না। তাহলে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোরেলের নকশার পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব হলো? ভারতের রেল মানচিত্রে বিভিন্ন সময়ে নানান কারণে নকশা পরিবর্তনের তথ্য পাওয়া যায়। তৃণমূলের বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধি দল স্থানীয় মানুষকে বোঝানোর জন্য গ্রামে গেলে, সরেজমিনে দেখার পর তাঁদেরই একজন প্রতিনিধি আরামবাগ গার্লস কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. বাণীব্রত সেনের উপলব্ধি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি লিখেছেন,‘‘আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি যে, দিঘিকে যতটা সম্ভব আঘাত না করে দিঘির উত্তর পাড় দিয়ে ট্রেন চালানো যাবে না, এ কথা আজকের উচ্চস্তরের রেল প্রযুক্তির যুগে একেবারেই অচল। কাদের একগুঁয়েমির জন্য উত্তর দিক দিয়ে রেলের লাইন হচ্ছে না।
Comments :0