মণ্ডা মিঠাই — নতুনপাতা
সেখশুভোদয়া : প্রথম বাংলা পীরসাহিত্য
আমির উল হক
একদা বাংলার রাজধানী গৌড় কে কেন্দ্র রাজ্যের সমাজনীতি, রাস্ট্রনীতি, ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত আচার - আচরণ, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ও ইসলামী সংস্কৃতির পারস্পরিক সহাবস্থানে গৌড় বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট ছিল। এই সময় গৌড়ে বেশ কয়েকজন সুফিপীর ও ফকিরের আগমন ঘটে। ধর্ম বিষয়ে তাঁদের অসাধারণ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের কারণে সকলের কাছেই তাঁরা ছিলেন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণ সেন এর আমলে জালালুদ্দিন তবরিজি নামক একজন সুফি রাজ অনুগ্রহ লাভ করেন। আমাত্যদের বিরোধিতা সত্বেও রাজা লক্ষ্মণ সেন সুফি পীর জালালুদ্দিন তবরিজির অলৌকিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গৌড়ে সামাজিক নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করেন ও প্রচুর ভূসম্পত্তি দান করেন। সমকালীন নানা গল্প কথা, কাহিনি, প্রচলিত উপাখ্যান ও কিংবদন্তি নিয়ে সেই সময়ে " সেখশুভোদয়া " শীর্ষক গৌড় দেশে প্রথম বাংলা ভাষায় পীর সাহিত্য রচিত হয়। এই পুঁথি সঠিক রচয়িতা কে, তা নিয়েও দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়। রাজা লক্ষ্মণ সেন এর সভাকবি হলায়ুধ মিশ্র এই "সেখশুভোদয়া" পুঁথির রচয়িতা বলে অনুমিত হয়। আবার এই পুঁথির 'পুষ্পিকা' অংশে জানা যায় -- জনৈক জগন্নাথ রায়ের পাঠের জন্য রামচন্দ্র শর্ম্মা এই পুঁথি রচনা করেন। বাংলা ছড়া ও বাংলা প্রবাদের মতন এই "সেখশুভোদয়া" পুঁথিটিও ৩ -- ৪ বার পরিবর্তিত হয়। ফলে মূল পুঁথির জৌলুস অনেকটাই কমে যায়। এই পুঁথি মুলতঃ গৌড়ের একটি প্রাচীন পীরকাব্য ও সুফিপীর জালালুদ্দিন তবরিজির পীরমাহাত্ম্য গাথা বর্নিত রয়েছে। রাজা লক্ষ্মণ সেন এর রাজসভার সমকালীন নানান ঘটনা, গল্পগাথা ও সমসাময়িক
সমাজচিত্রের প্রতিফলন দেখা যায় এই পীরসাহিত্যে। মোট ২৫টি পরিচ্ছেদে রচিত এই "সেখশুভোদয়া " পুঁথিটির প্রথম সন্ধান পান মালদহ জেলার পুঁথি বিশেষজ্ঞ হরিদাস পালিত। গৌড়ের বাইশহাজারী মসজিদের জনৈক মোতোয়ালির কাছে তা রক্ষিত ছিলো। হরিদাস পালিত ও মালদহের তৎকালিন জেলা শাসক উমেশচন্দ্র বটব্যাল এটি উদ্ধার করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক সুকুমার সেনের সম্পাদনায় হৃষীকেশ সিরিজ, ১১ সংখ্যা শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে অধ্যাপক সুকুমার সেন এর সম্পাদনায় পুনরায় এই পুঁথি প্রকাশিত হয়। পীরকেন্দ্রিক কাহিনি, অলৌকিকত্ব, সমাজচিত্র, লৌকিক দেব - দেবী, লোকাচার সমাহারে "সেখশুভোদয়া " বাংলা মঙ্গলকাব্যধারার অন্যতম প্রাচীন পুঁথি। বাংলা ভাষার প্রথম পীরমঙ্গল কাব্য হিসেবে এই "সেখশুভোদয়া " পুঁথির গুরুত্ব অপরিসীম।
Comments :0