Souronil

সৌরনীল ‘নেই’, বিশ্বাসই হচ্ছিল না মায়ের

রাজ্য কলকাতা

 রক্তাক্ত এবং গুরুতর জখম অবস্থাতেই পকেট থেকে কোনওক্রমে ফোন বের করে সরোজ কুমার সরকার তাঁর স্ত্রী দীপিকাকে শুধু বলতে পেরেছিলেন, ‘‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেল, ছেলে আর নেই।’’ প্রথমটায় যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, তারপরেই গগনভেদী আর্তনাদ আর কান্নায় প্রায় মুর্ছা গিয়েছিলেন মা। ঘাতক লরিটি ততক্ষণে ‘কীভাবে যেন’ পুলিশের ঘেরাটোপ নিরাপদে পার করে ছুটে চলেছে হাওড়ার দিকে! 


সকাল ৭টা বেজে ১০ মিনিট। বেহালা চৌরাস্তার মোড়ে পুলিশ ফাঁড়ির একেবারে কাছে সিগনাল ভেঙে চোখের পলকে গায়ের উপর আছড়ে পড়লো মাটিবোঝাই লরিটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অসহায় বাবা দেখলেন, তাঁর আদরের সন্তান মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তায়। তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে সাত বছরের একরত্তি দেহটা। মাথা থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে রক্ত, ছড়িয়ে পড়েছে ঘিলু। ঘাতক লরির চাকা তাঁর নিজেরও দু’পায়ের উপর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। অনেক দূরে দু’-একজন পুলিশকর্মী আছেন বটে, কিন্তু তাদের তেমন কোনও গরজ তখনও দেখা যায়নি। 
মায়ের কাছে ফোন গিয়েছিল বড়িশা স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের হেডস্যারের কাছ থেকেও। উদভ্রান্ত অবস্থায় কোনও মতে ছুটে গিয়েছিলেন স্কুলে। শুনলেন, ছেলের দেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে। সেখানেও পৌঁছেছিলেন ছেলেকে শেষ দেখা দেখার জন্য। হাসপাতালে বসে ছেলের ব্যাগ আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘‘স্কুল থেকে স্যার ফোন করে জানালেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুলে চলে আসুন। খুব দরকার। ছেলেটার পরীক্ষা ছিল সাড়ে সাতটা থেকে। আমি ভাবলাম, কিছু হয়ত নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে। তার কিছুক্ষণ পরে ওর বাবা ফোন করে বললো, আমাদের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সব শেষ হয়ে গিয়েছে।’’


পূর্ব বড়িশার নবপল্লীর আরএন টেগোর রোডে তখন তীব্র শোকের ছায়া। নবপল্লী খেলার মাঠ থেকে কিছুটা এগিয়ে মূল রাস্তা থেকে একটি শাখা বেরিয়ে গিয়েছে। পাড়ায় হাতে গোনা ৩-৪ টি বাড়ি। রাস্তার একদম শেষে সৌরনীলদের বাড়ি। বাড়ির নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে নাম। সেখানেই শুক্রবার সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ শেষবারের মতো শববাহী গাড়িতে চড়ে বাড়িতে এল ছোট্ট সৌরনীল। ওদিকে তখন গুরুতর জখম অবস্থায় এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে বাবা সরোজ কুমার সরকারের। ঠাকুরপুকুর বাজারে একটি ছোটো দোকান চালাতেন তিনি। ফের কবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দোকানে যেতে পারবেন, জানেন না কেউই।  
সারা দিন ধরেই সৌরনীলের বাড়ির সামনে ছিল প্রতিবেশীদের জটলা। সেই জটলার আক্ষেপ, ছেলেটা স্কুলে যেতে খুব ভালোবাসত। তাঁদের চোখে ভাসছে, সকালবেলা বাবার হাত ধরে সৌরনীলের স্কুলে যাওয়া। কখনও বাবা, আবার কখনও দাদুর সঙ্গেও স্কুলে যেত সৌরনীল। বিকেলে খেলতে যাওয়ার সঙ্গী ছিলেন দাদু। ঘটনার আকস্মিকতায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সৌরনীলের দাদুও। কোনও দিন তাঁর কাছে কেউ যে আর বেড়াতে যাওয়ার আবদার করবে না। কেউ আর বাড়িতে কারও কাছে বলবে না, পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর এটা ওটা কিনে দিতে হবে কিন্তু।   


নিজের ছাত্রের মৃত্যুর প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘‘বারবার আমরা পুলিশ প্রশাসনকে বলেছি স্কুলের সামনে ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করার কথা। সে কথা শোনা হয়নি। এক হাজার ছাত্র পড়ে এই স্কুলে। তাহলে নিরাপত্তা দেবে না সরকার? কিছু দূরে কয়েকটি বেসরকারি স্কুল আছে। সেখানে তো ট্রাফিক গার্ডের ব্যবস্থা রয়েছে। এই বাচ্চারা কী অপরাধ করলো? তারা গরিব ঘর থেকে আসে বলে বৈষম্যের শিকার হবে? প্রতিদিন যানজটে জেরবার হতে হয়, যন্ত্রণাদায়ক রাস্তা পার হয়ে ছাত্রদের স্কুলে ঢুকতে হয়।’’
এলাকার বাসিন্দা ও অভিভাবক অভিরূপ নস্করের অভিযোগ, ‘‘এখানে হামেশাই দুর্ঘটনা ঘটে। এই বেহালা চৌরাস্তা মোড়েই রয়েছে বড়িশা হাই স্কুল, বরো ১২৩’র স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বেহালা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া, মহিলাদের কলেজ, বেসরকারি চক্ষু হাসপাতাল, কয়েকটি ডায়গনস্টিক সেন্টার, অসংখ্য ছোটবড় দোকানপাট, বাজার, বেশ কয়েকটি অটো স্ট্যান্ড। সর্বোপরি নবনির্মিত মেট্রো স্টেশনের পরিত্যক্ত যাবতীয় লোহালক্কড়, জঞ্জাল। এরকম ঘিঞ্জি এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যে প্রায় কিছুই নেই, তা প্রতিদিন আমরা দেখছি।’’ আরেক অভিভাবক সীমা প্রধানের গলাতেও একই অসন্তোষের সুর। দুর্ঘটনার পরে ঘাতক লরিটি যেভাবে নির্বিঘ্নে কলকাতা ছাড়িয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে পর্যন্ত চলে যেতে পারলো, তাতেই ট্রাফিক পুলিশের ‘কর্মদক্ষতা’ স্পষ্ট হচ্ছে, বলছেন এলাকার ক্ষুব্ধ মানুষ।

 

Comments :0

Login to leave a comment