নিলয়কুমার সাহা
১৯২৭ সালের ৩ এপ্রিল কলকাতার অ্যালবার্ট হলে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত ‘অল বেঙ্গল কলেজ অ্যা ন্ড ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (অ্যাবকুটা) বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি-র (ওয়েবকুটা) দ্বিতীয় সম্মেলনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের তদানীন্তন কিং জর্জ ভি চেয়ার প্রফেসার ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ সভাপতির অভিভাষণে সমসাময়িক শিক্ষানীতির সমালোচনা করে বলেন, সরকারের শিক্ষানীতি ‘লক্ষ্য এবং পরিধি’তেই সীমাবদ্ধ। শিক্ষা মানুষকে দক্ষ করে তুললেও একটি স্বাধীন জাতির আত্মসম্মান সম্পন্ন নাগরিকে উন্নীত না করে সরকারের অনুগত নমনীয় যন্ত্রে পরিণত করছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের প্রশ্নে তিনি বলেন, রাষ্ট্র ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন হোক অথবা ভারত নিয়ন্ত্রণাধীন হোক, আমলাতান্ত্রিক হোক অথবা গণতান্ত্রিক হোক বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বতোভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বক্তব্যের একেবারে শেষে শিক্ষক সমাজের উদ্দেশ্যে ড. রাধাকৃষ্ণাণ বলেন, শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষের ব্যক্তিত্ব এবং দৃষ্টিভঙ্গির উপর শিক্ষা সংক্রান্ত আইন ও সংস্কার, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচির যথার্থ প্রয়োগ নির্ভর করে। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মানুষই প্রতিষ্ঠানকে অনুপ্রাণিত করে। জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দেশের উচ্চ মেধা সম্পন্ন মানুষকে শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করাতে হবে। স্বাধীনতা লাভের দু-দশক আগে পরাধীন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষক সমাজ সম্পর্কে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ যে অভিমত ব্যক্ত করেছিলনে, সাড়ে সাত দশক অতিক্রান্ত স্বাধীনতা উত্তর ভারতে আজ তাঁর জন্মদিন শিক্ষক দিবসে সেই অভিমত কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে সে আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
ফিরে দেখা অতীত
১৯৬২ সালের ১৩ মে ড. রাধাকৃষ্ণাণ ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ওই বছর ৫ সেপ্টেম্বর ড. রাধাকৃষ্ণাণের ছাত্র এবং গুণমুগ্ধরা তাঁদের প্রিয় শিক্ষক, প্রিয় বন্ধুর জন্মদিন পালনে উদ্যত হলে, ড. রাধাকৃষ্ণাণ তাঁর ছাত্র এবং গুণমুগ্ধদের ওই দিনটিকে শিক্ষক দিবস হিসাবে পালনের অনুরোধ জানান এবং সেই থেকে অর্থাৎ ১৯৬২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশে মহাসমারোহে ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসাবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীন দেশে ১৯৪৮ সালে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের সভাপতিত্বে গঠিত হয়েছিল প্রথম শিক্ষা কমিশন, যেটি ‘রাধাকৃষ্ণণ কমিশন’ অথবা ‘বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ নামে জনপ্রিয় হয়েছিল। এই কমিশন ভারতীয় উচ্চশিক্ষার প্রসার এবং মানোন্নয়নের পাশাপাশি গবেষণার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে।
এই কমিশনের সুপারিশেই স্বাধীন ভারতে ১৯৫৬ সালে উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ (UGC) গঠিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরও দুটি শিক্ষা কমিশন এবং তিন তিনটি শিক্ষানীতি ঘোষিত হলেও ১৯৬৮ সালে ঘোষিত ‘জাতীয় শিক্ষানীতি–১৯৬৮’এর সুপারিশ অনুযায়ী মোট জাতীয় উৎপাদনের (GDP) ৬% শিক্ষাক্ষাতে ব্যয়ের সুপারিশ ৭৮ বছর বাদেও স্বাধীন ভারতে কার্যকর হয়নি। যদিও দেশে স্বাক্ষরতার হার ১৯৫১ সালে ছিল ১৮.৩৩ শতাংশ, যা ২০১১ সালে বেড়ে হয়েছে ৭৪.০৪ শতাংশ। স্বাধীনতা প্রাপ্তির চার দশকের মধ্যেই দেশের উচ্চশিক্ষায় মোট অন্তর্ভুক্তির হার ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশে পৌঁছেছিল এবং একবিংশ শতকের প্রথম দশকেই সেই হার ২৫ শতাংশে উন্নীত হয়। শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে, বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতির হার বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের ১ অগস্ট একটি জাতীয় প্রকল্প হিসাবে ভারত সরকার ঘোষিত ‘মিড ডে মিল প্রকল্প’, ২০০৯ সালে ঘোষিত ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ দেশের ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পোঁছে দেবার লক্ষ্যে নিঃসন্দেহে দুটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নে ১৯৫১ সালে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ গঠন, ১৯৭৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ প্রতিষ্ঠার মূলেও ছিলে যথাক্রমে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পঠনপাঠনের মানোন্নয়ন এবং প্রসার।
সীমিত সরকারি ব্যয় বরাদ্দের প্রেক্ষাপটে নানান পরিকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে, শিক্ষক সম্প্রদায়ের চরম কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে রাজ্যে শিক্ষার পরিসর যখন ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে, সেই সময় অর্থাৎ বিগত শতকের সাতের দশকে অস্থির রাজনৈতিক পরিসরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্যের শিকার হয়েছে অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক পালা বদলের পর রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হয়, প্রহসনে পরিণত পরীক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার, ধারাবাহিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং ফল প্রকাশ, কেবলমাত্র মেধার ভিত্তিতে বিভিন্ন পাঠক্রমে ভর্তি প্রক্রিয়া শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সমাজকে বহুলাংশ নিশ্চিত করেছিল। যদিও কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুসারে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৯৮১–৮২ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি শিক্ষা প্রত্যাহারের সরকারি সিদ্ধান্ত জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অধ্যাপক হিমাংশু বিমল মজুমদার কমিটির সুপারিশ এবং অন্যান্য শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে তদানীন্তন সরকার প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি প্রত্যাহার করেছিল। পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ২০০৭ সালে সরকার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করায় প্রাথমিক স্তরে পুনরায় ইংরেজি শিক্ষা চালু হয়।
একমাত্র মেধার ভিত্তিতে বিদ্যালয়ে এবং মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যথাক্রমে ১৯৭৯ এবং ১৯৯৭ সালে বিধানসভায় ‘দ্য ওয়েস্টবেঙ্গল কলেজ সার্ভিস কমিশন অ্যাক্ট, ১৯৭৮’ এবং ‘দ্যা ওয়েস্টবেঙ্গল স্কুল সার্ভিস কমিশন অ্যাক্ট, ১৯৯৭’ শীর্ষক দুটি আইন পাশ করে প্রতিষ্ঠা করেছিল কলেজ সার্ভিস কমিশন এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন। বিগত রাজ্য প্রশাসনের সময়কালে রাজ্যের উচ্চশিক্ষিত মেধাবী যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের শ্রেষ্ঠ গন্তব্য হয়ে উঠেছিল এই দুটি কমিশন। প্রতি বছর বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া রাজ্যে এক উৎসবে পরিণত হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমে সরকার অনুগত যে সকল শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী বিগত সরকারের আমলে রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে কোনও বিশেষ ‘আয়ন’ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা হিসাবে কালিমালিপ্ত করেন, সেই অতিমানবদের বিনীত প্রশ্ন - বিগত সরকারের আমলে শিক্ষকতা পেশায় তাঁদের অন্তর্ভুক্তিও কি সেই বিশেষ ‘আয়ন’-এ জারিত?
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালা বদলের অব্যবহিত পরেই রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করলেন শিক্ষক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর আক্রমণ। ভেঙে দেওয়া হয় রাজ্য পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলির গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত পরিচালন ব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থার পরিবর্তে মনোনীত পরিচালন ব্যবস্থায় শাসক দলের একাধিক সাংসদ বিধায়ক একইসঙ্গে রাজ্যের একাধিক বিদ্যালয় এবং কলেজে পরিচালন সমিতির সভাপতি পদে মনোনীত হলেন আর তাঁদের অনুগত অনুগামীরা পেলেন স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির দখলদারি। স্থানীয় এই শাসক দলের অনুগতদের স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান এবং শিক্ষকমণ্ডলী। কোনও কোনও প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান স্বতঃপ্রণোদিতভাবে হয়ে উঠলেন ছাত্র নামধারী এই বহিরাগতদের পৃষ্ঠপোষক। রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এই ‘উন্নয়ন’-এর জোয়ারে ভেসে গেল আর এই জোয়ারে মনিমুক্তোর মতো সংবাদের শিরোনামে উঠে এল ভাঙর কলেজে, মেঘনাদ সাহা কলেজে, ঘাটাল কলেজে এবং দেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ, অধ্যাপক এবং অধ্যাপিকা নিগ্রহের ঘটানা। কোথাও অভিযুক্ত কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি, কোথাও বা ছাত্র নামধারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুগামীরা। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী উপযুক্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নিয়ে প্রতিটি ঘটনাকে ‘ছোট ঘটনা’ অথবা ‘ছোট ছোট ছেলেরা ভুল করে ফেলেছে’ ইত্যাদি শব্দবন্ধে যেভাবে নিজের অনুগামীদের আড়াল করেছেন, তার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক অনভিপ্রেত ঘটানার করুণ চিত্র।
সুদীর্ঘ এই তালিকায় ২০১১ সালের ৩১ জুলাই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মোটর সাইকেল পার্কিং নিয়ে বচসায় জেরে শিক্ষাকর্মী বাসুদেব নন্দীর মৃত্যু, ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বোমার আঘাতে কর্তব্যরত এক পুলিশকর্মীর মৃত্যু, স্নাতক স্তরের পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ২০১৩ সালের ৭ জুন কামদুনিতে এক ছাত্রীর নির্মম পরিণতি, ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট রাজ্যের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একাধারে চিকিৎসাকেন্দ্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় ডাক্তার ছাত্রীর ওপর সুপরিকল্পিতভাবে সংগঠিত হাড়হিম করা নৃশংসতা এবং দক্ষিণ কলকাতার ল’ কলেজের এক ছাত্রীর ওপর পাশবিক অত্যাচার এই ঘটনা প্রবাহের সর্বশেষ সংযোজন। ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ এই শ্লোগানে আসক্ত অগণিত কন্যা সন্তানের অভিভাবকের হৃদস্পন্দন কি বাড়িয়ে তুলছে না?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই! এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। যেমন জানা নেই, রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে সংগঠিত নিয়োগ দুর্নীতির শিকার অসংখ্য যোগ্য বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী সহ হাজার হাজার যোগ্য চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী এবং তাঁদের পরিবার, পরিজন কি সার্বিক বিপন্নতা থেকে মুক্তি পাবেন, না কি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির চোরাবালিতে চিরতরে তলিয়ে যাবেন? কেন রাজ্য প্রশাসন যোগ্য এবং অযোগ্য চাকরিহারাদের চিহ্নিত না করে সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে প্রহসনে পরিণত করল? কার স্বার্থ রক্ষার্থে এবং কার নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশন মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে চিহ্নিত অযোগ্য চাকরিহারাদের পুনরায় পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিল? কেন প্রথম থেকে 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০'র বিরোধিতা করে, এই বিষয়ে একাধিক বার কমিটি গঠন করে, কোনও কমিটির সুপারিশ জনমানসে না এনে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই রাজ্যে হঠাৎ কার্যকর হলো জনবিরোধী 'জাতীয় শিক্ষানীতি - ২০২০'? কেন ওবিসি সংক্রান্ত মামলার জটে নজিরবিহীনভাবে আটকে রাখা হলো রাজ্যে স্নাতক স্তরে ভর্তি প্রক্রিয়া এবং জয়েন্ট এন্ট্রাস পরীক্ষার ফল? বিলম্বিত এই ভর্তি প্রক্রিয়া সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থার মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের বাজার দখলে কি উৎসাহিত করেনি?
বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র শিক্ষক, অধ্যক্ষ এবং উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মহামান্য বিচারালয়ের ধারাবাহিক হস্তক্ষেপের ঘটনা কি রাজ্য প্রশাসনের ব্যর্থতা প্রকট করছে না? রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কিত এমন অসংখ্য উত্তর না জানা প্রশ্নের পাশাপাশি বিগত দেড় দশকে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করে চলেছেন আট হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবলুপ্তি, কন্যাশ্রীর মতো জনপ্রিয় সামাজিক প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও ক্রমাগত কমতে থাকা মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা, একদা স্নাতকস্তরে মেধা উপেক্ষিত ভর্তি ব্যবস্থায় টাকার খেলা, কলেজ শিক্ষকদের জনস্বার্থে বদলি করে বিরোধী কণ্ঠস্বর অবরুদ্ধ করার প্রশাসনিক প্রয়াস, ইন্টারনেট পরিষেবার ব্যবস্থা না করে দ্বাদশ শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর হাতে ট্যাব তুলে দেওয়া, উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়া অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, সারা রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চার লক্ষাধিক শূন্য পদে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগ না করে কার্যত সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রা সুনিশ্চিত করা, শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষাবৃত্তিকে কালিমালিপ্ত করা, সম্প্রতি দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করতে রাজ্য প্রশাসন কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষার সূচি বদলের নজিরবিহীন নির্দেশিকা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পূর্বনির্ধারিত সূচি অপরিবর্তিত রাখায় উন্মত্ত শাসক অনুগামী সহ ভারপ্রাপ্ত শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের কদর্য ভাষায় মাননীয় উপাচার্যকে কুৎসিত আক্রমণ এবং রাণী বিড়লা গার্লস কলেজে গঠিত না হওয়া পরিচালন সমিতির সভাপতি কর্তৃক চরম অগণতান্ত্রিকভাবে কলেজের অধ্যক্ষাকে নিলম্বিত করার ঘটনা। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের এমন নির্লজ্জ ইতিহাস কি বঙ্গবাসী স্মরণ করতে পারেন?
সময়ের দাবি
সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাতে, আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষাঙ্গনের দ্বার উন্মুক্ত রাখতে, সকলের জন্য শিক্ষার অধিকার আইনকে সর্বাংশে কার্যকর করতে, শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক পরিসর ফিরিয়ে আনতে, হুমকি সংস্কৃতি মুক্ত শিক্ষাঙ্গন নির্মাণ করতে, কেবলমাত্র মেধার ভিত্তিতে উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য শিক্ষকতা বৃত্তি নিশ্চিত করতে, রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু শিক্ষার মান পুনরুদ্ধার করতে, সর্বোপরি রাজ্যের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে শিক্ষক সমাজকেই এগিয়ে এসে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে দূর করতে হবে এই নিকষ কালো অন্ধকার, শিক্ষক দিবসের পূণ্য প্রভাতে এটাই বোধ হয় সময়ের দাবি।
মন্তব্যসমূহ :0