Ultra Nationalism Women

দেশপ্রেম, মিডিয়া এবং ভারতের মহিলা

উত্তর সম্পাদকীয়​

দীপ্সিতা ধর
বড় পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে সৃজনী, দোষের মধ্যে পদবি ছেঁটে ফেলেছেন, জাত ধর্ম ইত্যাদির পরিচয় সঙ্গে নিয়ে ঘুরবেন না বলে। আমাদের সংবিধান এবং আইনে ব্যক্তির এটুকু ইচ্ছার মর্যাদা দেওয়ার পরিসর এখনও বহাল আছে। অনেকে মনে করেন পদবি আসলে সামাজিক পুঁজির সূচক। জনতা দল আন্দোলনের সময় গোটা উত্তর ভারত জুড়ে বিশেষত উচ্চ বর্ণের সমাজবাদীরা (লোহিয়া পন্থী) জাতি সূচক পদবি ব্যবহার করা বন্ধ করেন। মনে পড়ে, বালি চিত্তরঞ্জন স্কুলের শিক্ষক শম্ভুবাবু ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘সুশ্রত চার্বাক’, ঐটুকুই, পদবি ছিল না। আমাদের পাড়া গাঁয়ে তাই নিয়ে অস্বস্তি ছিল, কিন্তু সে হিন্দু কিনা তাই নিয়ে প্রশ্ন ছিল না আজ থেকে ২৫ বছর আগে। কোনও সন্ত্রাসী হামলায় পদবি যুক্ত হিন্দুদের পরিবর্তে, ওর মরে যাওয়া উচিত এমন কুৎসিত কথা বলার মানসিকতা তখনও তৈরি হয়নি। সদ্য কৈশোর পেরোনো একটি মেয়েকে শুধুমাত্র পদবি না থাকার জন্য ধর্ষণের হুমকি পেতে হবে? কেন তাদের মতো ‘সেকুলার’ রাই সব সমস্যার কারণ, সেটাই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে এতক্ষণে! ওর পরিবারের কোনও মহিলার শরীরে পাকিস্তানের রক্ত আছে সেই সার্টিফিকেটও পেয়ে গেছে সৃজনী! 
বাবার, স্বামীর, ধর্মের, জাতের, প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়া মেয়েদের স্বতন্ত্র পরিচয় নেই, থাকতে নেই, সেই কবে মনু বাবাজি শিখিয়ে গেছেন। মাঝের কয়েক শতক রামমোহন, বিদ্যাসাগর, জ্যোতিরাও, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, আম্বেদকররা চেষ্টা করেছিলেন বটে, তবে সেসব আলো এখন অতীত! ইয়ং বেঙ্গলের উত্তরসূরিদের হাতে এখন তাবিজ, কবজ, আংটি। তারা ‘সহি’ কিছু একটা হতে চায়, আর তাতে এ সমস্ত কিছুই জায়েজ।
সদ্য সাথি বিয়োগ হয়েছে মেয়েটির, সন্ত্রাসবাদীর বুলেট ঝাঁঝড়া করে দিয়েছে বুক, কফিনে মোড়া প্রিয় মানুষের মুখটায় শেষবারের মতো চুমে ভেঙে পড়েছিলেন মেয়েটি। তারপর চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে, হাজার মিডিয়ার বুমের সামনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, "হিন্দু মুসলিম করবেন না, দোষীদের শাস্তি দিন"। সোশাল মিডিয়ায় নিন্দার ঝড় বয়েছে, মেয়েটি যে আসলে ‘বারবনিতা’, মেয়েটির যে আসলে ‘কাশ্মীরি’ বয়ফ্রেন্ড আছে, মেয়েটির যে একেবারেই বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই, তা ইতিমধ্যে ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেটিজেনরা প্রমাণ করে দিয়েছে। রক্ত পিপাসু মিডিয়া ফ্রেঞ্জি, কাশ্মীরি ছাত্র, ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা, মুসলমান দোকানদারদের খুন, এইসবে সে যোগ দেবে না কেন? হিন্দু শহীদের বিধবা হিসাবে সে নরসংহারের ডাক দেবে না কেন? ঘৃণার চাষে তার তো জল দেওয়ার কথা, তা না করে একলা মেয়ে হয়ে আগাছার মূল ধরে সে টান দেয় কোন সাহসে! এতো স্পর্ধা! অতএব শহীদের স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলো, মৃত্যুর, দলবদ্ধধর্ষণের নিদান দাও, ‘নতুন ভারতবর্ষ’-এ ওকে ওর অওকাত বুঝিয়ে দাও। ‘নতুন ভারত’-এ মেয়েদের কথা কম বলতে হয়, ভাবতে কম হয়, আদর্শ মেয়েরা মুখ বুজে স্বামীর সেবা করবেন, বাচ্চা পয়দা করবেন এবং প্রয়োজনে (সমাজ চাইলে) এথনিক ক্লিনসিং-এর ডাক দেবেন— এই লক্ষণ রেখা পার করলেই মুশকিল।

উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা সাইলা সিং, হিন্দু, মহিলা। ১২ বছরের মেয়ের ধর্ষণের ঘটনায় গোটা রাজ্য উত্তাল, কারণ ধর্ষক মুসলমান, বেছে বেছে মুসলমানদের বাড়ি দোকান ভাঙচুর হচ্ছে, দোষী ধরা পড়ার পরেও তাকে পাবলিকের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ডাক, প্রতিবাদ মিছিলে ধর্ষিতা মেয়েটির ইনসাফের চাইতে ধর্মীয় স্লোগান, বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি গালি গালাজের ছড়াছড়ি। রুখে দাঁড়িয়েছিল সাইলা, জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা গোশালাতে যখন  ধর্ষণ হয় তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? মুসলমানদের দোকান ভাঙছেন, কিন্তু মেয়েটির কথা বলছেন না, আপনারা বিচার চান না, দাঙ্গা? পরেরটুকু আন্দাজ করাতে কোথাও কোনও পুরস্কার নেই, রেপ থ্রেট, রেপ করে পাকিস্তানে ফেলে দাও ইত্যাদি নিদান। রাতে কার কার বিছানা গরম করার কাজে এ মেয়ে লাগতে পারে, এসব নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া চলেছে কমেন্ট বক্স জুড়ে। চোখের টলটলে জল চেপে শাইলা বলে গেছে, "আমি ভয় পাইনি, ওরা যা করবে করুক, অসহায় নিরপরাধ মানুষের দোকান ভেঙেছে ওরা, খালি মুসলিম বলে, ওরা ব্যাপারী না? কাল যদি আমাদের দোকান ভাঙে? কে বাঁচাতে আসবে?" সাইলা মব মেন্টালিটিকে প্রশ্ন করেছে, গায়ের জোরে, সংখ্যার জোরে, পুলিশের নজরদারিতে হওয়া হিংসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, এ দামি প্রশ্ন, খাঁটি প্রশ্ন।
কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদী হামলায় সরকারি সুরক্ষা মন্ত্রকের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল লোকসঙ্গীত শিল্পী নেহা রাঠোর এবং পলিটিকাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর মিস মেডুসা, এখানে আর খালি সাইবার বুলিং অবধি থেমে থাকেনি, এই সাইবার বুলিদের মাথায় ছাতা ধরা রাষ্ট্র এই দুই মেয়ের বিরুদ্ধে FIR দায়ের করেছে। ওদিকে সনাতনী সভার দুই হিন্দু পাকিস্তানের পতাকা লাগিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ লিখে দাঙ্গা সাজানোর চেষ্টা করার পরেও পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ তাকে জেলে ভরে রাখতে পারেনি, কঠোর ধারা দিতে পারেনি, তুরন্ত জামিন হয়েছে। দাঙ্গা লাগানোর মতো পরম পুণ্য কাজ করার জন্য ফুল মালা দিয়ে তাকে বরণ করেছে স্থানীয় বিজেপি। উত্তর হাওড়ায় দিনের আলোয় খালি গায়ে লাঠি হাতে বাংলার বিজাতীয় ভাষায় মুসলমানদের আক্রমণ করেছে বছর কুড়ির ছেলে, ভিডিও ছড়িয়েছে, বাহবা কুড়িয়েছে।
মোদীর উত্তর ভারতে প্রতিদিন ‘হিন্দুবীরের’ নামে এক টক্সিক ম্যসকুলিনিটিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। যে ‘বীর’ পড়ে কম, পেশি চর্চায় মন দেয় বেশি, যে ‘বীর’ বহন-বেটির রক্ষাকর্তা হওয়ার নামে হনর কিলিং-এ পিছপা হয় না, দলিতের ঘোড়া চড়ার অপরাধে তাকে মারতে তৈরি থাকে, গলায় সোনার চেন হাতে সোনার বালা পড়ে সে গরিব আদিবাসী পাড়ায় গিয়ে ধর্মান্তরের বিরুদ্ধে শাসিয়ে আসে। এমন ‘বীর’রা যেখানে আইকন, সেখানে মেয়েদের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না, ট্রাডিশনাল পুরুষের পৌরুষ অবিঘ্নিত রাখতে তাই লাগবে ট্রাডিশনাল নারী, ‘সংস্কারী’ নারী। যে নারী মিক্সি থাকলেও শিলনোড়াতে মশলা বাটবেন, শ্বশুর মশাইয়ের পায়ে চটি পরিয়ে দেবেন, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর দ্বারা ধর্ষিতা হবেন এবং নিজের কোনও মতামতই রাখবেন না। সৃজনী থেকে নেহা রাঠোর, এই আদর্শ নারীর উলটো দিকে তৈরি হওয়া চিত্রকল্প, ওরা একটা গুমোট আবহে প্রতিদিন এক চিলতে আকাশের লড়াইকে বাঁচিয়ে রাখে, তাই ওদের কর্দমাক্ত করার এত উদগ্র প্রয়াস, হিংস্র আস্ফালন।

কাদার কথায় মনে পড়ে গেল, মা সাবিত্রী বাঈ যখন প্রথম মেয়েদের স্কুল খুললেন, মেয়েদের পড়ানোর অপরাধে তার গায়ে কাদা ছুঁড়তো পাড়া প্রতিবেশী। সাবিত্রী দুটো শাড়ি পরে বেরোতেন, কাদা মাখা শাড়ির ভিতরে থাকতো পরিষ্কার শাড়ি, ঐ শাড়িতে সারাদিন মেয়েদের পড়িয়ে আবার কাদা মাখা শাড়িতে বাড়ি ফিরতেন। মেয়েদের ‘মানুষ’ হতে আসলে অনেকগুলো বছর লেগেছে, এমন অনেক নাম না জানা কাদা মাখা শাড়ি পেরিয়ে রোকেয়া কল্পনা ইলা আমাদের জন্য বিছিয়ে গেছেন স্বপ্নের নুড়ি পাথর। আমার বিশ্বাস করতে ভালো লাগে এই দম বন্ধ করা, গলায় বুট নামিয়ে দেওয়া অন্ধকার সময়েও, এই নুড়ি পাথরগুলোই আলোর মশাল হবে। ‘আমাদের ভয় নেই’, সমস্বরে একথা বলতে একদিন আমাদেরও আর ভয় হবে না।

Comments :0

Login to leave a comment