MANDA MITHAI — UPASANA HALDER — ATCHALAR ITIKATHA — NATUNPATA — 12 OCTOBER 2025, 3rd YEAR

মণ্ডা মিঠাই — উপাসনা হালদার — আটচালার ইতিকথা — নতুনপাতা, ৫ অক্টোবর ২০২৫, বর্ষ

ছোটদের বিভাগ

MANDA MITHAI  UPASANA HALDER  ATCHALAR ITIKATHA  NATUNPATA  12 OCTOBER 2025 3rd YEAR

মণ্ডা মিঠাই 

 

নতুনপাতা

 

আটচালার ইতিকথা 

------------------------ 
উপাসনা হালদার
------------------------ 
 

 

বাঙালির সর্বকালের সেরা উৎসব বলতেই বোঝায় - দুর্গোৎসব।
   বঙ্গদেশে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রচলন করেছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায় বাহাদুর, আনুমানিক ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে। তৎকালীন সময়ে এই দুর্গাপূজা করতে তাঁর প্রায় নয় লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল। 
তবে, হিন্দু শাস্ত্র মতে ত্রেতা যুগে রঘুকূল শ্রেষ্ঠ ভগবান শ্রী রামচন্দ্র, লঙ্কাধিপতি রাবণের সাথে যুদ্ধের আগে অকালবোধন দুর্গাপূজা করেছিলেন।
  আজ সারা বিশ্বে বাঙালি জাতির বসবাস, তাই সর্বত্রই মহা ধুমধামের সহিত দুর্গাপূজা পালিত হয়। আজকের দিনে দুর্গাপূজা শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে একত্রিত হয়ে এই পূজা উপভোগ করে।
যাইহোক, এখন আমি আমার ছেলেবেলায় কাটানো দুর্গাপূজার কিছু কথা এখানে লিপিবদ্ধ করেছি।
  আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়। তারই মাঠের একধারে, আটচালায় মা দুর্গার মূর্তি তৈরি হতো। যিনি শিল্পী, তাঁকে আমরা সবাই দাদু বলে ডাকতাম। তিনি প্রথমে বাঁশের চ্যেড়া কেটে, তাতে পেরেক সেঁটে, একটা একটা করে বেশ অনেকগুলো কাঠামো তৈরি করতেন। কোন কাঠামো কোন মূর্তির জন্য তা বোঝার কোনো উপায় থাকত না, কেবল মাত্র মা দুর্গা ছিলেন ব্যতিক্রম। সেই কাঠামোর উপর খড় বেঁধে মুণ্ডু ছাড়া বাকি শরীরের গঠন তৈরি করা হতো। এবার বোঝা যেত কোন মূর্তিটি কোন দেব-দেবীর। কারণ, গণেশের ছিল বিশালাকার পেট; এছাড়া, প্রত্যেকের পাশে তাঁদের বাহনের কাঠামো দেখেই বোঝা যেত কোন কাঠামোয় কোন দেব-দেবী আবির্ভূত হতে চলেছেন। খড়ের সব কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর শুরু হতো মাটির কাজ, সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। অনেকটা মাটি একসাথে নিয়ে, তাতে অল্প অল্প করে জল দিয়ে মেখে, মাটির একটা আঠারো মণ্ড তৈরি করে নেয়া হতো। তারপর, ওই খড়ের কাঠামোর গায়ে একটু একটু করে মাটি লাগিয়ে পুরো কাঠামো ঢেকে দেয়া হতো।  যাতে মাটিতে চিড় না ধরে, তার জন্য দু-একদিন ছাড়া ছাড়া জল ও মাটি দিয়ে প্রলেপ দিতেন দাদু। এরপর শুরু হতো মুণ্ডু তৈরীর কাজ; গণেশ ছাড়া প্রায় সব দেবদেবী ও অসুরের মুণ্ডু তৈরি হতো ছাঁচে, এগুলো কে আবার রোদে শুকিয়ে নিতে হতো মাঝে মাঝে। আমরা সবাই স্কুলে গিয়ে শুধু যে মুখ বন্ধ করে ঠাকুর তৈরি করা দেখতাম তা নয়, এরপর কি হবে? সাপ কেন হয়নি? গণেশের ইঁদুর হবে কখন? এমন হাজারো প্রশ্ন আমাদের মধ্যে আলোচনা হতো। দাদু মাঝেমধ্যেই আমাদের ভয় দেখানোর জন্য বলতেন, "সিংহ মশাই ঘুমিয়ে আছেন, বেশি কথা বললে এক্ষুনি উঠে সবাইকে তাড়া করবেন, তখন আর লুকোনোর কোনো জায়গা পাবে না।" কিন্তু, আমরা কিছুতেই ভয় পেতাম না।
  প্রতিদিন বাড়িতে ফিরে দেবী প্রতিমা তৈরির কাজ কত বাকি আছে তা সবিস্তারে আলোচনা করতাম। আর মাকে বলতাম, "পূজা তো আর বেশিদিন দেরি নেই, কবে আমাদের জামা কিনে দেবে?" 
মা বলতো, "থাম না, এখনো তো বাকি আছে, দেবো এখন। গাছে কয়টা ডাব আছে, বিক্রি করে তোদের জামা কিনে দেবো।" এইসব ভাবতে ভাবতে আমাদের বেশ আনন্দের দিন চলে যেত।
  সহপাঠীদের মধ্যে যারা একটু বড়লোক, তাদের বাড়িতে কেনাকাটার ধুম লাগতো অনেক আগেই; কারো কারো নাকি পাঁচটা-ছয়টা করে জামা হতো। এবং তারা অনেক উপহারও পেতো তাদের আত্মীয়দের কাছ থেকে। তাই কোনদিন কোন পোশাক পরবে, কোথায় ঘুরতে যাবে এবং কি কি সুস্বাদু খাবার খাবে তার পরিকল্পনা করতো।
  এদিকে আমাদের মত গরীব যারা, তাদের না আছে ভালো পোশাক, না আছে একটু ভালো খাবারের আয়োজন। 
একটা জিনিস আমি তখন খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলাম যে, যারা বড়লোক, তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও বড়লোক হয়। কিন্তু আমরা গরীব, বাবা নেই, মা কোনরকমে কায়ক্লেশে আমাদের মুখে দু মুঠো অন্ন তুলে দিতেন; তাই, আমরা কোনভাবে একটা নতুন পোশাক পেলেই আনন্দে মেতে উঠতাম। কিন্তু বিধিবাম, আমরা সেটুকুও পেতাম না। মা আপ্রাণ চেষ্টা করতেন আমাদের কিছু কিনে দেওয়ার জন্য, কিন্তু সময়ে তা আর হয়ে উঠতো না। যে ডাব বিক্রি করে ভেবেছিলেন আমাদের নতুন কিছু কিনে দেবেন, ঘরের চাল বাড়ন্ত, তাই সেই টাকা দিয়ে চাল কিনতে হতো। আমরা মনে মনে তখন খুবই কষ্ট পেতাম। আমাদের কিছু না দিতে পারার জন্য মাও খুব কষ্ট পেতেন, কিন্তু তখন আমরা তা বুঝতাম না; এখন প্রতি পলে পলে তা অনুভব করি।  
  
  পূজা যত এগিয়ে আসতো, মূর্তি তৈরীর কাজ তত দ্রুত গতিতে চলতে থাকতো। একে একে সকল দেবদেবীর মুণ্ডু লাগিয়ে দিতেন দাদু। তারপর, হাতের তালু, আঙুল থেকে শুরু করে যত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাটির কাজ রয়েছে তা দ্রুত শেষ করে ফেলা হতো। 
আমরা স্কুল থেকে ফেরার সময় যে পর্যন্ত কাজ দেখে আসতাম, পরদিন গিয়ে দেখতাম আরো অনেক কাজ হয়ে গেছে। এরপর, মূর্তির ওপর চুনের মত সাদা রং লাগানো হতো এবং যে দেবদেবীর যে রং তা দেওয়া হতো। দাদু, সকল দেব-দেবীকে এক এক করে বস্ত্র পরিধান করাতেন, মাথায় চুল লাগিয়ে দিতেন ও নানা অলংকারে সাজিয়ে তুলতেন। সবশেষ, মাথার মুকুট ও অস্ত্রশস্ত্র হাতে ধরিয়ে দিতে। সব কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে, মাকে দেখতে যে কি অপূর্ব লাগত তা বলে বোঝানোর মতো নয়। 
এসবের মধ্যেই স্কুলে পূজার ছুটি পড়ে যেত।

     অবশেষে মা ধরাধামে আসতেন, মহা ধুমধামের সহিত মায়ের আরাধনায় মেতে উঠতো জগৎ। ঢাকের বাদ্যিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠতো। নাইবা হলো নতুন জামা, ভালো খাওয়া দাওয়া, তবু মন আনন্দে ভরে উঠত; ছুটে যেতাম প্যান্ডেলে মায়ের পূজা দেখতে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতাম, অনেকেরই আমার মত অবস্থা; আবার কিছু ছেলে মেয়ে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে আসতো, তাদের হাতে কত রকমারি খেলনা, বিভিন্ন ধরনের খাবার। আর, আমাদের মত অসহায় ছেলে মেয়েদের হাতে হয়তো একটা জল বেলুন, নয়তো একটা পাঁপড় কিংবা বাদাম ভাজা।
আজও গ্রামবাংলায় এমন চিত্র যে দেখা যায় না, তা কিন্তু নয়; হয়তো একটু পরিবর্তন হয়েছে। এভাবেই সুখে-দুঃখে কেটে যেত পূজার দিন গুলি, আমরা আবার এক বছর অপেক্ষায় থাকতাম মায়ের আগমনীর।
এটাই ছিল আমাদের ছেলেবেলার দুর্গাপূজা।

Comments :0

Login to leave a comment