নিজস্ব প্রতিনিধি: কলকাতা, ১৬ জুলাই— আর জি করের মামলায় কলকাতা পুলিশের তদন্তকেই কার্যত অন্ধভাবে অনুসরণ করে গিয়েছে সিবিআই। গত জানুয়ারি মাসে নিম্ন আদালতের রায়ে কপিতে এমন বাক্যই লেখা হয়েছিল। অর্থাৎ কলকাতা পুলিশ যা চেয়েছে, যেভাবে তদন্ত করেছিল, ঠিক সেই পথে সেভাবে তদন্ত করেছে সিবিআই!
ঠিক একই কথা এবার শিয়ালদহ আদালতে শুনানিতে উঠে এল আর তাতেই মেজাজ হারালো সিবিআই।
শুধু তাই নয়, আর জি করে পড়ুয়া চিকিৎসক খুনের ঘটনায় প্রথম থেকেই তদন্তের অভিমুখে নিয়ে যেভাবে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল, তা সম্পূর্ণ আড়াল করে সিবিআই প্রকাশ্যে এবার বিনীত গোয়েলের হয়ে সাফাই গাইল!
বুধবার শিয়ালদহ আদালতে আর জি কর মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে ষষ্ঠ স্ট্যাটাস রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। এই শুনানিতেই সিবিআই-র তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে পরিবারের তরফে তোলা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিবিআই-র তরফে শুধু বিনীত গোয়েলের হয়ে সাফাই দেওয়া নয়, কলকাতা পুলিশের তদন্তকেই শংসাপত্র দিয়ে এমনকি বলা হয় যে পরিবারের কথায় তদন্ত হবে না। একমাত্র সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধেই তথ্য প্রমাণ মিলেছে। পরিবারের কথায় তো আর গ্রেপ্তার করব না আমরা।
নির্যাতিতার পরিবারের তরফে আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি এদিন শুনানি চলাকালীন সওয়ালে আর জি কর মামলায় সিবিআই-র তদন্তকারী আধিকারিক সীমা পাহাজার দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এমনকি, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত করবে না বলেও বিস্ফোরক অভিযোগ করেন ফিরোজ এডুলজি। তাঁর কথায়-বিনীত গোয়েল এবং সিবিআই-র সিনিয়র অফিসার সম্পত মিনা একই ব্যাচের অফিসার। তাই সিবিআই বিনীতের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে না।
শুধু তাই নয় এরপরে পরিবারের তরফে অভিযোগ করা হয় সিবিআই-র তদন্তকারী আধিকারিকের বিরুদ্ধেও। আর জি করের ধর্ষণ ও খুনে যিনি তদন্তকারী আধিকারিক, হাথরসকান্ডেও তিনি তদন্ত করেছিলেন। সেই মামলায় তিনজন খালাস পেয়ে যায়, একজন মাত্র দোষী সাব্যস্ত হয়। এ কথা উল্লেখ করে নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি তদন্তকারী অফিসারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এছাড়াও তাঁর বক্তব্য, প্রাক্তন কমিশনার বিনীত গোয়েল এবং সিবিআই-র সিনিয়র অফিসার সম্পত মিনা ব্যাচমেট। তাই তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে না।
আদালত কক্ষে এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরেই পালটা সাফাই দিতে নামেন সিবিআই-র আইনজীবী।
পরিবারের তরফে এই অভিযোগ শুনে আদালতে কার্যত বিনীত গোয়েলের হয়ে সওয়াল করতে শোনা যায় সিবিআই-র আইনজীবীদের।
সিবিআই-র তরফে আইনজীবী বলেন, বিনীত গোয়েল বা সিনিয়র অফিসাররা ব্যাচমেট বলেই, তাঁরা ক্রাইমের অংশ- এ কথা বলে দেওয়া যায় না। আপনাদের কথায় কাউকে গ্রেফতার করা হবে না, তথ্য প্রমাণের উপর ভিত্তি করে গ্রেফতার করা হবে। কে কী করছে তা যথেষ্ট ভালভাবে খতিয়ে দেখা হয়েছে। ফুটেজ খতিয়ে দেখেছি। সমস্ত সাক্ষীর বয়ান নেওয়া হয়েছে। বিনীতের বিরুদ্ধে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি, অভিযুক্তের ডিএনএ নমুনা পাওয়া গিয়েছে ঘটনাস্থল থেকে। ' হাথরস প্রসঙ্গে সিবিআই সাফাই দেয়- হাথরসের ঘটনায় আদালতের নির্দেশ রয়েছে। আমরা কিছুতে ভয় পাই না। মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও আমরা তদন্ত করেছি।হাথরাসে যা হয়েছে, তার কোর্টের অর্ডার আছে।
তবে আর জি কর মামলার রায়ের কপিতেও এর আগে সিবিআই-র তদন্তকারী আধিকারিকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সিবিআই-র তদন্তকারী আধিকারিক হিসাবে সীমা পাহাজা জোরের সঙ্গেই আদালতে ৫০ নম্বর সাক্ষী হিসাবে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, চার তলার সেমিনার রুমই প্লেস অব অকুরেন্স!সেমিনার রুমেই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেন। তা উল্লেখ করেই এরপর রায়ে লেখা হয়েছে- যদিও তিনি আদৌ প্রকৃত ঘটনাস্থল খোঁজা বা প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে ‘অভিযুক্ত’ কে মিথ্যা ভাবে ফাঁসানো হয়েছে- এমন কিছু
প্রমাণ করতেও কোনও উদ্যোগ বা তাৎপরতা তদন্তকারী আধিকারিক হিসাবে তিনি দেখাননি।
তারপরেই রায়ে বলা হয়েছে- কার্যত কলকাতা পুলিশের তদন্তকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করেছেন তিনি।
শুধু তাই নয় আশ্চর্যজনক ভাবে এই সিবিআই আধিকারিক আদালতে কার্যত কলকাতা পুলিশের মেলা তথ্য, নথির ভিত্তিতই তদন্ত এগিয়েছে তা জানিয়েছিলেন। তিনি কোনও অভিযুক্তের আঙুলের ছাপ নেননি, এমনকি বাজেয়াপ্ত হওয়া জিনিসপত্র বিশেষ করে উদ্ধার হওয়া সঞ্জয় রায়ের ছেঁড়া ব্লুটুথ হেডফোনেও আঙুল ছাপ মিলিয়ে দেখেননি। শুধু তাই তদন্তকারী আধিকারিক হিসাবে তিনি নিজে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কোনও নার্সিং স্টাফ,গ্রুপ ডি স্টাফ, কোন আয়াকেও জেরা পর্যন্ত করেননি। যে পেন ড্রাইভে ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ের চারতলার সেমিনার রুমে ৮ আগস্ট রাত দশটা থেকে ৯ আগস্ট সকাল দশটা পর্যন্ত সমস্ত গতিবিধি সিসিটিভি ফুটেজে ধরা ছিল সেই পেন ড্রাইভ পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করার বা সংগ্রহ করার কোনও তৎপরতা দেখাননি সিবিআই-র তদন্তকারী আধিকারিক!
এদিন সিবিআই-র আইনজীবীর কাছে বিচারক জানতে চান, সিসিটিভি-তে কী পাওয়া গিয়েছে? সিবিআই-র আইনজীবী জানান, মোট ৩২টি সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা হয়েছে। নির্যাতিতার পরিবারের আইনজীবী পালটা বলেন, তথাকথিত ঘটনাস্থলে পৌঁছোনোর জন্য আরও দু’টি রাস্তা রয়েছে। কিন্তু সিবিআই কেবল একটি জায়গার সিসিটিভি ফুটেজই দেখেছে, যেখানে সঞ্জয়কে দেখা গিয়েছে। সিবিআই-র একটাই কথা, অভিযুক্তের সাজা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তদন্তের আদৌ কোনও অগ্রগতি হয়েছে? নির্যাতিতার সঙ্গে যে চার জন ডাক্তার ছিলেন, তাঁদের কি হেপাজতে নেওয়া হয়েছে?’’
তখন সিবিআই-র তরফে জানানো হয় শুধু হাসপাতাল নয়, বাইরের ট্র্যাফিকের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও তারা খতিয়ে দেখেছে। চার জনের ‘লাই ডিটেক্টর টেস্ট’ করা হয়েছে। সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের ডিএনএ' র সঙ্গে ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া নমুনা মিলে গিয়েছে। সঞ্জয়কে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। সে-ই প্রথম থেকে অভিযুক্ত। ধর্ষণ খুনে আর কোনও অভিযুক্ত পাওয়া যায়নি। ঘটনার একবছরের মাথায় এদিন ষষ্ঠ স্ট্যাটাস রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে, নতুন করে সাতজন সাক্ষীর বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। সব সিসিটিভি ফুটেজে খতিয়ে দেখা হয়েছে।
অর্থাৎ এরকম সংবেদনশীল ঘটনায় দেশের অন্যতম গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত প্রায় একবছরের মাথায় সেই কলকাতা পুলিশের বিনীত গোয়েলের তদন্ত প্রক্রিয়াতেই আটকে আছে!
Comments :0