সুকুমার পাইন
কেলেঙ্কারির একশেষ
নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি খারিজ হবার ঘটনায় সারা রাজ্য এই মুহূর্তে তোলপাড়।
২০১৬ সালের শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পরীক্ষা এসএলএসটি ২০১৬, এই রাজ্যের ইতিহাসে বৃহত্তম কেলেঙ্কারিগুলির একটি। ওই পরীক্ষার প্যানেল আর মেধা তালিকা নিয়ে বহু অভিযোগ ওঠে। লিখিত পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েও মেধা তালিকার ওপর দিকে নাম থাকা, আদৌ লিখিত পরীক্ষা না দিয়ে মেধা তালিকায় নাম থাকা, মেধাতালিকায় নিচের ধাপে থাকা প্রার্থীদের আগে নিয়োগ, পাশ না করা ব্যক্তিদের নিয়োগ, প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরেও নিয়োগ ইত্যাদি বহুবিধ দুর্নীতি।
রণজিৎ বাগ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বহু অনিয়মের কথা প্রমাণিত হয় — অনেকের নম্বর পালটানো হয়েছে, মেধা তালিকার ক্রমিক সংখ্যার হেরফের করা হয়েছে, ভুয়ো নিয়োগপত্র তৈরি হয়েছে এবং ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছে। অভিযোগ উঠল, তৃণমূল দলের ঘনিষ্ঠ সব আমলার বিরুদ্ধে - সৌমিত্র সরকার, অশোক কুমার সাহা, ড. শান্তিপ্রসাদ সিনহা, ড. কল্যাণময় গাঙ্গুলি, স্কুল সার্ভিস কমিশনের অস্থায়ী কর্মী সমরজিৎ আচার্য। জালিয়াতি হয়েছিল অভূতপূর্ব মাত্রায়। ওএমআর শিট আর তার স্ক্যান করা কপি, হার্ড ডিস্কের রেকর্ড সব কিছু নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল।
সিবিআই তদন্তে জানা গেছে, সেন্ট্রাল স্কুল সার্ভিস কমিশন অনেক রাজ্যে বেআইনি কার্যকলাপের অভিযোগে অভিযুক্ত দিল্লির সংস্থা ‘নাইসা কমিউনিকেশনস’-কে নিয়মবহির্ভূতভাবে ওএমআর শিট পরীক্ষা ও তার ফল নথিবদ্ধ করার দায়িত্ব দেয়। এই নাইসা আবার ওই দায়িত্ব দেয় দিল্লির ‘ডাটা স্ক্যানটেক’নামের অপর এক সংস্থাকে। নাইসা ও ডাটা স্ক্যানটেক-র ডিস্ক এবং কমিশনের সার্ভার থেকে উদ্ধার করা তথ্যেও অপরাধ প্রমাণিত হয়। জানা যায়, অবৈধ পদ্ধতিতে নিয়োগের মোট সংখ্যা ৮হাজার ৩২৪ জন। ওই ৮হাজার ৩২৪ জনের মধ্যে বহু তৃণমূল নেতা-কর্মীদের আত্মীয়দের নাম রয়েছে। বাকি ১৭ হাজার ৩ জনের ক্ষেত্রে নিয়োগ বৈধ না কি অবৈধ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয়নি।
এসএলএসটি কেলেঙ্কারির মোট অর্থের পরিমাণ ৮-৯ হাজার কোটি টাকার কম নয়। পার্থ চ্যাটার্জি, বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়, শান্তিপ্রসাদ সিনহা, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, জীবনকৃষ্ণ সাহা ইত্যাদি তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার নগদ, সোনা আর সম্পত্তির দলিল উদ্ধার হয়েছে।
চূড়ান্ত শাস্তি
চূড়ান্ত রায় অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সঞ্জীব খান্না আর সঞ্জয় কুমার তাঁদের চূড়ান্ত রায়ে সমস্ত প্যানেলটিই খারিজ করে, সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে নতুন করে শিক্ষক নির্বাচন করার নির্দেশ দেন।
মোট নিয়োগ হয়েছিলেন ২৫ হাজার ৭৫৩ জন। অবৈধভাবে নিযূক্ত ৮হাজার ৩২৪ জনকে প্রাপ্ত সকল বেতন ১২ শতাংশ সুদ সহ ফেরত দিতে হবে। ৪২৫ জন ইচ্ছা করলে তাঁদের পুরাতন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেন। অপর ১৭ হাজার ৩ জনকে বেতন ফেরত দিতে হবে না। শূন্যপদগুলিতে নিয়োগের জন্য নতুন পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন প্যানেল তৈরি করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বক্তব্য হল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও কেন্দ্রীয় স্কুল সার্ভিস কমিশন নথি বিনষ্ট ও তথ্য বিকৃত করেছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ করেছে। এর ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংবিধানের ১৪নং ধারা (‘আইনের চোখে সমতা’) এবং ১৬নং ধারা (নিয়োগের ক্ষেত্রে সমান সুযোগের অধিকার) লঙ্ঘিত হয়েছে। এই কারণেই সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই বাতিল করা হয়েছে। এখানে যোগ্য বা অযোগ্য নির্ধারণের ঘটনাটি গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ষড়যন্ত্রের ঊর্ণাজাল
একদিনে এই সুবিশাল প্রতারণাচক্র গড়ে ওঠেনি। তৃণমূল দলটি মিথ্যাচার ও দুর্নীতি ছাড়া টিকতে পারে না। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই দলটি সারদা, পঞ্জি স্কিম, নারদ ঘুষকাণ্ড, রেশন দুর্নীতি ইত্যাদি কেলেঙ্কারির সঙ্গে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার সঙ্গে দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মী, এমনকি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের একাধিক ব্যক্তি জড়িত। এই ক্ষেত্রে বহু দিন ধরে ধাপে ধাপে ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে, জাল বিছানো হয়েছে। ২০১১ সালে তৃণমূল সরকার নির্বাচিত মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বোর্ড ভেঙে দিয়ে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করে। ২০১৩-১৪ সালে রাজ্য সরকার জোর করে সবকয়টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়কে স্পনসর্ড বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করল। ফলে পরিচালন সমিতিগুলি সব হয়ে গেল মনোনীত, যেখানে সভাপতি, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি, অভিভাবক — সবাই হলেন কার্যত তৃণমূল দলের সদস্য বা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। ২০১৩ সালে নিয়োগের রস্টার রাখার ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হলো। রাজ্য সরকার রস্টারের দায়িত্বও পর্ষদের হাতে স্থানান্তর করে। এর পরে বিদ্যালয়ে নিয়োগের ক্ষমতাও সরাসরি দেওয়া হলো পর্ষদের সভাপতির হাতে।
তার মানে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি অগণতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীভূত করা হলো পর্ষদের নিয়ন্ত্রণে, আর কার্যত সমস্ত কর্মপদ্ধতিটিই কুক্ষিগত হলো সরাসরি তৃণমূল দলের কর্মকর্তাদের হাতে।
ম্যঁয় নেহি মকখন খায়ো… ম্যঁয় নে হি মকখন খায়ো
তৃণমূল দল এবং তার অনুপ্রেরণাদাত্রী মমতা দেবী যথারীতি বামপন্থীদের ‘চক্রান্ত’ এবং ‘রাম-বাম’ জোটের কথা বলে চাকরি হারানোর সব দায় বিশেষত বামপন্থীদের ওপরে চাপাচ্ছেন। অথচ চক্রান্ত করলেন, ঘুষ খেলেন, জালিয়াতি করলেন, ভুয়ো নিয়োগপত্র দিলেন তৃণমূল নেতা কর্মীরাই। খোদ কুণাল ঘোষের বক্তব্য অনুসারে তার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী খোদ মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী চাকরিহারাদের বিভ্রান্ত করছেন একের পর এক মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, অযৌক্তিক কর্মসূচি নিয়ে। ঘুষ খেয়ে আট হাজার অবৈধ নিয়োগ ঘটেছে, একে কি ভুল বলা চলে? রিভিউ পিটিশন? আইনজীবীদের মতে নতুন কোনও তথ্য না দিতে পারলে, রিভিউ পিটিশনে কোনও কাজ হবে না।
আবার একই সঙ্গে নিয়ে চলেছেন নানা প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থাও। প্যানেল বাতিলের পরে কলকাতা জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসে চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিক্ষোভ জানাতে গেলে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধেই পুলিশের ওপরে হামলা, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর ইত্যাদি অভিযোগে আট দফা ধারায় মামলা রুজু করা হয়।
পিঠ বাঁচাবার অন্তহীন আকুতিতে এমন কি বামফ্রন্ট আমলের নানা ঘটনা নিয়ে কুৎসামূলক প্রচার চলেছে অথচ ইতিমধ্যেই সেগুলি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। প্রচার করা হচ্ছে তথাকথিত কিছু নিয়োগকালীন দুর্নীতি নিয়ে, ৬০ বছরে অবসরের ক্ষেত্রে চাকরি খারিজ হওয়ার মিথ্যা প্রচার নিয়ে, এমন কি সাঁইবাড়ি, বিজন সেতু বা মরিচঝাঁপির ঘটনার মতো অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এতেই বোঝা যায়, তৃণমূল দলটি মরিয়া হয়ে উঠেছে।
রাজ্যে কুস্তি, দিল্লিতে দোস্তি?
মজার ব্যাপার হলো, রাজ্যে এখন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। কিন্তু এই সঙ্কটে না তাদের দেখা যাচ্ছে সর্বাত্মক আন্দোলনে, না রয়েছে তারা আইনি লড়াইয়ে। বিধানসভায় কিছু গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে আর নামকেওয়াস্তে কিছু মিছিল করে তারা দায় সেরেছে। শুধু তাই নয়। সিবিআই’র চার্জশিট এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে হাতে গোনা কয়েকজন অপরাধীকে চিহ্নিত করেই তাদের কাজ শেষ হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি কি সত্যিই দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল দলটিকে শাস্তি দিতে বা অপসারণ করতে আগ্রহী? বাস্তবে, বিজেপি’র কাছে তৃণমূলের থেকে অনেক বড় শত্রু বামপন্থীরা। এই মুহূর্তে তৃণমূল হেরে গেলে সরকারে বামপন্থীরা ছাড়া আর কেউ আসতে পারবে না। এই ঘটনা তৃণমূল আর বিজেপি, কারও কাছেই সুখকর নয়। বরং তৃণমূল-বিজেপি বাইনারি বজায় রাখা অনেক বেশি জরুরি। তাই শেষ বিচারে সিবিআই, বা বিজেপি, দু’-একজন নেতাকে বলি দিয়ে সযত্নে তৃণমূল দলটির মূল কাঠামো এবং তার ভরকেন্দ্র শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সযত্নে আগলে রাখছে।
লড়াইয়ের দায় বামপন্থীদেরই
৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের তুলনা চলেই আসে। সেই আমল, যখন বিদ্যালয়গুলিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পরিচালন সমিতি ছিল, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ছিল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বোর্ড, শিক্ষাক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক বাতাবরণে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের আড়ালে দুর্নীতি-জালিয়াতির অবাধ সুযোগ ছিল না। নিয়মিত শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের পরীক্ষা হত, কোনও অভিযোগ ছাড়াই স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ হতো। শিক্ষকদের সসম্মান সম্বোধনে আপ্যায়িত করা হত; বেতনভুক আজ্ঞাবহ সারমেয় অপবাদ দেওয়া হত না।
সেই বাতাবরণ ফিরিয়ে আনায় সর্বশক্তি নিয়ে লড়াই করে চলেছে নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি। নিয়োগ জালিয়াতি প্রকাশ হবার পর থেকেই আমাদের সংগঠন প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করেছে। বঞ্চিত প্রার্থীদের অবস্থানে সমিতিও শামিল হয়েছে। আইনি লড়াইয়ে প্রথম থেকেই নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি মামলায় অংশ নিয়েছে, এবং অর্থসাহায্য ও আইনি সহায়তা প্রদান করেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে, প্রতিটি জেলায়, এবং সম্ভবমতো মহকুমা বা স্কুল ভিত্তিতেও বিক্ষোভ মিছিল, সভা, ব্যাজ ধারণ ইত্যাদি কর্মসূচি নিয়েছে ও নিয়ে চলেছে। আদালতের রায় মেনে নিয়েই শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের স্বার্থরক্ষায় নিরলস সংগ্রাম চলছে। আগামী ১৭ এপ্রিল বেলা ১টার সময়ে নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির ডাকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ অভিযানের কর্মসূচি পালিত হবে।
তবে এই লড়াই একলার নয়। আর সেটা জেনেই বামপন্থী অন্যান্য সংগঠন - ভারতের ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন, সারা ভারত মহিলা সমিতি, সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস, সামাজিক ন্যায়মঞ্চ ইত্যাদি গণসংগঠনগুলিও কর্মসূচিতে একত্রে যোগদানের কথা ঘোষণা করেছে।
তুমি কষে ধরো হাল, আমি তুলে বাঁধি পাল
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের প্রতি আস্থা জানিয়ে আগামী দিনে লড়াইয়ের ময়দানে আমাদের দাবিগুলি -
১. স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্রুত নিয়োগ করে সাধারণের শিক্ষা ব্যবস্থা রক্ষা করো। ২. যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের হকের চাকরি ফেরত দাও। ৩. শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতির সাথে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাও।
লড়াই আমাদের চলবেই-শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্র-অভিভাবক, যুবক সম্প্রদায়, মহিলা সমাজ, শ্রমজীবী মানুষ সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একত্রে জোটবদ্ধ করেই এই লড়াই লড়তে হবে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল দলটিকে গদিচ্যুত না করতে পারলে অন্য কোনও উপায়েই সমস্যার সমাধান হবে না।
Comments :0