EDITORIAL

উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ

সম্পাদকীয় বিভাগ

রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দখলদারি নিয়ে রাজ্যপাল এবং মুখ্যমন্ত্রীর আড়ালে বিজেপি ও তৃণমূলের কদর্য সংঘাতের জেরে রাজ্যের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাটাই রসাতলে যেতে বসেছে। উচ্চ শিক্ষার মানকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করা, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যাধুনিক পরিকাঠামো গড়ে তোলা, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করে শূন্যস্থান পূরণ, প্রশাসনকে দক্ষ ও গতিশীল করা, আধুনিক বিষয়ে উচ্চমানের গবেষণা উপযুক্ত পরিকাঠামো নির্মাণ করা ইত্যা্দি বিষয় নিয়ে সরকার, রাজ্যপাল সহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের যখন একযোগে কাজ করার কথা তখন রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীদের মতো উচ্চ পদাধিকারীরা প্রতিদিন কলতলার কদর্য ঝগড়ায় মেতে থাকছেন। কোনও শিক্ষিত সভ্য সমাজে এমনটা কল্পনাও করা যায় না। এঁদের আচরণ দেখে একটুও মনে হয় না শিক্ষার প্রতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি ছাত্রদের প্রতি ন্যূনতম কোনও দায় দায়িত্ব আছে। শিক্ষা এবং ছাত্রদের ভবিষ্যৎ এঁদের কাছে গৌণ বিষয়, আসল হলো আধিপত্য কায়েম, ক্ষমতা দখল। রাজ্যের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি কার দখলে থাকবে, কার অঙ্গুলি হেলনে চলবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি লড়াই কেন্দ্রীভূত হয়েছে সেখানে।

আইন অনুযায়ী রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য রাজ্যপাল। সার্চ কমিটির সুপারিশ করা কয়েক জনের নামের প্যানেল থেকে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ করেন আচার্য। এই প্রশ্নে রাজ্যের মনোভাব ও উপাচার্যের ভূমিকা নিয়ে কমবেশি বিতর্ক মাঝে মধ্যে দেখা দেয়। কিন্তু সেটা এতটা কদর্যতায় কখনো যায়নি। তৃণমূলের জমানায় শিক্ষা অগ্রাধিকারের জায়গা থেকে সরে যাবার ফলে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ চরম অনীহা দেখা দেয়। পঠন-পাঠনে শুরু হয় অরাজকতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা তুলে দিয়ে দলের কুক্ষিগত করা হয়। কলেজ বিশ্ববিদালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে ইউনিয়নের নামে দলের বহিরাগত দুষ্কৃতীদের আখরা বানানো হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসক দলের আধিপত্য কায়েমে জরুরি হয়ে পড়ে প্রশাসনের খবরদারি। প্রতিষ্ঠানে প্রধান অনুগত না হলে সেটা সম্ভব নয়। চুরি-দুর্নীতিতে সায় নিয়ে অনুগত প্রধান হবার লোক না মেলায় প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, উপাচার্যহীন হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানগুলি। চলতে থাকে অযোগ্য অনুগতদের দিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চালানো। একসময় সেটা মিলছে না। তখন একজনকে একাধিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় বসানো হয়। রাজ্যের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাটাই পুরোপুরি ভেঙে পড়ার জোগাড়।

এই অচলাবস্থার মধ্যে আসরে নামেন রাজ্যপাল। কেন্দ্রীয় শাসক দলের হয়ে রাজ্যপাল আধিপত্য কায়েমে অতি সক্রিয় হয়ে পড়েন। উপাচার্যহীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তিনি নিজের মতো করে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করতে থাকেন। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যাদের কোনও যোগাযোগই নেই তাদের ধরে এনে বসিয়ে দেন উপাচার্য করে। অন্যদিকে রাজ্য সরকার বিধানসভায় বিল পাশ করায় রাজ্যপালের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালগগুলির আচার্য করতে। রাজ্যপাল সেই বিলে স্বাক্ষর না করে ফেলে রাখেন এবং নিজেই রাজ্য সরকারকে বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা শুরু করেন। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দ মতো আরএসএস’র লোকদের উপাচার্য নিয়োগ করেন। শেষে লোক খুঁজে না পেয়ে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকেই নিজে উপাচার্য নিয়োগ করেন। রাজ্য-কেন্দ্র তথা মুখ্যমন্ত্রী-রাজ্যপাল সংঘাতের জেরে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাটাই উঠে যেতে বসেছে। ফলে পড়ুয়ারা বাধ্য হচ্ছে অন্য রাজ্যে চলে যেতে এবং বিপুল অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। তৃণমূল-বিজেপি’র তথাকথিত সংঘাতের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীর ষড়যন্ত্র আসলে রাজ্যের উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে বেসরকারি পুঁজির শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যপাল সেটাই করে যাচ্ছেন।

Comments :0

Login to leave a comment