নভেম্বর মাস – মহান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাস এটা।
“এই সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও পৈশাচিক অর্ধসত্যের আবহাওয়ায় শুধু দিনের পর দিন মন্দ্রিত হয়ে চলল একটি সুস্পষ্ট ধ্বনি, বলশেভিকদের সঘন কোরাস : ‘সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে! সব ক্ষমতা চাই কোটি কোটি সাধারণ শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিদের হাতে। চাই জমি, রুটি, উন্মাদ যুদ্ধটার সমাপ্তি, গোপন কূটনীতি, চোরাবাজারি, বিশ্বাসঘাতকতার অবসান ...”- (দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন- জন রীড।)
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৩ জানুয়ারি, ২০১৭ সালে কলকাতায় একটা ভাষণে বলেছিলেন – “মার্কস একটা কথা বলতেন, সেটা হচ্ছে কোন একটা ভাবনা (আইডিয়া) জনগণের মধ্যে গেঁথে গেলে সেটা একটা বাস্তব শক্তি (মেটেরিয়াল ফোর্স) হয়ে যায়। এই রুটি, জমি, শান্তির ধারণা যে শক্তিসঞ্চয় করল তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারল না। শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হলো শোষিত জনতার সংগঠিত শক্তি।” ( পরে পুস্তিকা আকারে বেরোয় - গৌরবোজ্জ্বল নভেম্বর বিপ্লব স্মরণে)।
২
একটা আদিবাসী পাড়ায় গিয়েছিলাম। সঙ্গে আগের মেম্বার। সে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করল— মাটি কাটা কেমন হইচিল আমাদের আমলে?
আগের দিনের কথা শুনে মুখে তাদের হাসির রেখা দেখা যায়। কিন্তু এখন কী হচ্ছে, তার জবাবে বিরক্তি। ১০০ দিনের কাজই তো বন্ধ! কতদিন ধরে ১০০ দিনের কাজ নেই। যদিও ক্বচিৎ কাজ হয়, তবে বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি! মানুষ পাঁচজন কাজ করে তো দশ জন মাস্টার, মানে সুপারভাইজার। সুপারভাইজার তো নয়, একজন বলল, এরা তৃণমূলের সুপার ভাতিজা। যাও কাজ হলো, তার দরমা পাবার কোনও গল্প নেই। কাজ করেছো করেছো। মজুরি আবার কী! – ভাবখানা এরকম।
পাড়ায় এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরছি। দরিদ্র বিধবা বা বয়স্ক নারীরা ভাতা পাননি। ঘর করার জন্য মারুখা পার্টি ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়েছিল। কয়েক ফুট ওঠাবার পর বছরের পর বছর ধরে কাজ বন্ধ।
ও পাড়ায় একজন শিক্ষিতা নারী এসএসসি’তে কাজ করে। বেশি বয়স না। বিধবা, তিনটি মেয়ে – সে বলছে যা মাইনা পাই, চলে না। মহার্ঘ ভাতা তো দেবেই না। বড় মেয়েটা মাধ্যমিক পাশ করেছে। কলেজের টিএমসি’রা বলছে – টাকা লাগবে ভর্তি করাতে। এক বুজ্জু টাকা! কোথায় পাবো?
পাশের পাড়াটা মুসলমান প্রধান। পরিচিত একজন আমাদের বসতে দিয়ে বলল, ধান তো কাটিবা হবি দুইয়ে – চাইরে। তারপর যি কী হবি! এবার সরষা, গম কোন আবাদ করা যাবে না। ছোট চাষিরা তো হাত তুলে দিয়েছে। বড় চাষিদেরও মাথায় হাত। কেন? কয়েক দিন আগে সারের পঞ্চাশ কেজির বস্তা ছিল ১৭০০ টাকা। এখন বস্তার গায়ে এমআরপি যা লেখা আছে, সে দামে সারের দোকানদার দিবে না। তার থেকে অল্প কিছু বেশি নিয়েও না। ২৪০০-২৫০০ টাকায় কিনতে হবে। পুরো কালোবাজারি চলছে। ১১ বছর আগে এক মন ধান ৫৫০টাকায় বিক্রি করে ৪১০টাকা দিয়ে এক বস্তা সার কিনে আনা যেতো। এখন চার মন ধান বিক্রি এক বস্তা সার হয় না। সমবায় সমিতিতে সার নেই। কারণ, অতি সহজ। রাজ্য সরকার সারের ব্যাপারিদের সঙ্গে সাঁট করেছে। তাই সমবায় সমিতি শূন্য। আরেক জন এল। ধানের দাম নিয়ে কথা শুরু হলো। সে বলল, এবারও কৃষক ধানের দাম পাবি না। প্রতি বছর যেমন হয় – ফরুয়ারা অল্প পাইসা দিয়ে কার্ডগুলা নিয়ে অন লাইনে স্লিপ করে রেখেছে। ওরাই জলের দরে ধান কিনবে আর সরকারি দামে ওরাই মান্ডিতে বিক্রি করবে। একজন বলছে, জানেন তো মুই তো একনা ঠ্যাটা। মান্ডিতে ধান নেবে না। চলে গেলাম এডিও আর ডিএম’র কাছে। দরখাস্ত করে রিসিট নিলাম। এক বছর হয়ে গেল। কোন উদিশ নাই। ওদের কথা যে সত্যি তা সবাই জানে। কিন্তু আজ ফেরার পথে হাতে নাতে প্রমাণ পেলাম। একজনকে প্রতিবেশী আর একজন বলছে, কার্ডটা ক্যানে দিলু! মোরা মাও হামারটা দিচিলো। অনেক হুজ্জুদ করি ফিরত আনিচু।
অন্য এক পাড়ার এক শিক্ষিত বেকার যুবক, তার বাবাকে বলে, খেত জমি কাটিয়ে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করেছে। সে বলল – শুনিছি হো নানা! মাছের গুঁড়া খাবার এক বস্তার দাম ছিল ১৩০০টাকা। এখন ২৪০০ টাকা!
পাটের দাম নিয়ে যে ঠকনটা ঠকল চাষিরা, তা আর কহতব্য নয়। মাত্র ৪২০০ – ৪৩০০ শ’ টাকা কুইন্টাল।
এই যে চাষাবাদ – এতো ক্ষতির বাণিজ্য। লাভ কী হয়? উত্তর— কয়েক মাসের হইচই। চিৎকার চেঁচামেচি। বীজ- সার-ওষুধ আনো রে, জল দাও রে, লোক লাগাও রে, থ্রেসার মেশিন কবে আসবি রে— ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কৃষক বন্ধু/ কৃষক সম্মান নিধি— একটা রাজ্যের একটা কেন্দ্রের— কী গাল ভরা নাম! ক’জন চাষি এ বাবদের টাকা পায়? চাষ করে পুঁজি গায়েব হওয়ায় আর ঋণের দায়ে, রাজ্যে যে আত্মহত্যা করছে চাষি, সে খবরও অনেকে জানে দেখলাম।
এক পাড়ায় যেতেই, বাড়ির ভেতর থেকে নারী কণ্ঠের ডোঢানিয়া কান্নার শব্দ পেলাম! গিয়ে দেখি কাজ করতে বাইরে যাওয়া ছেলের লাশ এসেছে বাড়িতে। তার বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে মা তার এরকম কাঁদছে। বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছে চরাচর। পাড়ায় পাড়ায় ঘরগুলো খালি পড়ে আছে, গ্রামে কাজ নেই, স্বামী-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সবাই বাইরের রাজ্যে গিয়েছে কাজ করতে।
ক্রেশার মেশিনে কাজ করলে পাথরের কুঁচির ধুলা জমে ফুসফুস অকেজো হয়ে যায়। এরকম রোগাক্রান্ত যুবকের খবর পেলাম এখানেই। এরকম এক জনের মৃত্যু সংবাদও। ওরা সব পাঞ্জাবে এই কাজ করতে যায়।
লক্ষীর ভাণ্ডার নিয়ে যে মাতন উঠেছিল, তা কমে গিয়েছে। একজন বলল– নারীদের মানসম্মান বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে চাল ডাল তেল, আটা, সাবান, সোডা ইত্যাদি ইত্যাদি সব কিছুর দাম তো আকাশছোঁয়া! ব্যাটা বেটির চাকরি যে কী হবে আগামী দিনে, বাপ–মা’রা ভীষণ চিন্তাগ্রস্ত। কলকাতায় যাদের চাকরি পাবার ন্যায্য হক, কিন্তু যারা পায়নি, পায়নি তার কারণ টাকা খেয়ে ওদের চাকরি বিক্রি করে দিয়েছে তৃণমূল, জেলে ঢুকছে ওদের নেতা মন্ত্রী সারি ধরে – এসব প্রসঙ্গ এনে, জিজ্ঞাসু হলো কয়েকজন - ওদের চাকরিগুলা এবার কী হবে দাদা? আমারা বলি – ওরা তো মরণপণ লড়াই দিচ্ছে। উকিলবাবুরাও ভালো লড়াই দিচ্ছেন। রাজ্যের ভালো মানুষ আছে ওদের পক্ষেই। ওদেরই তো জয়ী হবার কথা। আমার সঙ্গী বলল- তোরাও ওদের তনে একনা দোয়া করেন।
রেশনে জিনিস নেই। ডিজিটাল রেশন কার্ডের বায়নাক্কায়, কতজন কার্ডহীন!
মেয়ের টিউমার অপারেশন করাতে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে, সেখানে কোন ওষুধ নেই। ওষুধের দাম ডেইলি দিন বাড়ছে। বেটির চিকিৎসায় ফতুর হওয়া একজন শোনাচ্ছিল তার বেদনার কথা। এদিকে জেলায় ডেঙ্গুর কেসের সংখ্যা বাড়ছে। জেলা হাসপাতালের এক ডাক্তারবাবুই বললেন সে কথা। কিন্তু, সরকারের কোনও হেলদোল নেই। বিজ্ঞান মঞ্চ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে।
বাজারে এলাম। সারি দিয়ে ডিয়ার মার্কা, আরও কত মার্কার লটারি। দু’চার জন করে মানুষের ভিড় লেগে আছে। বেশিরভাগই গ্রামীণ শ্রমজীবী। মণ্টুর চায়ের দোকান থেকে ‘গণশক্তি’ পড়ে একজন বলল- টিকিট কাটেছেন তোরা, আর বাম্পার টাকা পাছে অনুব্রত, ওর বেটি, তৃণমূলী এমএলএ’র বউ বেটি, তৃণমূলী নেতারা।
টিকিট কাটুয়া একজন জিজ্ঞাসা করে – ছেঁচায়! কী করি? - তখন সে সব বৃত্তান্ত খুলে বলে। টিকিট কাটতে আসা সবারই কপালে দেখি চিন্তার রেখা।
অনেক পাড়াতেই তৃণমূল – বিজেপি’র উত্তরের জেলাগুলি নিয়ে রাজ্য করার বিষয়টা এল । ওটা যে মূল বিষয়গুলো গুলিয়ে দিয়ে হাওয়া গরম করার কারসাজি, যদি ভোটে এই তুক তাক কাজে লাগে, তার কৌশল - সেই কথাটা বুঝিয়ে বলল আমার কমরেড।
আলোচনায় আসছে সীমান্ত জুড়ে বিএসএফ-এর অত্যাচারের কথা।
আলোচনায় আসছে একের পর এক ইলেকশনে ভোট লুট, মার, খুন –এসবের কথা। আসছে স্ট্রাইক করতে গেলে তৃণমূলী গুন্ডা এমনকি সিভিক পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়ারদের গুন্ডামি, স্ট্রাইক ভাঙার দালালদের মাতামাতি, ব্লকে ডেপুটেশন দিতে গেলে দাসবৎ পুলিশকে নিয়ে তৃণমূলী গুন্ডামি, এমনকি জেলা কৃষক সমিতির নেতারা এডিএমএ’র কাছে ডেপুটেশন দিতে গেলে, সেই অফিসার নিজে যে জেলা কৃষক নেতার কলার ধরে অপমান করল— এরকম কত প্রসঙ্গ।
তৃণমূলের তো অনেক গ্রুপ। লুটের ভাগ নিয়ে প্রথমে কুকুর কাইচাল, তারপর মারামারি, তারপর খুনোখুনি ইত্যাদি চলতেই থাকে। এসব নিয়েও আলোচনা হলো।
একজন বলল – এবার বোধহয়, আগের মতো গন্ডগোল করিবি না!
- কেনে? কি করি বুঝলু?
- অদের নেতারা বক্তা দেছে যি।
আমার কমরেড হাসতে হাসতে বলল – তুই একটা আস্ত আঁজলা। আরে গু খাউকা গরু গু না খাই থাকিবা পারে! গোলমাল ওরা করিবেই। সেজন্য ঝান্ডার সঙ্গে গুজি ভাইলকা বাঁশের শক্ত ডান্ডা বাঁধো। পিটার ধরিবা হবি। যাতে গোলমাল করতে কাছে ভিড়তেই ভয় পায়।
বিজেপি’র কথা আসতে একজন বলল – মমতায় তো বিজেপি! যাঁহে মোদী, তাঁহে মমতা। এ কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মোহন ভাগবতকে মেদিনীপুরে মমতার সেবা দেওয়া, বাজপেয়ীকে মালপোয়া খাওয়ানো, আদবানির প্রসংসা করা, কয়েকদিন আগে মোদীর প্রশংসা করা ইত্যাদি কথাগুলি এসে গেল। জনৈক তৃণমূলী এসব কথা শুনছিল। সে বলল – ও কিন্তু ঠিকই বলেছে। মমতা দ্বিচারী। ওর মুখে একথাটা শুনে একটু চমকেই গেল অনেকে।
তখন, মোদী – মমতা দেশজুড়ে রাজ্যজুড়ে যে কত বড় চুরি ডাকাতি করছে, মানুষের সঙ্গে বেমাইনি করছে, বড়লোকদের সেবাদাসত্ব করছে, আর দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগানোর ফন্দি এঁটে ভোটে জেতার চক্রান্ত করছে, সেই কথাগুলি এল আলোচনায়।
শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো- মোদী-দিদি এক হ্যায় – ভুলো মত্ ভুলো মত্।
এতো বিষয় নিয়ে বাড়িতে, পাড়ার বাঁশের চোকির ওপর বসে, পাড়ার দোকানের সামনে, গঞ্জের চা দোকানে আলোচনা হচ্ছে যে, সেসব বলে শেষ করা যাবে না।
৩
গ্রাম জাগাও - চোর তাড়াও - বাংলা বাঁচাও – এই আহ্বানটা মাটি পাচ্ছে। এককথায় বলা যায়, তৃণমূল বিজেপি সম্পর্কে মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে। বড় বড় লড়াই, মিছিল, জাঠা, সমাবেশও হচ্ছে রাজ্যের চারিদিকে। কিন্তু বুদ্ধদার মুখে শোনা মার্কসের ঐ বাক্য- ‘ভাবনা’টা কিন্তু এখনও ‘বাস্তব শক্তিতে’ পরিণত হয়নি। বলা যায় শক্তি অর্জনের প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। অভিপ্রেতভাবে শক্তিমানের জন্য যা দরকার – তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তবুও পুনরুক্তি করি – কোন রকম আত্মতুষ্টি রাখা চলবে না। মানুষের সঙ্গে সংযোগ, সংযোগ মানে গভীর সংযোগ, তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের সঙ্গে থেকে লড়াই, লড়াই বাদেও নানা কাজে, এমনকি পারিবারিক বিষয়েও, তাদের সঙ্গী হতে হবে। কথায় কাজে যাকে বলে আত্মীয় হয়ে ওঠা। দরকার অল্প বয়সের অনেক কর্মী। কর্মীরা যেন গণশক্তিটা নিয়মিত পড়ে নিজেদের তৈরি রাখেন। আর চাই সাহস ও তেজ।
রবীন্দ্রনাথ একটা প্রবন্ধে বলেছেন, “আমরা সকলেই পৃথিবীতে কাহাকেও না কাহাকেও ভালোবাসি, কিন্তু ভালোবাসিলেও বন্ধু হইবার শক্তি আমাদের নাই। বন্ধু হইতে গেলে সঙ্গদান করিতে হয়। অন্যান্য সকল দানের মতো এ দানেরও একটা তহবিল দরকার। কেবলমাত্র ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়।” এখানে ‘তহবিল’ মানে যে টাকা নয়, তার মানে যে অন্তর সম্পদ - তা আমরা সবাই জানি। এই অন্তর সম্পদেও আমাদের ধনী হতে হবে।
তাহলেই সবটা মিলে, আমরা প্রগতিবাদীরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবো।
Comments :0