Editorial

১১ দিন পরও

সম্পাদকীয় বিভাগ

ধর্মের আবহে হিন্দুত্বের রাজনীতির নৈবেদ্য সাজাতে একরকম জেদ করেই শুরু করেছেন চার ধাম প্রকল্প। পরিবেশগত এবং ভূতত্ত্বগত কোনও জায়গা থেকেই এই প্রকল্পের অনুমোদন ছিল না। এটা ভয়ঙ্কর এক আত্মঘাতী উদ্যোগ পই পই করে সতর্ক করে দিয়েছিল পরিবেশ ও ভূ-বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এক দেশ, এক দল এবং তারই এক নেতার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ‘বেদবাক্যের’ মত। তিনি যখন মনে করেছেন তখন প্রকল্প হবেই এবং তাতে খোদাই করা হবে তাঁরই নাম। তার জন্য পাহাড়ে যত বিপর্যয়ই নামুক, মানুষের বিপন্নতা যতই বাড়ুক, বারংবার ধস নেমে যত ধ্বংসই হোক, সর্বোপরি নিরীহ মানুষের যত মৃত্যুই হোক চারধাম হবেই। কারণ ওখান থেকেই আসবে হিন্দুত্ববাদী ভোট রাজনীতির ডিভিডেন্ড।
গোঁয়ার্তুমির সেই প্রকল্পের নির্মাণ কাজে গিয়ে সুড়ঙ্গের ভেতরে গভীর অন্ধকারে এগারোদিন ধরে আটকে আছেন ৪১ জন শ্রমিক। সাতদিন আগেও সরকার জানত বেং দেশবাসীকে জানিয়েছিল ৪০ জন শ্রমিক আটকে আছে। হতভাগ্য অপরজনের কোনও তথ্যই  সাতদিন ছিল না সরকারের কাছে। শ্রমিকরা যে নিছকই সংখ্যা মাত্র, দুই বা এক কমবেশি হলে কিছু যায় আসে না, এই ঘটনা বোধ হয় তারই নির্মম দৃষ্টান্ত। সুড়ঙ্গের ভেতরে কয়জন শ্রমিক জীবনকে বাজি রেখে পেটের দায়ে কাজে গেছে তার কোনও হিসাবই রাখে না কর্তৃপক্ষ। কী অবস্থায় তারা কাজ করছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য করনীয়, বিপর্যয় ঘটলে শ্রমিকদের রক্ষার কী আগাম প্রস্তুতি কোনকিছু নিয়েই কোন মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। তাই সুড়ঙ্গের ভেতরে ধস নেমে সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে ভেতরে সংকীর্ণ পরিসরে কর্মরত ৪১ জন শ্রমিক আটকে পড়ার কোনও কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না প্রশাসন। তাই এগারোদিন ধরে উদ্ধার কাজে অথৈ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে সরকার।


হিমালয়ের বুকে বাড়তি নির্মাণ কাজ যে ভারসাম্য নষ্ট করবে, বাড়তি চাপ নিতে পাহাড় যে অক্ষম বিশেষজ্ঞদের সেই সাবধানতাকে গুরুত্ব দেওয়া হলে এই ধরনের আত্মঘাতী প্রকল্প কোনও দায়িত্বশীল সরকার নিতে পারে না। আর নিলেও সম্ভাব্য বিপদের কথা মাথায় রেখে আগাম ব্যবস্থা মজুত রাখা হত। এক্ষেত্রে তার কোনও কিছুই হয়নি। বিপর্যয় নামার সময় থেকে মধ্য প্রদেশ-ছত্তিশগড়ে টানা নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর বিশ্বকাপ খেলা দেখতে চলে গেলেন নিজের নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামে, এমনকি খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমেও। অতঃপর তিনি ফোনে নাকি আটক শ্রমিকদের খবর নিয়েছেন। ফোনে কি বলেছেন সেটা তাঁর নিজের মুখে মানুষ শোনেনি, বলেছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী। ৪১ জন শ্রমিক, তাদের পরিজন, এমনকি দেশের জনগণের মধ্যে যে উদ্বেগ সেখানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে আশ্বাস-ভরসার কথা শোনা প্রত্যাশা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রীর কাছে মূল্যহীন। খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমে তিনি কাকে কি বলছেন দেশবাসী শুনতে ও দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু ৪১ জন শ্রমিক, যারা জীবিত অবস্থায় বেরোতে পারবেন কিনা নিশ্চিত নয় তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কোনও কথা তাঁর মুখ থেকে কেউ শুনবে না। কেউ দেখবে না ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধাকারীদের উৎসাহ জোগাতে এবং উদ্বিগ্ন পরিজনদের ভরসা জোগাতে। শেষ বিচারে তিনিই তো দেশের প্রধান। তাঁর একটু দায়ও থাকবে না?

Comments :0

Login to leave a comment