গল্প — নতুনপাতা, বর্ষ ৩
চপ
সৌরীশ মিশ্র
জানলার দুটো লোহার শিক ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল অর্ক। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। সব ঋতুর মধ্যে অর্কর বর্ষাকাল সব চাইতে প্রিয়। বৃষ্টি খুব ভাল লাগে ওর। বৃষ্টি দেখতে, বৃষ্টিতে ভিজতে, দারুণ লাগে অর্কর। কিন্তু, এই মুহূর্তে বৃষ্টি দেখতে মোটেই ভাল লাগছে না ওর। লাগবে কিভাবে! ওর যে মনটা খারাপ হয়ে আছে খুব। আসলে, অভিমান হয়েছে অর্কর ওর বাবার উপর।
এই একটু আগের কথা। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হবে হবে করছে। অর্ক ওর ঘরে বসে স্কুল লাইব্রেরি থেকে ক'দিন আগে নেওয়া রাসকিন বন্ডের বইটা পড়ছিল। তখুনি ও খেয়াল করল, ওর বাবা কোথায় যেন বেরোনোর তোড়জোড় করছে। ঐ দেখে অর্ক জিজ্ঞেস করেছিল ওর বাবাকে, "কোথায় যাচ্ছ বাবা?"
"মার্কেটে।"
"আমিও যাব।"
"না। যা মেঘ করেছে, ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে এক্ষুনি। তুই এই দু'দিন আগে জ্বর থেকে উঠলি। আবার বৃষ্টিতে ভিজলে রিলাপ্স করতে পারে। আর তাছাড়া, আমি যাব আর আসব। তুই গল্পর বইটা পড়ছিস, পড়্।" এইটুকু বলেই মোটরবাইকের চাবিটা টেবিলের ওপর থেকে নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন অর্কর বাবা।
বাবা ওকে নিয়ে যাইনি, আর তাতেই বাবার উপর অভিমান হয়েছে ছোট্ট অর্কর। বাবা চলে যেতে সে মনে মনে ভেবেছিল, ওকে নিয়ে গেলে, কি আর এমন হোতো! বৃষ্টি এলে একটু হয়তো ভিজে যেতো ও। তাতেই জ্বরটা আবার ফিরে আসতো ওর! মোটেই না।
আর এই সব ভাবছিল যখন অর্ক, ঠিক তখুনি, বৃষ্টিটা শুরু হয়েছিল আচমকাই, এবং খুব জোড়েই। ওর বিছানায় আধশোয়া হয়ে গল্পের বইটা পড়ছিল অর্ক। বইটা বিছানার উপর রেখে খাট থেকে নেমে পায়ে-পায়ে এই ঘরের বাঁদিকে যে বড় জানলাটা আছে সেটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল অর্ক বৃষ্টি দেখবে বলে। সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তা চলছে এখনও। এবং, তা মুষলধারাতেই।
কয়েক মিনিট কাটল আরো। এখনও জানলার ধারেই দাঁড়িয়ে আছে অর্ক। আর তখুনি, অর্ক দেথল ওর বাবার বাইকটা এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। সে এও দেখতে পেল, বাবা পুরো ভিজে গেছে। অর্ক এক ছুটে গিয়ে বাড়ির দরজাটা খুলে অপেক্ষা করতে থাকল বাবার জন্য।
বৃষ্টি থামার তো নয়ই, কমারও কোনো নাম নেই। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে খুব জোড়। মিনিট খানেকের মধ্যেই অর্কর বাবা বাইকটা গ্যারেজে রেখে একপ্রকার দৌড়েই বাড়িতে এসে ঢুকলেন।
"বাবা, তুমি তো পুরো ভিজে গেছো।"
"হ্যাঁরে।"
"মার্কেট তো সেই বিকেলেই খুলে যায়, তখনই যদি যেতে, তবে তো ভিজতে না তুমি বাবা।"
"কিন্তু, চপের দোকান যে সন্ধ্যে না হলে খোলে না। তোর জন্য চপ আনতেই তো গেছিলাম। তুই তো খেতে ভালবাসিস। জ্বরের পর থেকে তো কিছুই খেতে চাইছিস না। খাবার দেখলেই, মুখে স্বাদ নেই, মুখে স্বাদ নেই, বলছিস। চপটা মনে হয় খেতে ভাল লাগবে তোর। তাই আনলাম। এই নে।" বলতে বলতেই প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগে মোড়া চপের ঠোঙাটা ছেলের দিকে এগিয়ে দেন অর্কর বাবা।
অর্ক হাতে নেয় ঠোঙাটা। প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগটা বৃষ্টিতে একটু ভিজলেও চপের ঠোঙাটা এখনও বেশ গরম।
বাবা ওর জন্য ওর প্রিয় চপ নিয়ে এল বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে! আর সে কিনা এতক্ষণ অভিমান করে বসেছিল বাবারই উপর! অর্ক আর নিজেকে সামলাতে পারে না। সে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে ওর বাবাকে।
"আরে, কি হোলো রে তোর! ছাড়্, ছাড়্। তোর জামাটা ভিজে গেল তো পুরো। কি রে, ছাড়্?"
"না ছাড়বো না।" বাবাকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই অস্ফুটে বলে অর্ক। আর বলেই আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সে তার বাবাকে।
"একেবারে পাগল ছেলে আমার!" ছেলের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে, অর্কর মাথার চুলে দ্রুত হাত চালিয়ে অর্কর চুল আদর করে এলোমেলো করে দেন ওর বাবা।
অর্কর যে কি আনন্দ লাগে বাবার ওই আদর খেয়ে, তা ওই শুধুমাত্র জানে।
Comments :0