সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক দর্শন প্রয়োগ করছে বিজেপি-আরএসএস। এই দৃষ্টিভঙ্গি সংবিধানে স্বীকৃত বহুত্বকে মানে না। এদের কাছে জাতীয়তাবাদ মানে ‘এক দেশ, এক ভাষা’। তাই বাংলাভাষীদের বাংলাদেশি বলে নিপীড়ন। তাই ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে ভোটাধিকার কেড়ে নিতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে নামানো।
প্রয়াত সিপিআই(এম) নেতা ও বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী স্মরণে আলোচনা সভায় একথা বলেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। ভোটার তালিকায় নাম বাদ দেওয়ার আশঙ্কা বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গে। পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলা বলার জন্য বাংলাদেশি বলা হচ্ছে। চলছে নির্যাতন। সেই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেই একথা বলেন সেলিম।
রবিবার পানিহাটি লোক সংস্কৃতি মঞ্চে ‘অশান্ত সময়: বিপন্ন স্বদেশ’ শীর্ষ আলোচনায় অংশ নেন উপেন বিশ্বাস, সৃজন ভ্টাচার্য, ডাঃ তমোনাশ চৌধুরী, পলাশ দাসও। সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা তড়িৎ তোপদার।
সেলিম বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে অনাহারে মৃত্যু হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অসহ্য নির্যাতন চলছে। দিল্লি পুলিশ বঙ্গভবনে চিঠি দিয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশি সন্দেহে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। আধার, প্যান কার্ড বাংলাদেশি ভাষায় লেখায়। হিন্দি বা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিন। সেলিম বলেন, সংবিধানে স্বীকৃত ভাষার মধ্যে বাংলাও আছে। তাকে বলছে ‘বাংলাদেশি ভাষা’।’’
তিনি বলেন, ‘‘করোনার সময় আদালত বলল কী করে বুঝলে বাংলাদেশি? দিল্লি পুলিশ বলল, উচ্চারণের ধরন শুনে বোঝা গিয়েছে! অথচ বাংলার জেলায় জেলায় উচ্চারণের ধরণে ফারাক আছে। আসলে সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রবাদের নাম করে এক ভাষা, এক ধর্ম চাপিয়ে দিলে এক জাতি হবে। এই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বাংলাদেশি তৎপরতা।’’
সেলিম বলেছেন যে বামপন্থীদের সঙ্গে এখানেই তফাৎ। আমাদের দেশ বহুভাষী। আমরা মনে করি বহুত্ব গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আক্রমণকে আমরা নিন্দা করছি সে কারণে।
এসআইআর প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘রাজ্যের কমিশন যেমন রাজ্য সরকারের পকেটে। তেমন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রের প্রলম্বিত বাহু। আমরাই তো বলেছি ভোটার তালিকায় গোলমাল আছে। তালিকা ঠিক করতে হবে। আজ পর্যন্ত নির্ভুল ভোটার লিস্ট করতে পারল না। কিন্তু এসআইআর নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরির জন্য নয়। এখন ভোটদাতাকে প্রমাণ দিতে হবে সে ভারতীয়, সে ওখানেই থাকে। প্রমাণ দিতে হবে বাবা মা নাগরিক।’’
সেলিম বলেন, এনআরসি যখন এসেছিল মনে হয়েছিল মুসলমানদের ব্যাপার। মতুয়াদের সেটিই বিশ্বাস করিয়েছিল। চার দশক ধরে বলেছে অনুপ্রবেশকারী, তখন বলল নাগরিকত্ব দেব। আসলে নাগরিকত্ব দেবে না। নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য সিএএ-এনআরসি হয়নি। নতুন করে বলল নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে। এটি গণতন্ত্রের সংকোচন। আমরা বামপন্থীরা রাজ্যে সরকার পরিচালনার সময়, ঠিক উলটো, গণতন্ত্রের সম্প্রসারণ করেছিলাম।’’ সেলিম বলেন, ‘‘বাংলাদেশি যদি কেউ থাকে তার দোষ বাংলাভাষায় যারা কথা বলে তাদের? সীমান্ত তোমার পাহারা দেওয়ার কথা, কাটাতারের পরও গরু পাচার, মানব পাচার হচ্ছে। দায় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের। দায় চাপানো হচ্ছে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর।
সুভাষ চক্রবর্তী বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষার অধিকার, ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোট দেওয়ার অধিকার দেওবার চেষ্টা করেছিল। সমস্যা ছিল, তাকে দূর করার চেষ্টাও হয়েছে। আজ অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাকে রুখতে হবে।
সেলিম বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভাঙা হচ্ছে। পঞ্চায়েত, পৌরসভার গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অথচ বিকেন্দ্রীকরণের এই মডেল এ রাজ্য তৈরি করেছিল পরে যা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। কাঠামো ভাঙা হচ্ছে, যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ‘পাড়ায় সমাধান’। আসলে বিকেন্দ্রীকরণকে অকেজো করা হয়েছে। জনগণের টাকা আইন অনুযায়ী এভাবে খরচ হতে পারে না।’’
তাঁর আহ্বান, বিপন্নতাই শেষ কথা নয়। আসল কথা বিপন্নতা কাটিয়ে দেশকে, দেশের মানুষকে রক্ষা করা। সে কারণে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক প্রয়াসকে আরও বাড়াতে হবে। বিপদ মোকাবিলার জন্য প্রতিরোধী শক্তিকে আরও কঠিন লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে।
Md Salim
ভারতের বহুত্বকে অস্বীকার করতেই এসআইআর, বাংলাদেশি জিগির: সেলিম

×
Comments :0