উৎসবে অনুভবে
মণ্ডা মিঠাই
বিশ্বের নানা প্রান্তে পূর্বপুরুষ অমৃতের উদ্দেশ্যে পালিত নানা উৎসব
সৌম্যদীপ জানা
নতুনপাতা
২০ অক্টোবর ২০২৫, বর্ষ ৩
-------------------------------------
“ধর্ম অনেক, উৎসব এক"
সারা বিশ্বের নানা প্রান্তে নানান ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের উৎসবের সাম্যতা এবং রীতিনীতি মিল প্রায়শই আমরা খুঁজে পাই, কোন কোন সময় সেই মিলগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে গেলেও সৃষ্টির আদি থেকেই মানব হৃদয় ও মস্তিষ্কের গভীরে সঞ্চিত এক গভীর জ্ঞান ও দার্শনিক চিন্তাভাবনার প্রসার গোটা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়েছে বলেই দার্শনিক গবেষকেরা বিশ্বাস করন। তেমনি উৎসব সাম্য তার একটি নিদর্শন হলো মৃত পূর্বপুরুষদের ও আত্মাদের দুষ্ট রাখার জন্য পালিত উৎসব সমূহ। পৃথিবীর নানা স্থানে নানা ধর্মের ,নানা বর্ণের মানুষ এই একই দার্শনিক মনোভাব সম্পন্ন উৎসব নানান রীতি-নীতির মাধ্যমে পালন করেন কিন্তু যতই রীতিনীতি তফাৎ থাকুক না কেন শেষে গিয়ে সকল প্রকার উৎসবেরই একই উদ্দেশ্য তা হলো মৃত পূর্বপুরুষ ও হারিয়ে যাওয়া আর তাদের উদ্দেশ্যে সম্মান জ্ঞাপন।
ভূত চতুর্দশী: বাঙালির পূর্বপুরুষ স্মরণের উৎসব
বাংলা সংস্কৃতি তার আচার, বিশ্বাস ও রীতিনীতির গভীরে যে মমতা, পারিবারিক বন্ধন ও শ্রদ্ধাবোধ লুকিয়ে আছে, ভূত চতুর্দশী তারই এক সুন্দর প্রতিফলন।
কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত এই উৎসবটি দীপাবলির আগের দিন, অর্থাৎ অন্ধকার রাতে আলো জ্বালানোর মধ্য দিয়ে পূর্বপুরুষদের আত্মাকে স্মরণ করার দিন।
বিশ্বাস করা হয়, এই রাতে পূর্বপুরুষদের আত্মা তাদের পরিজনদের ঘরে ফিরে আসেন আশীর্বাদ দিতে। তাঁদের শান্তি ও আত্মার মুক্তির জন্য ঘরে ঘরে জ্বালানো হয় চৌদ্দ প্রদীপ, যা আলো, পবিত্রতা এবং আত্মিক শক্তির প্রতীক। প্রতিটি প্রদীপ যেন এক একটি প্রজন্মের স্মৃতি বহন করে।
একইসঙ্গে রান্না করা হয় চৌদ্দ প্রকার শাক—যেমন লাউপাতা, কলমি, পুঁই, নোটে, সর্ষে, হিংচে ইত্যাদি। এই শাকগুলি জীবনের ভারসাম্য ও প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
অনেক পরিবারে এই রাতে ভূতের গল্প শোনা, পুতুলনাচ, আলপনা আঁকা ইত্যাদি প্রথা এখনও জীবিত। কেউ কেউ এই দিনটিকে “ভূতের দিন” হিসেবেও মেনে নেন—যেখানে মৃত্যু ও আত্মাকে নিয়ে ভয় নয়, বরং সম্মান ও শ্রদ্ধার ভাবনা প্রকাশ করা হয়।
ভূত চতুর্দশী তাই একদিকে ধর্মীয় ঐতিহ্য, অন্যদিকে মানসিক পরিশুদ্ধতার উৎসব—যেখানে আলো, খাদ্য ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে জীবিতরা তাঁদের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন পুনর্স্মরণ করেন।
ওবোন উৎসব (Obon Festival) :জাপানের পূর্বপুরুষ স্মরণ দিবস
জাপানের ওবোন উৎসব হল মৃত পূর্বপুরুষদের স্মরণে পালিত এক গভীর ভাবপ্রবণ উৎসব, যার শিকড় বৌদ্ধ দর্শনে প্রোথিত।
বিশ্বাস করা হয়, ওবোনের সময় পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। এই উপলক্ষে জাপানিরা নিজেদের ঘরবাড়ি পরিস্কার করেন, ঘরে বুক্কে অলতার নামে এক বিশেষ পূজার আসন সাজান, যেখানে রাখা হয় ধূপ, ফুল, ফল ও প্রিয় খাদ্য।
ওবোন উৎসবের অন্যতম সুন্দর রীতি হল তোড়ো নাগাশি (Toro Nagashi) — যেখানে নদী বা সমুদ্রের জলে কাগজের লণ্ঠন ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি লণ্ঠন একটি আত্মার প্রতীক, যা আলো অনুসরণ করে স্বর্গে ফিরে যায় বলে বিশ্বাস।
এই দৃশ্য একদিকে বিষাদের, অন্যদিকে শান্তির।
ওবোন উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ভূত চতুর্দশীর মতোই — আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তাঁদের আত্মাকে শান্তির পথ দেখানো।
গাইযাত্রা (Gai Jatra) : নেপালের আনন্দময় স্মরণযাত্রা
নেপালের অন্যতম সাংস্কৃতিক উৎসব গাইযাত্রা-র অর্থ “গরুর যাত্রা”। নেপালি সমাজে বিশ্বাস, মৃত আত্মারা গরুর সঙ্গে যাত্রা করে পরলোকে পৌঁছান।
তাই এই দিনে পরিবারগুলি তাদের প্রয়াত আত্মীয়দের স্মরণে গরুকে সাজিয়ে রাস্তায় বের করেন। শিশু-কিশোররা কখনও গরুর সাজে, কখনও মজার পোশাকে অংশ নেয় শোভাযাত্রায়।
গাইযাত্রা একদিকে শোক, অন্যদিকে আনন্দের উৎসব।
এই দিনে নেপালের শহর ও গ্রামজুড়ে হাস্যরসাত্মক নাটক, সংগীত ও নাচের আয়োজন করা হয়—যা মানুষকে শেখায়, মৃত্যু ভয়ের নয়, বরং জীবনের অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা।
এই উৎসবের মাধ্যমে নেপালি সমাজ শেখায়—হাসির মধ্য দিয়েও মৃতদের স্মরণ করা যায়, শ্রদ্ধা প্রকাশ করা যায়, এবং জীবনের ধারাবাহিকতাকে মেনে নেওয়া যায়।
ডে অফ দ্য ডেড (Day of the Dead) : মেক্সিকোর রঙিন স্মরণ উৎসব
মেক্সিকোর ‘ডে অফ দ্য ডেড’ (Día de los Muertos) বিশ্বজুড়ে খ্যাত, কারণ এটি মৃত্যু নিয়ে ভয় নয়, বরং আনন্দ ও ভালোবাসার এক উৎসব।
নভেম্বর মাসের ১ ও ২ তারিখে পালিত এই উৎসবে পরিবারে তৈরি হয় অলতার (Ofrenda)—যেখানে রাখা হয় মৃত আত্মীয়দের ছবি, প্রিয় খাবার, ফল, ফুল, মোমবাতি ও রঙিন চিনির খুলি (Sugar Skull)।
মানুষ মুখে রঙ লাগিয়ে কঙ্কালের সাজে রাস্তায় বের হয়, গান গায়, নাচে ও হাসে—এইভাবে তারা মৃতদের স্মরণ করে আনন্দের সঙ্গে।
এই উৎসবের মূল বার্তা—মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, বরং স্মৃতির মাধ্যমে জীবনের আরেক রূপ।
এই ধারণা ভূত চতুর্দশীর ভাবধারার সঙ্গে মিল রেখে মানবতার সর্বজনীন দর্শন প্রকাশ করে।
হাংরি ঘোস্ট ফেস্টিভ্যাল (Hungry Ghost Festival) : চীনের আত্মাশান্তির আচার
চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তাওইস্ট ও বৌদ্ধ সমাজে পালিত হয় হাংরি ঘোস্ট ফেস্টিভ্যাল।
বিশ্বাস করা হয়, সপ্তম চান্দ্রমাসের পনেরো তারিখে পাতাললোকের দরজা খুলে যায় এবং মৃত আত্মারা পৃথিবীতে ফিরে আসে।
এই সময় মানুষ রাস্তায়, নদীর ধারে, এমনকি নিজের বাড়ির সামনেও আত্মাদের জন্য অর্পণ করে খাবার, ধূপ, কাগজের টাকা ও পোশাক।
এই উৎসবের উদ্দেশ্য হলো আত্মাদের ক্ষুধা নিবারণ ও শান্তি প্রদান।
চীনের এই আচারেও আলো ও অর্পণের যে প্রতীক দেখা যায়, তা ভূত চতুর্দশীর চৌদ্দ প্রদীপের ঐতিহ্যের সঙ্গে এক অদ্ভুত মিল সৃষ্টি করে।
উভয় উৎসবেই জীবিতরা মৃত আত্মাদের সঙ্গে এক আত্মিক সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করেন।
শবেবরাত : ইসলাম ধর্মে আত্মার মুক্তির রজনী
ইসলাম ধর্মে পালিত শবেবরাত বা “মুক্তির রজনী” হল এমন একটি দিন, যেদিন মুসলমানরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ তায়ালা জীবিত ও মৃত উভয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করেন।
এই রাতে মানুষ নামাজ পড়ে, কবর জিয়ারত করে, দান-খয়রাত করে এবং প্রয়াত আত্মীয়দের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।
শবেবরাতের মূল উদ্দেশ্যও ভূত চতুর্দশীর মতোই—আত্মার শান্তি, ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনা।
এটি মানুষকে স্মরণ করায় যে, জীবনের বাইরেও আছে এক নীরব জগৎ, যেখানে প্রার্থনা ও শ্রদ্ধা পৌঁছে যায় আত্মার কাছে।
হ্যালোইন (Halloween) : পশ্চিমা জগতে আত্মা ও আলোয়ের উৎসব
পশ্চিমা জগতে ৩১ অক্টোবর পালিত হ্যালোইন উৎসবের উৎপত্তি প্রাচীন কেল্টিক জাতির ‘সামহেইন (Samhain)’ উৎসব থেকে।
তাদের বিশ্বাস ছিল, এই রাতে জীবিত ও মৃতের জগৎ মিলেমিশে যায়।
অতঃপর খ্রিস্টীয় যুগে এটি পরিণত হয় “All Hallows’ Eve” নামে, যা পরবর্তীতে “Halloween” হয়ে ওঠে।
আজকের দিনে এটি এক আনন্দময় সামাজিক উৎসব—মানুষ ভূতের পোশাক পরে, কুমড়ো দিয়ে তৈরি করে Jack-o’-Lantern, শিশুরা ঘরে ঘরে গিয়ে “Trick or Treat” খেলে।
কিন্তু এই উৎসবের অন্তর্নিহিত অর্থ এখনও একই—অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বেলে জীবনের, স্মৃতির ও প্রিয়জনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের
উপসংহার
ভূত চতুর্দশী, ওবোন, গাইযাত্রা, ডে অফ দ্য ডেড, হাংরি ঘোস্ট ফেস্টিভ্যাল, শবেবরাত এবং হ্যালোইন—এই সাতটি উৎসবের উৎস ভিন্ন হলেও লক্ষ্য একটাই—মৃতদের স্মরণ, শ্রদ্ধা ও আত্মার শান্তি।
এগুলি প্রমাণ করে, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতির পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মানবজাতির অন্তরে একটাই সুর বাজে—প্রিয়জনদের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।
বাংলার ভূত চতুর্দশী সেই সার্বজনীন আবেগেরই এক আলোকিত রূপ।
এটি আমাদের শেখায়—আলোয় যেমন অন্ধকার দূর হয়, তেমনই স্মরণে জীবিত থাকে মৃতরা।
তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আলোই হোক চিরন্তন জীবনের প্রতীক।
“প্রদীপের আলোয় জ্বলে ওঠে স্মৃতির প্রহর,
পূর্বপুরুষের আশীর্বাদেই আলোকিত হোক আমাদের জীবন।”
Comments :0