শেফালির স্বপ্নের ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকার। নবি মুম্বাইয়ের গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন শচীন। স্টেডিয়ামে নিজের আর্দশকে দেখেই কী জ্বলে ওঠার অনুপ্রেরণা পেলেন শেফালি? ম্যাচের সেরার পুরস্কার হাতে নিয়ে সেকথাই বললেন শেফালি। তাঁর কথায়, ‘মাঠে শচীন স্যারকে দেখতে পেয়েই আমার আত্মবিশ্বাস-মনোবল অনেকটাই বেড়ে যায়। আমি যে সমস্যায় শচীনের সঙ্গে কথা বলি, তিনি আমাকে সবসময় আত্মবিশ্বাস জোগায়। উনি ক্রিকেটের মাস্টার। শুধু আমি নই, আমরা সবাই ওনাকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই।’
শচীনের সামনেই অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। শুধু মাত্র ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও। প্রথমে ৭৮ বলে ৮৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলা পর, বোলিংয়ে নিজের প্রথম দু’ওভারেই ম্যাচের গতিপ্রকৃতি বদলে দিলেন শেফালি। রেকর্ড গড়লেন তিনি। মহিলাদের একদিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের হয়ে তিনি সর্বাধিক রান করলেন। শেফালি রানের ইনিংস ভেঙে দিল পুনম রাউতের ২০১৭ সালে করা ৮৬ রানের রেকর্ড। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে তিনি এই রান করেছিলেন।
বিশ্বকাপে দলের ধারে-কাছে ছিলেন না শেফালী। স্বপ্নেও ভাবেননি এবারের ওডিআই বিশ্বকাপে খেলবেন তিনি। গত সোমবারও মহিলাদের ঘরোয়া টি-২০’তে খেলেছেন নিজের রাজ্যের হয়ে। হঠাতই গ্রুপের শেষ ম্যাচে ছন্দে থাকা ওপেনার প্রতীকা রাওয়াল চোট পান, শিকে ছেঁড়ে শেফালির। বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পেয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ২০০ শতাংশ উজাড় করে দেব।’ নেটে ব্যাটিংয়ের সময় দেখা গিয়েছিল, তাঁর শটের পরিধি বেড়েছে। তাঁর ব্যাটিংয়ে যোগ হয়েছে একাধিক নতুন শট। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শুরুটা ভালোই করেছিলেন। কিন্তু দু’টি চার মারার পর ৫ বলে ১০ করে ফিরতে হয় তাঁকে। ব্যর্থ বলা চলে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জ্বলে উঠলেন সবচেয়ে বড় মঞ্চে। বিশ্বকাপের ফাইনালে।
নভি মুম্বাইয়ের মাঠের চারিদিকে শটের পসরা সাজালেন তিনি। ৭টি চার ও ২টি ছয় দিয়ে সাজানো ইনিংসটি ফাইনালে প্রায় ৩০০ রানে পৌঁছে দেয়। তিনি যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন ততক্ষণ ভারতের রান ছিল ওভার প্রতি ৬। স্মৃতি মান্ধানার সঙ্গে তিনি ১০২ রানের জুটি গড়েন। শুরু থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার কোনও বোলারকে মাথায় চড়তে দেননি, আগ্রাসী ক্রিকেটে জারি রেখে। প্রতিনিয়ত স্টেপ আউট করছিলেন, জায়গা বানিয়ে অনায়াসে বোলারদের বাউন্ডারি ফেলছিলেন। শুধু তাই নয়, কব্জির মোচড়ে ফ্লিকও মারলেন সহজাত ভঙ্গিমায়। ফলে, বিপক্ষের বোলাররা দিশেহারা হয়ে যান শেফালির সামনে। ডি ক্লার্কের গুড লেংথের বলকে সোজা বাউন্ডারির বাইরে ফেলেন শেফালী। পাওয়ার হিটিংয়ে শিউন লুসকে ফেলে দিলেন বাউন্ডারির বাইরে। ছোট ব্যাকলিফটে কোনও ফলো থ্রু ছাড়াই বল মাঠের বাইরে যায়। তাঁকে ফিরিয়ে দেন খাকা। তার আগের ওভারেই খাকাকে একস্ট্রা কভারের উপর দিয়ে তুলে বাউন্ডারি আদায় করেন শেফালী। তিনি যেভাবে সাবলীল ছন্দে ব্যাটিং করছিলেন, সবাই ধরে নিয়েছিল শেফালির শতরান আসছেই। উচ্ছ্বসিত হয়ে টুইট করেন রবিচন্দ্রন অশ্বিনও। তিন অঙ্কের রানে পৌঁছানোর ১৩ রান বাকি থাকতে, খাকার শিকার হয়ে নিরাশ করেন দেশবাসীকে। তবুও তাঁর সাহসী-লড়াকু ইনিংসে গর্বিত ভারতবর্ষ।
ব্যাট হাতের পর বল হাতে ভেলকি। নবি মুম্বাইয়ের বাইশ গজে বল গ্রিপ হচ্ছে। এমন উইকেটে স্পিনাররা সাহায্য পান। অধিনায়ক হরমনপ্রীত বল তুলে দেন শেফালির হাতে। দ্বিতীয় বলেই উলভার্ট ও লাসের জুটি ভাঙলেন, লাসকে ফিরিয়ে। নিজেই ক্যাচ নিলেন। পরের ওভারে বোলিং করতে এসে নিলেন গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। প্যাভিলিয়নে পাঠালেন দক্ষিণ আফ্রিকার নির্ভরযোগ্য ব্যাটার মারিজান কেপকে। ব্যাট হাতে ৮৭’র পর, দু’ওভার হাত ঘুরিয়ে ছ’রানের বিনিমিয়ে দু’উইকেট নিয়ে ফাইনালে স্বপ্নের পারফরম্যান্স। তিন বছর পর অর্ধশতরান এল শেফালীর। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৭১ করেন। পরের ম্যাচেই ৪৯। তার পর আর রান পাননি। পরবর্তী ১১টি খেলায় তাঁর সংগ্রহ ছিল ১৩২। দল থেকে বাদ পড়েন। তবে টি-২০ খেলেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। তিনটি শতরানও করেছিলেন। যার মধ্যে একটা ১৯৭ ছিল বাংলার বিপক্ষে। তাও দলে সুযোগ হচ্ছিল না। সুযোগ পেলেন বিশ্বকাপ নক আউটে। পেয়েই ইতিহাস গড়লেন। দু’বছর আগে তাঁর নেতৃত্বে মহিলাদের অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। আর এবার সিনিয়র মহিলা বিশ্বকাপে দেশকে চ্যাম্পিয়ন করতে ভূমিকা নিলেন শেফালি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বললেন, ‘ফাইনালে দেশকে জেতাতে পেরে আমি খুব খুশি। এই অনূভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমার মনে হয়, আমি যদি চাপের মুখে শান্ত থাকতে পারি, তাহলে আমি সবকিছু অর্জন করতে পারবো। ফাইনালে ঠান্ডায় মাথায় খেলার চেষ্টা করেছি। আমার পরিবার, বন্ধু, ভাই, সবাই ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা আমার খারাপ সময়ে সমর্থন জুগিয়েছে।
Women’s World Cup
সুযোগ পেয়েই বাজিমাত
×
Comments :0