'Boipara' Waterlogging

নর্দমার জলে ধুয়ে যাচ্ছে বইয়ের পাতা!

কলকাতা

অয়ন মুখোপাধ্যায়

কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মানেই বইয়ের ভাণ্ডার, জ্ঞানের তীর্থক্ষেত্র। একের পর এক দোকান, ফুটপাতজুড়ে বইয়ের স্তূপ- এই ছবি বাঙালির সংস্কৃতির অহঙ্কার। আজ সেই একই জায়গা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আমাদের অব্যবস্থার নগ্ন চেহারা। বৃষ্টির জমা জলে বইয়ের স্তূপ ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে আবর্জনা। রাস্তার ধারে গাদাগাদি বই, কোথাও অর্ধভেজা ত্রিপল, কোথাও জ্বলজ্বল করে ভিজে যাওয়া পৃষ্ঠা। কোথাও ময়লার স্তূপে মিশে আছে বই। এ দৃশ্য কেবল ব্যবসার ক্ষতি নয়, এ দৃশ্য আসলে আমাদের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে অস্বাভাবিক। কিন্তু অতিবৃষ্টি কলকাতায় এবারই প্রথম নয়। এবারের বৃষ্টির অস্বাভাবিক দিক হলো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পরপর মৃত্যু। আর অস্বাভাবিক জল জমে থাকা। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার বহু ঘন্টা পরও জমে থেকেছে জল বহু জায়গায়। আর বিপর্যস্ত হয়েছে বইপাড়া। ছাত্রদের একাংশ  দিয়েছে বইপাড়ার পাশে দাঁড়ানোর ডাক। সাড়াও মিলেছে আহ্বানে। 
আসলে বইপাড়া মানে শুধু দোকান নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো মানুষের জীবিকা। লেখক লিখছেন, প্রকাশক ছাপাচ্ছেন, বাঁধাইকর্মী, প্রুফ রিডার, মুদ্রক, বিক্রেতা— সবার জীবন জুড়ে আছে বই। পাঠক এখানে খুঁজে পান সস্তায় পাঠ্যপুস্তক, গবেষক খুঁজে পান দুর্লভ সংগ্রহ, সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পান পুরনো সংখ্যার অমূল্য খনি। একবার বৃষ্টি নামলেই সেই সমস্ত শ্রম, স্বপ্ন, পরিশ্রম ভেসে যাবে জলে। এ কেউ ভাবতে পারেননি যে বইয়ের পাতায় জমে থাকা জ্ঞানের আলো ধুয়ে যাচ্ছে নর্দমার জলে।
এ আমাদের লজ্জা, প্রশাসনের ব্যর্থতা।
এ বছরই বর্ষার জলে কলেজ স্ট্রিটের ভয়ঙ্কর ছবি আমাদের সামনে এসেছে। এ যেন অক্ষরের শ্মশানভূমি । প্রশাসন তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। নর্দমা পরিষ্কার না হওয়া, যথাযথ নিকাশি ব্যবস্থা না থাকা, ফুটপাথের পরিকল্পনাহীনতা— সব মিলিয়ে এই বিপর্যয়। অথচ এই ক্ষতির বোঝা সরকারের যত, তার চাইতে অনেক বেশি বই বিক্রেতাদের। বড় প্রকাশকেরা হয়তো টিকে যাবেন, কিন্তু ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ভেঙে পড়েছেন। দিনের পর দিন শ্রম দিয়ে গড়ে তোলা পুঁজি একরাতে ভেসে গেলে তাঁদের পক্ষে আর উঠে দাঁড়ানো সম্ভব হবে কি? এই প্রশ্ন বই পাড়ার অন্দরমহলে 
ঐতিহাসিকভাবে বইপাড়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।  শিক্ষা সংস্কৃতির স্বার্থে কে কেন্দ্র করে ছাপাখানার যে বিস্তার ঘটে, আর তারই পরিণতিতে কলেজ স্ট্রিটে জন্ম নেয় এই বইপাড়া। বিদ্যাসাগর প্রথম বুঝেছিলেন যে বই কেবল বিদ্যার বাহন নয়, জীবিকারও সম্বল। জমিদারি বা চাকরি নয়, কেবল বইকেই অবলম্বন করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক অনন্য অর্থনৈতিক সাফল্যের নজির। সেই ঐতিহ্যের ধারক বইপাড়া আজ যদি জলকাদায় ভেসে যায়, তবে তা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও লজ্জাজনক পরাজয়।
প্রশ্ন ওঠে, কেন এখনো বইপাড়ায় আধুনিক পরিকাঠামো নেই? কেন এখানে সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি হয়নি? কেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পরিকল্পিত আশ্রয় নেই? কেন প্রতিবারই তাঁদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়? বইপাড়া যদি সত্যিই বাংলার গৌরব হয়, তবে তার সুরক্ষার দায়ও প্রশাসনেরই। কিন্তু সেই দায় কোথায়?
বইপাড়াকে রক্ষার জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ অবিলম্বে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, স্থায়ী জল নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় জল না জমে। দ্বিতীয়ত, ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পরিকল্পিত শেড বা হালকা স্থায়ী কাঠামো তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, অগ্নি ও বন্যা প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। চতুর্থত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য সহজলভ্য বিমার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে হঠাৎ বিপর্যয়ে তাঁদের পক্ষে ক্ষতি সামলানো সম্ভব হয়।
সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সচেতনতা ও সংগঠিত আন্দোলন। পাঠক, লেখক, প্রকাশক, গবেষক— সবাইকে একজোট হয়ে বইপাড়া রক্ষার জন্য আওয়াজ তুলতে হবে। কারণ এই লড়াই কেবল ব্যবসায়ীদের লড়াই নয়, এটি আমাদের সম্মিলিত সংস্কৃতির লড়াই।

Comments :0

Login to leave a comment