গল্প
টাপুর টুপুর
সৌরীশ মিশ্র
নতুনপাতা
জানলার লোহার শিকগুলো ধরে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল রুকু। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে এখনো।
এইরকমই তো চলছে গত আট-ন'দিন ধরে। কখনো হালকা বৃষ্টি কখনোবা মুষলধারায় ভিজছে এই অঞ্চল। আর ফলস্বরূপ, এখানকার বহু মানুষই জলবন্দী হয়ে পড়েছেন। জলে থইথই চারদিক। শুধু একটাই বাঁচোয়া। এই এলাকার প্রতিটি বাড়িরই ভিত বেশ উঁচু করে করা হওয়ায় কোনো বাড়িতেই ঘরে জল ঢোকেনি। চারিদিকে জলের মধ্যে মধ্যে বাড়িগুলোকে দেখে এখন মনে হচ্ছে, ওগুলো যেন সমুদ্রের মাঝে মাঝে এক একটা দ্বীপ।
রুকুর মনটা খারাপ। ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে যে তাকে। এদিকে, আশেপাশের এই পরিস্থিতির জন্য স্কুলও বন্ধ। তাই, স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও হচ্ছে না রুকুর। মন খারাপ হবে না ওর!
আনমনে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে এখনও তাকিয়েই আছে রুকু। হঠাৎ তখুনি, প্রথম আওয়াজটা কানে এল ওর। মিউ। কিসের শব্দ? বিড়ালের ডাকের শব্দ না? বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দের মাঝে কান খাড়া করে রইল রুকু, যদি শব্দটা আবার হয়। আর, কয়েকক্ষণের মধ্যেই ফের শুনতেও পেল সে। মিউ।
অবাক হল রুকু। তাদের বাড়িতে তো কোনো পোষা বিড়াল নেই, অথচ আওয়াজটা আসছে খুব কাছ থেকেই। রুকু নিজেকে একটু স্থির করে ঠাওর করার চেষ্টা করল আওয়াজটা আসছে ঠিক কোথা থেকে। এরই মধ্যে আরো বেশ কয়েকবার মিউ মিউ ডাক কানে এল রুকুর। রুকু এবার নিশ্চিত হয়ে গেল, আওয়াজটা আসছে সদর দরজার দিক থেকেই।
যদিও রুকুদের ঘরে জল ঢোকেনি, এই ক'দিনের বৃষ্টিতে তাদের উঠোন জলে থইথই করছে। ঘর থেকে বেড়িয়ে আস্তে আস্তে জল ভেঙ্গে ভেঙ্গে সদর দরজার দিকে এগোলো রুকু।
সদর দরজার সামনে এসে পাল্লা দুটো খুলতেই রুকুর অবাক হওয়ার পালা। দুটো বিড়াল ছানা চারদিকের থইথই জল থেকে বাঁচতে সদর দরজার ডানদিকে একটুখানি উঁচু মতোন যে জায়গাটা আছে তাতেই জড়সড় হয়ে বসে আছে। ছানাদুটোর মধ্যে একটা রুকুকে দেখে মুখটা তুলল একটু। তারপর, আরো একবার ডেকে উঠল- মিউ।
রুকু আর দেরী করল না। দু'হাত বাড়িয়ে বিড়াল ছানাদুটোকে সাবধানে কোলে তুলে নিল ও। তারপর, দ্রুত পা বাড়াল সে ঘরের দিকে। রুকু দেখল, ছানাদুটোরই গায়ের সব লোম ভেজা। থরথর করে ঠান্ডায় কাঁপছেও ওরা।
ঘরে ঢুকেই রুকু চিৎকার করে উঠল, মা, দেখো কি কাণ্ড!
রুকুর মা ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিড়ালছানাদুটোকে দেখে তো অবাক। বললেন, এ দুটোকে আবার কোথা থেকে পেলি রে?
রুকু সব কথা বলল মা-কে।
এর মধ্যে রুকুর বাবাও এসে গেছেন সেই ঘরে। তিনি তাড়াতাড়ি ছানাদুটোকে রুকুর কাছ থেকে নিজের কোলে নিয়ে বললেন, এক্ষুনি একটা টাওয়েল নিয়ে আয় তো রুকু। আর দামিনী, ঘরে একটু দুধ হবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ হবে। বললেন রুকুর মা।
তবে আর দেরী কোরো না। এক্ষুনি কিছুটা দুধ একটু গরম করে নিয়ে আসো তো।
রুকু এক ছুটে ভিতরের ঘর থেকে একটা টাওয়েল নিয়ে এলো। রুকুর বাবা খুব যত্ন করে বিড়ালছানাদুটোর সারা শরীর আস্তে আস্তে মুছিয়ে দিতে থাকলেন আর শুধু বলতে থাকলেন, আহা রে, বেচারা দুটো কতো কষ্টই না পেয়েছে।
এরই মধ্যে, রুকুর মা একটা বড় থালায় দুধ নিয়ে হাজির হলেন ঘরে। বিড়াল ছানাদুটোকে মেঝেতে নামিয়ে ওদের মুখের সামনে দুধের থালাটা ধরলেন রুকুর বাবা। ছানাদুটো তাদের ছোট্ট জিভদুটো বের করে চুকচুক করে খেয়ে ফেলল পুরো দুধটুকু কিছুক্ষণের মধ্যেই। আর দুধটা খেতেই দুটো ছানাই চাঙ্গা হয়ে গেল অনেকটাই। পায়ে-পায়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলো ওরা ঐ ঘরময়।
বাবা, মা, একটা কথা বলব। ছানাদুটোর ঘুরে বেড়ানো দেখতে দেখতে বলে রুকু।
কি? ছানাদুটোকে পুষবি, এই বলবি তো? বললেন রুকুর বাবা।
তুমি কি করে জানলে? অবাক হয় রুকু।
আমার তো কোনো অবজেকশন নেই। তোমার কোনো অবজেকশন নেই তো? স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন রুকুর বাবা।
না না, অবজেকশন থাকবে কেন? সাথে সাথেই বলেন রুকুর মা।
মা-র কথাটা শোনামাত্রই আর নিজের এক্সাইটমেন্ট নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারেনা রুকু। চিৎকারই করে ওঠে, হুররে, বলে।
ছেলের কাণ্ড দেখে হেসে ফেলেন রুকুর বাবা, মা দু'জনই।
তা ওরা যখন আজ থেকে এই বাড়িতেই থাকবে, ওদের তো নাম দিতে হয়।
নাম আমার ভাবা হয়ে গেছে বাবা।
কি নাম রে?
টাপুর আর টুপুর। ঐ ছাই-ছাই রঙেরটার নাম টাপুর আর সাদাটার নাম টুপুর।
বাঃ, নাম দুটো তো বেশ হয়েছে।
এই সব কথাবার্তা যখন চলছে তাতে কিন্তু টাপুর, টুপুর কারোরই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কোনো। ওরা তখনো ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঐ ঘরময়।
Comments :0