দেবাশিস আচার্য
২৮ জুলাই তামান্নার জন্মদিন। পরিযায়ী শ্রমিককন্যা তামান্নার জন্মদিন। মা সাবিনার গলা জড়িয়ে ধরে ছোট্ট তামান্না বলেছিল, ‘এবারের জন্মদিনে তার বন্ধুদের ডেকে কেক কেটে পায়েস খাওয়াতে হবে। জন্মদিনের সকালে লাগাতে হবে গাছ। আর তার প্রিয় লাল রঙের বেলুন দিয়ে সাজাবে তাদের ছোট্ট ঘরের বারান্দা।’ চোখের জল মুছতে মুছতে একথা বার বার বলে চলেছেন সদ্য কন্যাহারা সাবিনা। তামান্না বেঁচে থাকলে এ মাসের আঠাশে দশে পা দিতো।
পাঁচ পাঁচটি সন্তানের মৃত্যুর পর পরিযায়ী শ্রমিক হোসেন আর সাবিনার ঘর আলো করে জন্মানো ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটার নাম রাখা হয়েছিলো তামান্না। তামান্না মানে ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা। ২৩ জুন দুপুরে স্নানের আগে মার সঙ্গে কাদা মাখা উঠোনে ফুলের গাছ লাগাছিল তামান্না। হঠাৎ মোলান্দি গ্রাম জুড়ে কান ফাটানো মুহুর্মুহু বোমার শব্দ। ক্রমশ সেই শব্দ গ্রামের পাকা রাস্তা পেরিয়ে গলি আলপথ ধরে ওদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছিল। কিছু বোঝার আগেই তামান্নার সাজানো বাগানের অদূরে গ্রামের ত্রাস তৃণমূলী দুষ্কৃতী গাওয়াল আর তার লোকজন বোমা হাতে চিৎকার করে উঠলো, ঝেড়ে দে হুসেনের মেয়ে, বৌকে। হঠাৎ কান ফাটানো আওয়াজে চারিদিক ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। সাবিনার পিঠে অসহ্য জ্বালা, কিছু বোঝার আগেই দেখলে উঠোনের মাটিতে লুটিয়ে আছে তাঁর আদরের তামান্না। বুক ফেটে ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সাবিনার বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটা তখন রক্ত মাখা মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে আছে সেই সাজানো বাগানের অদূরে।
গত ১৯ জুন ছিল কালীগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচন। গত কয়েক বছরে মোলান্দি সহ কালীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামে ভোটের নামে নজিরবিহীন দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি আর বোমা গুলির রাজত্ব কায়েম করেছে তৃণমূল। তৃণমূলের সেই জয়ের প্রধান কারিগর আসলে বোমা বন্দুকধারী দুষ্কৃতী আর পুলিশ। এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ভোটে জিতে বলেছিলেন না তিনি গুন্ডা কন্ট্রোল করেন। কালীগঞ্জ ব্লকের বিভিন্ন গ্রামে আসলে গুন্ডারাই তৃণমূলকে কন্ট্রোল করে। মোলান্দির তৃণমূল যেমন গাওয়াল বাহিনীর কন্ট্রোলে। পুলিশের সহায়তায় তোলাবাজি, বেআইনি মাটি কাটার ব্যবসা করে এদের প্রাসাদের মতো বাড়ি হয়েছে। রাতে বোমার শব্দ প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা। গ্রামের মাঠে বাগানে বোমা পোঁতা থাকে। এরা এতোটাই বেপরোয়া, স্কুল বাড়ির ভেতরেও বোমা লুকিয়ে রাখে। শিক্ষক মশাইরাও স্কুলের দরজা খুলতে ভয় পান। এ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার মতো মোলান্দিতেও গ্রাম দখল তৃণমূলের হাতে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াই করে কয়েকটি বুথে বামেরা জিতেছে। এবারের উপনির্বাচনে তাই বাড়তি সতর্ক তৃণমূল। ভোটের আগে বাড়িতে বাড়িতে হুমকি দিয়ে রেখেছিল, বিরোধী দলের লোকেদের ভোট দিতে যেতে বাধা তৈরি করা হয়েছে সকাল থেকেই। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী ডেকে যে কয়েক ঘর লোক তৃণমূলের মূল ঘাঁটি মোলান্দির বেলে পাড়া থেকে তৃণমূলী গুন্ডাবাহিনীর নির্দেশ উপেক্ষা করে ভোট দিতে গিয়েছিল তাদের অন্যতম হোসেন শেখের পরিবার অন্যতম।
২৩ জুন ছিল কালীগঞ্জের উপ-ভোটের ফলাফল। বিজয়ী প্রার্থী জয়ের সার্টিফিকেট পাওয়ার আগেই মোলান্দি তো শুরু হয়ে যায় বিজয় উল্লাসের নামে সিপিআই(এম) সমর্থকদের বাড়ির দেওয়ালে তাজা সকেট বোমা ছোঁড়া। সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে দিলেও ছোট্ট তামান্না মায়ের সাথেই ছিল উঠোনে। তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের বোমা তার প্রাণ কেড়ে নিল।
আজ এক মাস পেরিয়ে গেল তামান্নার মৃত্যুর। তামান্নার মা সাবিনা আর পলাশি মোলান্দির সাথে গোটা কালীগঞ্জ থেকে সারা বাংলা তামান্নার খুনের ন্যায় বিচারের দাবিতে সোচ্চার। অথচ এই এক মাস পরেও এখনো চৌদ্দজন অপরাধী অধরা। মোলান্দির সব ঘটনা জানার পরেও গণনার দিন কোনও পুলিশি নিরাপত্তা থাকলে তামান্নাকে এভাবে ঝরে যেতে হতো না। আসলে থাকবেই বা কেন! পুরানো ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে তৃণমূল বুথ সভাপতি প্রকাশ্যে বলছে, তারা বোমা মারবে বিরোধীদের, পুলিশ কিছু করতে পারবে না, পুলিশ তার কথা শুনে চলে। তামান্নার মা সহ গ্রামের লোক ভয় ভেঙে এই ঘটনার পর বলেছেন, পুলিশের সঙ্গে ওদের দোস্তির কথা। আসলে পুলিশ-দুষ্কৃতী যৌথ বাহিনীই তৃণমূলের ভরসা। এরা না থাকলে যে তৃণমূল ভোকাট্টা হবে, সেটা আজ সবার জানা।
অপরাধীদের ধরার বদলে পুলিশ এই তো তৃণমূলের শহীদ দিবসের নাচা গানা মহাভোজের পরের রাতে মোলান্দির প্রতিবাদী মানুষ,যারা প্রথম দিন থেকেই সন্তান হারা পরিবারের পাশে থেকেছেন, বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন তাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছে। মহিলা পুলিশ ছাড়াই রাতের অন্ধকারে আসামি ধরার নামে আগাম নোটিস না দিয়ে প্রাচীর ডিঙিয়ে পাঁচ গাড়ি অস্ত্রধারী পুলিশ মহিলা শিশুদের উপর এই অত্যাচার চালিয়েছে। ন’বছরের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে পুলিশ লাঠিপেটা করে। আর এসবের পরেও নির্লজ্জ পুলিশের সাফাই , নবছরের শিশু আর তাঁর মা, জেঠি, পিসিরা পাঁচ গাড়ি অস্ত্রধারী পুলিশের কাজে বাধা দিয়েছে তাই পুলিশ আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগ করেছেন। তামান্নার মা স্পষ্টতই বলেছেন আমার প্রতিবেশীরা যেহেতু আমার লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, মিডিয়ায় মুখ খুলেছেন, তাই পুলিশ ওদের হেনস্তা করছে, ভয় দেখাচ্ছে।
সদ্য জেতা কালীগঞ্জের তথাকথিত প্রথম মহিলা বিধায়ক,যার জয়ের উল্লাসের বলি তামান্না, কন্যাহারা মায়ের পাশে যাওয়ার সময় পাননি একমাসেও। যদিও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ফুল হাতে তার হাসিমুখের ছবি নেট দুনিয়ায় ঘুরছে। তিনি এই সাত কিলোমিটার পথ তামান্নার বাড়িতে না যেতে পারলেও দেড়শো কিলোমিটার দূরের ২১জুলাইয়ের সমাবেশে গিয়েছেন। শহীদদের দুঃখে হাসিমুখে সমর্থকদের আবদার মিটিয়ে সেলফি তুলেছেন।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মহিলা, অথচ আজও একমাস পরেও এই নিহত শিশুকন্যার পরিবারের পাশে দাঁড়ালেন না, একটিবার শোকও প্রকাশ করলেন না। পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিনরাজ্যে বাংলাভাষী বলে আক্রান্ত হচ্ছে বলে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিলেন অথচ এই রাজ্যে কাজ না পাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক মোলান্দির হুসেন শেখের কথা বলতে পারলেন না,যে ওডিশার কাজে গিয়েছিলেন, সেই সুযোগে তার দলের বুথ সভাপতির বোমারু বাহিনী তার একমাত্র ছোট্ট তামান্নাকে খুন করল। তার প্রশাসন পরিযায়ী শ্রমিকদের পরিবারের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ এই সত্যটা বলার সাহস তিনি পেলেন না।
এ রাজ্যের শাসকের টাকার অভাব নেই, সব কিছুকে টাকা দিয়ে কিনতে চাই। এরাজ্যের কত তথাকথিত প্রতিবাদী কবি বুদ্ধিজীবী নেতা টাকা আর প্রলোভনে নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তি কবিতা গান কলম থেকে শিরদাঁড়া বেচে শাসকের দাসত্ব করছে। এসবের মধ্যেই এ রাজ্য দেখেছে আনিস খানের বাবার ইনসাফের লড়াই। অভয়ার মা বাবার সঙ্গে রাত জেগেছে বাংলার প্রতিবাদী মানুষেরা। কামদুনি থেকে নদীয়ার হাঁসখালির কিশোরীর নিষ্ঠুর পরিণতি দেখেছে এ বাংলা। তামান্নার মা সেই লড়াইয়ের মুখ আজ। শাসক এক গরিব পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবারকেও কেনার চেষ্টার কসুর করেনি। সাংবাদিকের ছদ্মবেশে তামান্নার বাড়িতে এসে ফোনে ধরিয়ে সরাসরি টাকা আর চাকরির অফার দেওয়া হয়েছে আইপ্যাকের তরফে। তৃণমূলের ডেবরার বিধায়কয়ের এনজিও ছদ্মবেশে এসে সটান সদ্য সন্তান হারা মায়ের হাতে টাকার খাম গুঁজে দেওয়ার ছবি তো গোটা দেশ দেখেছে। আর সেই সঙ্গে দেখেছে চোখের জলে আগুন জ্বালিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া। "আমার মেয়ের লাশ টাকা দিয়ে কিনতে চাইছেন,কত টাকা লাগবে আপনার, আমার মেয়েকে মানুষ করার জন্য জমানো টাকা আর জমি বেচে আপনার মুখ্যমন্ত্রীকে টাকা দিচ্ছি, পারবেন আমার মেয়েকে ফেরত দিতে।’ বাধ্য হয়ে বিধায়ককে বলতে হয়েছে আমি তৃণমূল বা সরকারের লোক হিসাবে না, এখানে এসেছি সামাজিক সংগঠনের নামে! টাকা আর চাকরির প্রলোভনে সব শিরদাঁড়া বিক্রি হয় না।
মোলান্দি আর পলাশী-কালীগঞ্জের প্রতিবাদী মানুষ তামান্নার মায়ের এই শোক শপথের লড়াইকে নিজেদের লড়াই করে নিয়েছে। আর কোনও তামান্নাকে ঝরে দিতে দেব না '—এই শব্দ আজ সকলের কথা। এ রাজ্যের সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা বিমান বসু তামান্নার মায়ের হাতে হাত রেখে সে কথাই তো বলে গেছেন,অভয়া থেকে তামান্না, এই অন্যায় আর না, এই দুঃশাসনের অবসান চাই।
দাঁতে দাঁত চেপে মোলান্দি লড়ছে,পলাশী-কালীগঞ্জ লড়ছে। রাজ্যের ছাত্র যুব নেতাদের সঙ্গে নদীয়ার প্রতিবাদী তরুণেরা তামান্নার শুভ্র সুন্দর ফুলের মতো হাসি মুখের ছবি নিয়ে উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের স্লোগান দিয়েছিল তার মৃত্যুর একসপ্তাহের মাথায়, তখন তামান্নার মা আর ফাঁকা ঘরে স্থির থাকতে পারেননি, ছুটে এসে তামান্নার ছবি বুকে জড়িয়ে চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়েছেন সেই ছবি। তারপর চোখের জল মুছে অনেক বলেছেন, তোমাদের বোন তামান্না, ওর খুনের বিচারের দাবিতে এই লড়াইয়ের ভার তোমাদের ওপর দিলাম।
তামান্নার কবরের মাটি সংগ্রহ করে রেখেছেন পলাশীর প্রতিবাদী মানুষ। শপথ করে বলেছেন, যেদিন এই খুনি আর তার মদতদাতাদের শাসন থেকে মুক্ত হবে বাংলা, সেদিন চোখের জল ফেলে ভেজানো হবে কবরের মাটি। ততদিন শোক থাক শপথে।
বেঁচে থাকলে আগামী সোমবার তামান্না দশে পা দিতো। এখনো সিংভাগ অপরাধী অধরা। অন্যদিকে আছে অসংখ্য লড়াকু মানুষ, যারা তামান্নার মতো গাছ ফুল পাখি শিশুদের ভালোবাসেন, তামান্নার বাবার মতো গতরখাটা মানুষের জন্য রুটি-রুজি-রোজগারের পথ খোঁজেন, নিজেদের অর্থ পদ পুরষ্কারের মোহে নতজানু হয়ে রাজা-রানির স্তাবকতা করে শিরদাঁড়া বিক্রি করেননি, তাঁরাই অভয়া থেকে তামান্নার বিচারের দাবিতে সোচ্চার।
তামান্নার জন্মদিনে রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদের নানা রুপ ছড়িয়ে পড়বে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে রক্ত দান শিবির, তামান্না আর তার প্রিয় গাছের ছবি আঁকবে শিশু কিশোর কিশোরীরা। তামান্না তার জীবনের শেষ মুহূর্তে একটা গাছ পুঁতেছিল। সে কথা স্মরণ করে ঘরে ঘরে ঐ দিন অন্তত একটি গাছ লাগিয়ে তার নাম 'তামান্না' রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। আওয়াজ উঠেছে আবার,
"কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে,
সে আমার রক্তে ধোঁয়া দিন
চেতনায় হানছে আঘাত, চেতনায় হানছে আঘাত,
জাগ জনতার দুরন্ত সঙ্গীন। ...
বেয়নেট রাইফেলে আজ যে সাথীর প্রাণ নিয়েছে,
সে প্রাণের বদলা নিতে প্রাণে প্রাণ আজ মিলেছে।"
আসলে সন্তান হারা মাতা পিতার এ লড়াই শোক আর শপথের উদ্যাপন।
Comments :0