STORY — SANDIP JANA / NATUNPATA

গল্প — ব্যাগ-ট্যাগের কথা / নতুনপাতা

ছোটদের বিভাগ

STORY  SANDIP JANA  NATUNPATA

গল্প

ব্যাগ-ট্যাগের কথা
সন্দীপ জানা


মেন গেটে সিকিউরিটি গার্ড এন্ট্রি টাইম লেখার জন্য পেনটা হাতে নিয়ে চটপট ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু থমকে গেল। আমার সামনে পেছনে ভালো করে একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আউটডোরের কোনো কাজ সেরে আসছেন?’ আউটডোরে আমার কোনো কাজ থাকে না। হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভ্রূ-টা আপনা থেকেই কুচকে গেল। বললাম, ‘না তো! কেন?’
‘না মানে…সাথে ব্যাগ ট্যাগ…’।
‘ও আচ্ছা! খেয়াল হল আজ একটু অন্যরকম মেজাজে অফিসে ঢুকছি। কাছে ছাতা নেই, জলের বোতল নেই, সাথে লাঞ্চ
বা টিফিন _তাও নেই। এসব যখন নেই তখন অতবড়ো ঝোলাটা আর কাঁধে ঝুলিয়ে বয়ে বেড়ানো কেন!পকেটে মোবাইল ফোন আর কিছু টাকাই যথেষ্ট। বেশ হালকা লাগছে। কাঁধে প্রতিদিন বোঝা বইতে বইতে এতটুকু পরিবর্তনই যেন বেশ অন্যরকম মেজাজের। জামাতে ব্যাগের ফিতে বরাবর কাঁধের কাছে  ঘাম-ময়লার দাগ, ট্রেনে বাসে অটোতে অন্যের গায়ে ব্যাগ লাগা নিয়ে ঝামেলা, বসার জায়গা পেলেও কোলের ওপর ব্যাগ রাখার অস্বস্তি, বাঙ্কারে রেখেও চুরি যাওয়ার দুশ্চিন্তা__কাছে ব্যাগ না -থাকলে এসবের কোনো বালাই নেই। 
হেসে সিকিউরিটিকে বললাম, ‘নাহ, আজ ঝোলা-টোলার ঝামেলা নেই’। সেও একটু হাসল। অফিসে ঢুকে দেখি বাকিরা কেউ তখনো এসে পৌঁছিয়নি। প্রয়োজনীয় কাগজগুলোর প্রিন্ট নিয়ে ওয়ার্কশপে গেলাম। মিনিট চল্লিশ পর ফিরে এসে দেখি সবার টেবিলে জলের বোতল, চায়ের কাপ দেওয়া হয়ে গেছে, ব্যাতিক্রম আমারটা।


বললাম, ‘কি ব্যাপার অরুণদা, আমার টেবিলে চা পড়েনি কেন?’
‘অ-অ-অ…, তুমি এসেছ! রাজু চা দিতে এসে দেখে ডেস্কে তুমি নেই। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি বললাম, দেখ এসেছে কিনা। আসলে তো ব্যাগ-ট্যাগ থাকত টেবিলে।’
‘আরে, ব্যাগ নেই মানে আমি নেই! আমার ডেস্কটপটা তো অন করা ছিল, টেবিলে ফাইল কাগজপত্র ছড়ানো ছিল। আমি 
না -এসে থাকলে এসব…’। বলতে বলতে পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠল। ডিরেক্টর স্যারের ফোন। ফোনটা ধরতেই ওপার থেকে উত্তেজিত গলায় তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘তোমার তো এখন দেখছি রোজ রোজ অসুবিধা হয়ে যাচ্ছে। ভাল না -লাগলে কাজ ছেড়ে দাও। কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি আমার কোম্পানিতে থাকার জন্য। সবাই মিলে এরকম করলে তো আমাকে কোম্পানির ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে সন্ন্যাসী হতে হয় দেখছি!’
চৌধুরীবাবুর হঠাৎ সন্ন্যাস নেওয়ার কি কারণ ঘটল বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘কি হয়েছে স্যার? উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?’
‘কি হয়েছে মানে! আজ আবার নোটিশ ছাড়া কামাই করলে কাকে বলে?’
‘কামাই? আমি তো অফিসের ডেস্কে বসে…’
ওদিকে এতক্ষণে যেন আগুনে জল পড়ল। একটু থেমে তারপর নরমভাবে বললেন, ওঅহ…তবে সুদীপ যে বলল তুমি নাকি আজ আসোনি, তাই…। যাইহোক নতুন প্রোজেক্টের কাগজগুলো আমার কাছে নিয়ে এস একটু।’


আমি দাঁত কড়মড়িয়ে সুদীপের দিকে তাকালাম। এতক্ষণে তার কিছু একটা মনে পড়েছে। সে জিভ কেটে লম্বা দাঁতগুলো নির্লজ্জের মতো বের করে বলল, ‘ আরে রে-রে-রে-রে… তুমি এসেছ! একটু আগে চৌধুরীবাবু ল্যানে ফোন করে তোমাকে খুঁজছিল। তোমাকে দেখতে পেলাম না, টেবিলে তোমার ব্যাগও নেই। ভাবলাম আজ ডুব মেরে দিয়েছ…
যাইহোক, অফিসে বাকি সময়টুকু আর বিশেষ কিছু ঘটল না। গেটে সিকিউরিটি গার্ড আউট টাইম নোট করার সময় একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, বেরোচ্ছেন?’
আমি বিরক্ত হয়ে তাকে ঘড়ির দিকে ইশারা করলাম, সন্ধ্যা সাতটা বাজছে। সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘না , মানে আজ আপনার সাথে ঝোলা নেই তো, তাই একটু কনফিউজ হয়ে যাচ্ছি’।
অটোতে বসে একটু হাঁফ ছাড়লাম। উফ! সারাটা দিন ব্যাগ ব্যাগ করে…। ওদিক থেকে অটোচালক আবিরদা একটু আড় চোখে আমাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘অফিস থেকে? না অন্য কোনো কাজে?’
‘অফিস ছাড়া আর এদিকে আর কি প্রয়োজন…’
‘তাও বটে। কিন্তু সাথে ব্যাগ -ট্যাগ…’
ব্যাগ- একটা বড়ো ট্যাগ-ই বটে! সেই স্কুল-ব্যাগ থেকে অফিস-ব্যাগ, বোঝাটাই আমাদের পরিচয়, অস্তিত্ব। বোঝা বয়ে বেড়ানোটাই স্বাভাবিক, না -বওয়াটা যেন বড্ড বেশি অস্বাভাবিক। এর অনুপস্থিতিতে গোটা দুনিয়ার চোখে জিজ্ঞাসু ভাবটা প্রকট হয়ে ওঠে, ‘কে তুমি, কাঁধে ‘বোঝা’ নেই?...’

 

Comments :0

Login to leave a comment