BOOK — SUREN MUKHERJEE | RABINDRANATH TAGORE — MUKTADHARA — 24 MAY 2024

বই — সুরেন মুখোপাধ্যায় | রবীন্দ্র সঙ্গীত : এক অনিঃশেষ গীতসুধা — মুক্তধারা | ২৪ মে ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

BOOK  SUREN MUKHERJEE  RABINDRANATH TAGORE  MUKTADHARA  24 MAY 2024

বই

রবীন্দ্র সঙ্গীত : এক অনিঃশেষ গীতসুধা
সুরেন মুখোপাধ্যায়

মুক্তধারা


বঙ্গ সংস্কৃতি অঙ্গনে রবীন্দ্রসঙ্গীত হলো ‘রাতের তারা দিনের রবি’। স্রষ্টা মাত্রেই মনে সংশয় থাকে, সৃষ্টি বাঁচবে তো? নিজেই রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন—‘তবু মনে রেখো’। ‘আমি যে গান গেয়েছিলেম তোমাদের এই হাসিখেলায় মনে রেখো’। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। দীর্থ পথ অতিক্রম করে এসে  আজ আমাদের স্বীকার করতেই হয় কাব্য সঙ্গীতের আকাশে রবিপ্রভা আজও সমান দীপ্যমান। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গসংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ সম্পদই রবীন্দ্রসঙ্গীত। পরিবার বা ব্রাহ্মসমাজের ঘেরেটোপের বাইরে তৎকালীন সংস্কৃতিমনা শ্রেণি যে রবীন্দ্রনাথের গানকে প্রথমে উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন বা বুঝতে পেরেছেন তা নয়। অথচ ক্রমে কালের রথচক্রে তাঁর গানই হয়ে উঠেছে বাঙ্গালির স্বাস-প্রশ্বাস। গীতসুধা। এই দীর্ঘ পথ চলার কালে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করতে হয়েছে অজস্র সমালোচনার তীব্র বিষ, দহন ও জ্বালা। ‘রবিবাবুর গান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত’ বইটি প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রসঙ্গীত ক্রমবিকাশের উপল ব্যথিত গতির একটি চমৎকার লেখচিত্র, লেখক শান্তনু বসুকে অসংখ্য ধন্যবাদ একটি চমৎকার তথ্যনিষ্ঠ বই পাঠকদের উপহার দেবার জন্য। 
রবীন্দ্রনাথের গানের জীবনের প্রথম পর্বে অর্থৎ বাল্যকাল থেকে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তিনি যত গান বা গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন, তার প্রসার ছিল প্রধানত বাড়ির আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং ব্রাহ্মসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিদ্বৎ সমাজের কিছু ব্যক্তি নিমন্ত্রিত হয়ে অনুষ্ঠানে দর্শক হিসাবে যোগ দিলেও সে গান শেখাবার বা প্রসারে আগ্রহ কতখানি ছিল তার কোনও সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুকাল  পর্যন্ত  হলো তাঁর গানের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বের সূচনা থেকেই কিন্তু রবীন্দ্র গানের ব্যাপ্তি দেখা গেল ভিন্নপথে। পারিবারিক পরিসর থেকে সে গান বেরিয়ে এসে হয়ে উঠল আনন্দ বিতরণের উৎস। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রী শিক্ষক ও কর্মীসমাজের মধ্যে তার প্রভাব পড়ল ব্যাপক। বিংশ শতকের প্রথম দুই দশকে শান্তিনিকেতনে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু সঙ্গীতানুষ্ঠান, গান  যুক্ত নাটকের অভিনয় কলকাতাতেও অনুষ্ঠিত হতে লাগলো সুধীজনের আগ্রহে। এসব অনুষ্ঠানে জনসমাগম হতো প্রচুর। রবীন্দ্রনাথের গান জনমানসে ছড়িয়ে দেবার সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায় ১৯০১ সালের পর বিদ্যালয়ের মাধ্যমে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পর্বে যে স্বদেশি গান রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন তা শান্তিনিকেতনের  বেড়া ভেঙে কলকাতা ও অন্যত্র সমাজের যুব সম্প্রদায়কে উদ্বেলিত করেছিল। ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর দেশে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ ও প্রচলন দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে শান্তিনিকেতন  বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক ও কর্মীরা শান্তিনিকেতন থকে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে পরিচিত করার পথ সুগম করে দেয়। যেমন হেমন্ত মু্খোপাধ্যায়ের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডই জনমনে গভীর  হিল্লোল তোলে। গান দুটি ছিল আমার আর হবে না দেরি এবং কেন পান্থ এ চঞ্চলতা; এই রেকর্ডের ট্রেনার ছিলেন শান্তিনিকেতন প্রাক্তনী অনাদী কুমার দস্তিদার। আবার রেকর্ড কোম্পানির সুবাদে অমলা দাশ, মাধুরী দে, অমিতা সেন, বলাই দাস শীল, হরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখও রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচারের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। 
তৎকালে পেশাদারি থিয়েটার রবীন্দ্রগানের প্রসারে গুরুত্বপূ্র্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯২৫ সালে অহীন্দ্র চৌধুরির উদ্যোগে ‘চিরকুমার সভা’ অভিনীত হয়। গান শেখাবার দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই চিরকুমার সভার সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল নীরবালা চরিত্রে নীহার বালার গান। পরবর্তীকালে ‘গৃহপ্রবেশ’ নাটকে হিমির চরিত্রে ছিলেন নীহারবালা। রবীন্দ্রনাথ খুশি হয়ে বলেছিলেন—মেয়েটি বড় ভালো গায়, ওর গান বাড়িয়ে দিয়েছি।’ এইভাবে বিসর্জন নাটকে অন্ধ ভিখারির ভূমিকায় কৃষ্ণচন্দ্র দে, প্রয়শ্চিত্ত নাটকে ধনঞ্জয় বৈরিগীর ভূমিকায় মুকুন্দদাস, তপতী নাটকে কঙ্কাবতী সাউ রবীন্দ্রসঙ্গীতকে  সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকখানি। প্রসঙ্গত বিসর্জন নাটকের আঁধার রাতে একলা পাগল  কৃষ্ণচন্দ্র দে’র কণ্ঠে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে এইচএমভি থেকে তাঁর গানটির রেকর্ডও প্রকাশিত হয়েছিল। রেকর্ড নং : P11782 
এই বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার নেপথ্যে চলচ্চিত্রের অবদান বিস্ময়কর। ‘মুক্তি’ ছায়াছবিতে কাননদেবী কণ্ঠে তার বিদায় বেলার মালা খানি, পঙ্কজ মল্লিক কণ্ঠে আমি কান পেতে রই,জীবন মরণ ছবিতে সাইগল কণ্ঠে আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান, উদয়ের পথে ছবিতে বিনতা রায়ের গাওয়া ওই মালতীলতা দোলে, পরিচয় ছবিতে কানন দেবী কণ্ঠে আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে, আমার বেলা যে যায়, প্রবল জনপ্রিয় হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতে  শ্রোতাদের বিশেষ আবেষ্টনী ভেঙে এসব গান ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। মানুষজন উপলব্ধি করতে শুরু করেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে অপার বৈভব, এবং তাঁর গানের অধরা মাধুরী। 
এই বইয়ের সবকটি প্রবন্ধই সুলিখিত, গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যনিষ্ট। রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলা গান প্রবন্ধে লেখক বাংলা গানের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলি উল্লেখ করেছেন। আবার সমালোচনার আঁচে দগ্ধ চিরন্তন সৃষ্টি ও স্রষ্টা প্রবন্ধে লেখক দেখিয়েছেন কবিতা ও গানের অর্থ, ভাব, দ্যোতনা কিছুই না বুঝে শুধু ব্যক্তি আক্রমণে কিভাবে ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। প্রাথমিক পর্যায়ে রবিবাবুর  গানে কোনও পথ পরিক্রমায় নানা প্রতিকূলতার ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে শিখরস্পর্শী বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে তা সুচারুভাবে আলোচিত হয়েছে। যেহেতু লেখক শান্তনু বসু নিজে  গানের সঙ্গে যুক্ত তাই সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছেন সঙ্গীত জনপ্রিয়তার নেপথ্যে কারণ। স্পষ্টই তিনি বলেছেন—‘‘সাধারণ মানুষের কাছে গানের কোনও বিভাগীয় প্রস্থছেদ বা ক্রশসেকশানাল ভিউ নেই। তাঁরা আলাদা করে গানের লিরিক, সুর যন্ত্রাণুষঙ্গ ইত্যাদির ডিটেলিংয়ের মধ্যে ঢোকেন না। কোনও প্রয়োজনও নেই। সবাই তো আর গবেষক নন। তাঁদের কাছে গান মানে কণ্ঠ তার গায়কি নিসৃত সুর আর কথার মেলবন্ধন, সঙ্গে উপযুক্ত যন্ত্রাণুষঙ্গ, যা তাঁদের হৃদয়কে  স্পর্শ  করে।’’ —সত্যিই তাই, গানের মূল বিষয় হলো মানুষের মনে ভালোবাসা ও অনুভবে স্থান করে নেওয়া। গান যখন পরিবেশন করা হয় তখন শ্রোতাদের  জন্যই করা হয়। শ্রোতারা গান শোনে সার্বিকভাবে। গানকে তাই শিল্পীর প্রয়োগের ওপর নির্ভর করতেই হয়। স্বরলিপির কাঠামোয় দৃষ্টি দিতে গিয়ে গান যদি স্বরে আবৃত্তি হয়, শিল্পীর আড়ষ্টতা আসে তবে গানের পঞ্চত্ব প্রাপ্তি। এই বইয়ের আর একটি বড় আকর্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের কালানুক্রমিক সূচি। যা খুবই উপযোগী সংযোজন। ‘রবিবাবুর গান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত’ নিঃসন্দেহে মূল্যবান গ্রন্থ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের  কোরক উন্মোচনে এই বই সত্যিকারের আশ্রয়। বইটির বহুল প্রচার আশা করি। 
 

রবিবাবুর গান থেকে রবীন্দ্রনাথ
শান্তনু বসু। 

অভিযান পাবলিশার্স। ১০/২এ, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট। 

কলকাতা — ৭০০০০৯। 

৪০০ টাকা।

Comments :0

Login to leave a comment