PROBANDHAY — ARIJIT MITRA — KAZI NAZRUL ISLAM — MUKTADHARA — 29 MAY 2025, 3rd YEAR

প্রবন্ধ — অরিজিৎ মিত্র — কাজী নজরুল ইসলাম : সংগীত ও সাংবাদিকতায় জাতিসত্তার নির্ভীক স্রষ্টা — মুক্তধারা — ২৯ মে ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

PROBANDHAY  ARIJIT MITRA  KAZI  NAZRUL ISLAM  MUKTADHARA  29 MAY 2025 3rd YEAR

প্রবন্ধমুক্তধারা, বর্ষ ৩

কাজী নজরুল ইসলাম : সংগীত ও সাংবাদিকতায় জাতিসত্তার নির্ভীক স্রষ্টা 
অরিজিৎ মিত্র 
 

 
ভূমিকা 
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলাম এক বহুমাত্রিক বিস্ময়। যদিও তাঁকে সাধারণভাবে "বিদ্রোহী কবি" হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়, তবুও তাঁর রচনাশৈলী শুধুমাত্র কাব্যচর্চায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী সংগীতজ্ঞ, যিনি বাংলা সংগীতকে উপমহাদেশীয় সুরসাধনার কেন্দ্রে নিয়ে যান, এবং একাধারে একজন অগ্রগামী সাংবাদিক, যিনি কলমের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। এই প্রবন্ধে তাঁর সংগীত ও সাংবাদিকসত্তার গভীর বিশ্লেষণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উপস্থাপন করা হবে।

 

সংগীতে নজরুল: রাগের সৌন্দর্যে বিপ্লবের স্পন্দন

নজরুল সংগীত কেবলমাত্র রোমান্টিক বা আধ্যাত্মিক চেতনার বাহক নয়—এটি ছিল তাঁর জাতিগত চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের এক রূপান্তরিত মাধ্যম। প্রায় ৪০০০ গান রচনার পাশাপাশি তিনি নিজেই বহু গানে সুর সংযোজন করেন, যা পরবর্তীতে নজরুলগীতি নামে পরিচিত হয়। তার গানগুলো রাগাশ্রিত, তালবদ্ধ ও সাহিত্যের সৌন্দর্যে অনন্য।

গজলের জনক হিসেবে তাঁর অবদান

উল্লেখযোগ্য যে, কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় ইসলামী গজলচর্চার পথিকৃৎ। আরবি-ফারসি ও উর্দু ঘরানার সুরকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর করে তিনি যে সাংস্কৃতিক সমন্বয় সৃষ্টি করেছিলেন, তা ছিল ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার বৃহত্তর অভিযাত্রার অংশ। তাঁর রচিত বিখ্যাত গজল—
“নামাজে দাঁড়ায়ে থাকি, একা আমি চুপটি চুপটি”,
“বুলবুলি নাই বাগে মোর, ফুল ঝরিছে ডালে”—
এসব গান নিছক ধর্মীয় আবেগ নয়, বরং ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধি, আত্মার মুক্তি এবং একটি সৌন্দর্যনির্ভর দার্শনিক ভাবনার প্রকাশ।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রসঙ্গের অনুরণন

নজরুলের গান শুধুমাত্র সুরবিন্যাসের নিপুণতা নয়, বরং তা ছিল জাতীয় চেতনার এক সংগীতায়িত রূপ। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘জাগো অনশন বন্দী’, ‘ভাঙার গান’—এসব গান নিপীড়িত জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ার পরও তিনি থেমে যাননি; বরং আরও গভীরভাবে সংগীতের মাধ্যমে আন্দোলনের ভাষা সৃষ্টি করেন। তাঁর গানে বারবার ফিরে আসে ‘উদিত সূর্য’, ‘জাগরণ’, ‘তুফান’—এ সব প্রতীক ছিল ভবিষ্যতের মুক্তি ও জাগরণের আশাবাদী দিশা।


*সাংবাদিকতায় নজরুল: ‘ধূমকেতু’র শিখায় মুক্তির আহ্বান

১৯২২ সালে তিনি সম্পাদনা করেন ‘ধূমকেতু’, একটি দ্বৈত-সাপ্তাহিক পত্রিকা, যেটি খুব অল্প সময়ের মধ্যে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের নবজাগরণবাদী যুবসমাজের মর্মভেদী উচ্চারণে পরিণত হয়। এই পত্রিকার প্রতিটি সম্পাদকীয় ছিল সাহিত্যিক মুন্সিয়ানা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বিরল সমন্বয়।

‘ *আনন্দময়ীর আগমনে’:* *বিপ্লবী সাংবাদিকতার চূড়ান্ত রূপ

১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূমকেতু’-তে প্রকাশিত সম্পাদকীয় “আনন্দময়ীর আগমনে” ছিল নজরুল সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। সেখানে তিনি লেখেন:

> "ভারতবর্ষ আজ এক জীবন্ত মৃত্যু-পুরী। এখানে প্রতিটি প্রাণ স্তব্ধ, প্রতিটি চেতনা ঘুমন্ত। আমি সে ঘুমন্ত চেতনার মাঝে বজ্রের মতো আঘাত হানতে চাই।"

 

এই লেখার কারণে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিন মাস জেল খাটতে হয়। কারাবন্দি অবস্থায় রচিত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ একাধারে আত্মদর্শনের দলিল এবং রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রতিবাদ।

পত্রিকা ও সম্পাদকীয়ের বহুমাত্রিক প্রভাব

‘ধূমকেতু’ ছাড়াও নজরুল ‘লাঙ্গল’ ও ‘গণবাণী’ নামক পত্রিকায়ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রচার করেন। এই পত্রিকাগুলোতে দারিদ্র্য, কৃষক শোষণ, নারীর অধিকার এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নিয়ে তাঁর লেখাগুলি আজও গবেষণার বিষয়।

 

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নজরুলের সংবাদ ও সংগীতচর্চা

নজরুলের সংগীত ও সাংবাদিকতা ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যবর্তী এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তাল সময়ে গড়ে ওঠে। ভারতবর্ষ তখন ঔপনিবেশিক দমন-পীড়নের অধীনে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে, সমাজে ধর্মীয় বিভাজন, নারীর অধিকার সংকুচিত, এবং ভাষা ও সংস্কৃতি প্রশ্নে বিভ্রান্তি স্পষ্ট।

এই সময়ে নজরুল যে কণ্ঠস্বর তৈরি করেছিলেন, তা ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ছিল ভয়ানক, আর সাধারণ মানুষের জন্য হয়ে উঠেছিল সাহসের বাতিঘর। গান ও পত্রিকার মধ্য দিয়ে তিনি নিম্নবর্গ, কৃষক, শ্রমজীবী মানুষের ভাষায় তুলে ধরেছেন তাদের যন্ত্রণাকে।


উপসংহার

~বিদ্রোহের সুর ও কলম~

(কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত ও সাংবাদিকতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি)

জেগে ওঠে সুর—তাল, রাগে বাঁধা,
বিদ্রোহী মন ছন্দে গাঁথা।
গজলের মালায় প্রেমের শিখা,
ধর্ম নয়, মানবিকতা মুখ্য ভাষা।

কলম ছিল তাঁর বজ্রের ধারা,
"ধূমকেতু" নামে কাঁপে কারা।
আনন্দময়ীর অগ্নিঝরা পাতা,
ভয়হীন কণ্ঠে মুক্তির কথা।

গানে যেমন জাগে অগ্নিস্নান,
"কারার ঐ লৌহ কপাট" হানে হুঙ্কার গান।
বন্দী কণ্ঠে গর্জে উঠে বাণী,
"ভাঙার গান"-এ জাগে জনের প্রাণ।

সাংবাদিকতায় রণতূর্য বাজে,
শব্দে শব্দে প্রতিবাদের সাজে।
লাঙ্গল-গণবাণী, কৃষকের ডাক,
সমতার স্বপ্নে থামে না হাঁটাক।

নজরুল শুধু নাম নয়, নীতি,
শব্দে ও সুরে জাগে জাগৃতি।
সেই কণ্ঠ আজও জাগায় আলো,
সংগ্রামে, প্রেমে, উজ্জ্বল ভালো।


নবম শ্রেণী, কল্যাননগর বিদ্যাপীঠ, খড়দহ, 
কল্যাননগর, খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা

Comments :0

Login to leave a comment