উৎসবে অনুভবে
শৈশবের শারদোৎসব
পল্লব মুখোপাধ্যায়
নতুনপাতা
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
শৈশবের শারোদৎসবের স্মৃতি মূলত এক আনন্দময় এবং নস্টালজিক অভিজ্ঞতা, যার মধ্যে রয়েছে নতুন পোশাকে সেজে ওঠা, ঢাকের শব্দে মেতে ওঠা, ধুনুচি নাচ দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে হইচই করা । এই স্মৃতিগুলি প্রতিটি বাঙালির জীবনে এক বিশেষ স্থান করে নেয় এবং সময়ের সাথে সাথে আরও গভীর হয়ে ওঠে। উৎসবের দিনগুলিতে লুচি, ছোলার ডাল বা আলুরদম সহ নানা রকম মিষ্টি খাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা। বড় হওয়ার সাথে সাথে এই স্মৃতিগুলি এক গভীর নস্টালজিয়া নিয়ে আসে, যা অন্যান্য বাঙালির মতো আমার জীবনেও এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে |
শরৎ বাংলাদেশের কোমল, স্নিগ্ধ এক ঋতু। শরৎঋতুর রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য। ভাদ্রের ভোরের সূর্য মিষ্টি আলোর স্পর্শ দিয়ে প্রকৃতির কানে কানে ঘোষণা করে শরতের আগমন বার্তা। ঝকঝকে নীল আকাশে শুভ্র মেঘ, ফুলের শোভা আর শস্যের শ্যামলতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে শরৎ। প্রকৃতির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে কবি-র কথা মনে পড়ে - “আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা” | শরতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে তোলে রূপময়। গাছের পত্রপল্লবে গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতেই পাখপাখালির দল মহাকলরবে ডানা মেলে উড়ে যেত নীল আকাশে। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মতো উড়ে যেত পাখির ঝাঁক। শিমুল তুলোর মতো ভেসে আসত সাদা মেঘের খেয়া। চারদিকে সজীব গাছপালার ওপর বয়ে যেত শেফালিফুলের মদির গন্ধভরা ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়া। শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দুর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকত সাদা আর জাফরান রং মেশানো রাশি রাশি শিউলিফুল। শরতের ভোরের এই সুরভিত বাতাস মনে জাগাত আনন্দের বন্যা। তাই ভোরে উঠেই ছুটে যেতাম শিউলি তলায়।
সূর্য উঠত সোনার বরণ রূপ নিয়ে। নির্মল আলোয় ভরে যেত চারদিক। আমন ধানের সবুজ চারার ওপর ঢেউ খেলে যেত উদাসী হাওয়া। আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। ফসলের মাঠের একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর রুপোলি ধারায় সূর্যের আলো ঝলমল করত । নদীর তীরে কাশবনের সাদা কাশফুল হাতছানি দিয়ে ডাকত ।
কাশফুলের মনোরম দৃশ্য থেকে সত্যিই চোখ ফেরানো যেত না। ভরা নদীর বুকে পাল তুলে মালবোঝাই নৌকা চলে যেত । ডিঙি নাও বাইতে বাইতে কোনও মাঝি হয়তো-বা গেয়ে ওঠে উঠতেন ভাটিয়ালি গান। ফসলের ক্ষেতে অমিত সম্ভাবনা কৃষকের চোখে স্বপ্ন এনে দিত । তৃপ্তির চোখে ভবিষ্যৎ আর স্বপ্নে ছাওয়া সবুজ ধান ক্ষেত চেয়ে চেয়ে দেখত কৃষক।
বিলের জলে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকতো সাদা ও লাল শাপলা। সকালের হালকা কুয়াশায় সেই শাপলা এক স্বপ্নিল দৃশ্যের আভাস বয়ে নিয়ে আসত । শারদোৎসবের এই স্নিগ্ধ মনোরম প্রকৃতি মানবজীবনেও এক প্রশান্তির আমেজ বুলিয়ে দিত । মাঠভরা সোনালী ধান দেখে কৃষক দুচোখ ভরে দেখতেন আসন্ন সুখের স্বপ্ন। শহরের মানুষও অবকাশ পেলে শারদোৎসব ও শরতের মনোরম প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য দেশের বাড়িতে ছুটে যেতেন |
শারোদোৎসবে বাংলার প্রকৃতি থাকত নির্মল, স্নিগ্ধ। এই সময়ের মতো নীল আকাশ আর কোনও ঋতুতে দেখা যেত না। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর নদীতীরে সাদা কাশফুল, ভোরে হালকা শিশিরভেজা শিউলিফুল সব মিলিয়ে এ যেন শুভ্রতার ঋতু। রাতের বেলার জ্যোৎস্নার রূপ অপরূপ। মেঘমুক্ত আকাশ থেকে যেন জ্যোৎস্নার ফুল ঝরে পড়ত। আর ছিল চাঁদের আলোর শুভ্রতা | শরতের জ্যোৎস্নার মোহিত রূপ নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। বলা যায়, শরৎ বাংলার ঋতু-পরিক্রমায় সবচেয়ে মোহনীয় ঋতু।
শারোদৎসবকে কেন্দ্র করে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতেন পাড়ার সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। খুঁজতে গেলে এমন অসংখ্য ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলার বুকে। ছোট ছোট ঘটনা নয়, বাংলার শারদোৎসব প্রকৃত পক্ষেই ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান’ । শৈশব-কৈশোরের দিনগুলিতে দেখেছি এই উৎসবে জাত, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে আনন্দে মেতে উঠতেন সাধারণ মানুষ । এই পরম্পরা নতুন নয়। ছোট থেকেই দেখে এসেছি আদতে শারদোৎসব রাজ্যের ধর্মনিরেপেক্ষ, সমন্বয়ী ঐতিহ্যকেই তুলে ধরত | কিশোর থেকে তারুণ্যে উপনীত হতেই ছিল উৎসব সংখ্যা কেনা, তা নিয়ে চর্চা-র ধূম | নজর থাকত প্রগতিশীল সাহিত্য-র স্টলগুলিতে | আমার কাছে তাই শারদোৎসব একদিকে যেমন মিলনের উৎসব অন্যদিকে তেমনই মননশীলতার-ও উৎসব |
Comments :0