Uno Gaza

সংঘর্ষ বিরতির পক্ষে ভোট দিল না ভারত

আন্তর্জাতিক

গাজায় সংঘর্ষ বিরতি চেয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিল না ভারত। শুক্রবার রাতে জর্ডানের পেশ করা এবং বিপুল সংখ্যাধিক্যে গৃহীত এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘আশু ও দীর্ঘমেয়াদী মানবিক যুদ্ধবিরতি হোক, বৈরিতার অবসানের লক্ষ্যে অগ্রগতি ঘটানো হোক’। গাজায় ইজরায়েলের আক্রমণ যে-রাতে চরমে পৌঁছলো, সমগ্র গাজাই কার্যত অগ্নিবলয়ে পরিণত হলো, সে-রাতেই সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত রইল ভারত। অজুহাত, ওই প্রস্তাবে ‘হামাসের কথা নেই’। 
২২টি আরব দেশ এই প্রস্তাবের খসড়া করেছিল। জর্ডান প্রস্তাবটি পেশ করে। এখনই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে গাজায় মানবিক সাহায্য পাঠানোর আহ্বান ছিল প্রস্তাবে। প্যালেস্তাইনের জনগণকে জোর করে স্থানান্তর করা যাবে না, বলা হয়েছিল তা-ও। প্রস্তাবে বিনাশর্তে সমস্ত বন্দিদের মুক্ত করার কথাও ছিল। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়। ইজরায়েল আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, এই প্রস্তাবের জায়গা হবে ‘ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে’। কিন্তু বিশ্ব জনমতের একটি প্রতিফলন মেলে এই প্রস্তাবের ওপরে ভোটাভুটিতে। দেশগুলির অবস্থানও স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রস্তাবের পক্ষে পড়েছে ১২০ ভোট, বিপক্ষে ১৪, ভোটদানে বিরত থেকে ৪৫টি দেশ। 
ইজরায়েল ছাড়া এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভোটাভুটির সময় এই দুই দেশ ছাড়া ১২টি মাত্র দেশের প্রতিনিধি বিপক্ষে ভোট দেয়। তার মধ্যে ফিজি, টোঙ্গা, মার্শাল ‌আইল্যান্ডস, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পাপুয়া নিউ গিনি রয়েছে। সবই প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র। এমনকি এই সংঘাতে ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ানো ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়নি। ফ্রান্স পক্ষেই ভোট দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির অনেকে প্রস্তাবের পক্ষে, অনেকে বিরত থেকেছে। বিরুদ্ধে ভোট পড়েছে সদস্য রাষ্ট্রগুলির মাত্র ৭ শতাংশের। 
ইজরায়েল সংঘর্ষ বিরতি চায় না, শুক্রবার রাতেই বর্বরতম আক্রমণ চালিয়েছে তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সংঘর্ষ থামুক, তা চায় না। সামরিকভাবেও তারা ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ভারত কেন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিল না? রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারতের উপ স্থায়ী প্রতিনিধি যোজনা প্যাটেল যুক্তি দেখিয়েছেন, প্রস্তাবে হামাসের নাম নেই। তাদের নিন্দা না করে কোনও প্রস্তাবে ভারতের সায় নেই। প্যাটেল তাঁর ভাষণে গাজার সঙ্কটময় পরিস্থিতির কথা কার্যত অবজ্ঞা করে ‘সন্ত্রাসবাদ’ নিয়েই বলতে থাকেন। তিনি বলেন, ইজরায়েলে ৭ অক্টোবর যে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয়েছে তা মারাত্মক, তার নিন্দা করা উচিত। যাঁরা বন্দি তাঁদের কথাও আমাদের চিন্তায় রয়েছে। তাঁদের অবিলম্বে এবং নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে (প্রস্তাবে কিন্তু এই কথা ছিল)। সন্ত্রাসবাদ ক্রমবর্ধমান, তা কোনও সীমান্ত, জাতি বা রাষ্ট্র মানে না। সন্ত্রাসবাদী কাজের সপক্ষে কোনও যুক্তিই বিশ্বের মেনে নেওয়া উচিত না। মতপার্থক্য সরিয়ে সন্ত্রাসবাদকে কোনোভাবেই সহ্য না করার অবস্থান নেওয়া উচিত। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই অধিবেশন স্পষ্ট বার্তা পাঠাক। প্যাটেল বলেন, এই অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতিতে ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন (ইজরায়েলের নাম এবার মুখে আনেননি), চলতি সংঘর্ষে সাধারণ নাগরিকদের বিপুল প্রাণহানি হচ্ছে (এবার গাজার নাম উচ্চারণ করেননি)। সকলেরই উচিত দায়িত্বশীল হওয়া। এইসঙ্গে একটি বাক্যে তিনি জানান, ভারত ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন প্রশ্নে আলোচনার মাধ্যমে দুই রাষ্ট্রের সমাধানসূত্রকে সব সময়েই সমর্থন করেছে (এই সমাধানসূত্র ইজরায়েল মানেনি, রাষ্ট্রসঙ্ঘের ৩০টি প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছে)। প্রস্তাবে সমস্ত ধরনের সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা হয়েছে, ইজরায়েলী নাগরিকদের ওপরে আক্রমণেরও নিন্দা করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতের প্রতিনিধি সংঘর্ষবিরতি চেয়ে ১২০ দেশের সঙ্গে গলা মেলাতে পারলেন না। 
লক্ষণীয়ভাবে, মার্কিন প্রতিনিধিও ‘ অশুভ শক্তির নাম বাদ দেওয়ার’ কথা বলেছেন। তাঁর যুক্তি এবং ভারতের প্রতিনিধির যুক্তি প্রায় একই রকম ছিল। ইজরায়েলী প্রতিনিধি এক ধাপ এগিয়ে বলেন, সংঘর্ষ বিরতি হওয়ার অর্থ হামাসকে পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ করে দেওয়া। 
এই সংঘাতের শুরু থেকেই ভারত বিভ্রান্তিকর অবস্থান নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিবৃতিতে শুধু ইজরায়েলে হামলার নিন্দাই করা হয়েছিল, প্যালেস্তাইনে লাগাতার হামলা ও ভূমি দখলের প্রশ্ন উল্লিখিত হয়নি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে, বিশেষ করে আরব দেশগুলিতে ক্ষোভ তৈরি হলে বিদেশ মন্ত্রক আবার একটি বিবৃতি দেয়। সেখানে ভারতের পুরানো অবস্থান মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কূটনীতির পরিভাষায় তা ছিল ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’। ইতিমধ্যে পরিস্থিতিরও পরিবর্তন হয়। ইজরায়েলের একটানা বোমাবর্ষণে ৭ হাজারের বেশি গাজার অধিবাসী নিহত হন, যাদের অধিকাংশই শিশু ও মহিলা। গাজায় প্রায় ২ লক্ষ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়, ১৪ লক্ষ মানুষ গৃহচ্যুত হন। গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে সংঘর্ষ বিরতি, মানবিক সাহায্য পাঠানোর জন্য সাময়িক বিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করে বিভিন্ন দেশ। কিন্তু ভারতের তরফ থেকে নীরবতা চলছেই। পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মঞ্চে ভারতকে কেউ ডাকছেও না, ভারতের কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগও থাকছে না। মার্কিন রণনীতির সঙ্গী হয়ে ভারত যেমন ইজরায়েলী আক্রমণের নিন্দা করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনই দেশের মধ্যে হিন্দুত্ববাদীদের কারণে ইজরায়েলের জায়নবাদী মনোভাবের পাশে দাঁড়াচ্ছে সরকার। বস্তুত ইজরায়েলের পক্ষে ভুয়ো প্রচারের বড় উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের সোশাল মিডিয়া। তা আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছে।

Comments :0

Login to leave a comment