গল্প — নতুনপাতা, বর্ষ ৩
একোরিয়াম
সৌরভ ঘোষ
স্কুল থেকে ফিরে একোরিয়ামের সামনে কিছুক্ষণ না দাঁড়ালে পীয়ূষের খবার হজম হয় না। পীয়ূষ এখন পঞ্চম শ্রেণি। মা রাখি রায়ের তাকে নিয়ে হয়রানির শেষ নেই। বার্ষিক পরীক্ষা এগিয়ে আসছে অথচ সে সারাদিন ব্যাটারি, মটর, পাখা, ফুলের বাগান নিয়ে ব্যস্ত। স্কুল যাবার আগে ফুলের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তো দাঁড়িয়েই থাকে। মা যখন বলে, “কী হল রে? স্কুল যাবি না নাকি?” তখন তার সম্বিত ফেরে।
বসার ঘরের এককোণে টেবিলের ওপর রাখা ছোট্ট একোরিয়ামটা তার খুব প্রিয়। ছ'টা রঙিন মাছ তার মধ্যে সারাদিন খেলে বেড়ায়। ছ'টার মধ্যে পাঁচটা নতুন, আয়তনে ছোট, লাল রঙ। তাদের পাখনাগুলো আঁকার তুলির মত নরম। ওরা যখন সাঁতার কাটে তখন ওদের পাখনাগুলো বাতাসে ওড়া চুলের মত মনে হয়। পুরোনো মাছটার রঙ কালো, লম্বায় ইঞ্চি তিনেক হবে। পীয়ূষের সবসময় মনে হয় বড়টা দুষ্টু। তাকে শাসায়, "এদের ক্ষতি করলে তোর খাবার বন্ধ করে দেব কিন্তু। সাবধানে থাকবি…"
এই ক- দিন পীয়ূষের মন খুব খারাপ। চারটে ছোটো মাছ হঠাৎ মারা গেছে। কত সখ করে বাবার সাথে গিয়ে কিনে এনেছিল। কী সুন্দর লাগত ওরা যখন একোরিয়ামের মধ্যে ছুটোছুটি করত।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে পীয়ূষ একোরিয়ামের মাছ দুটোকে খাবার দিচ্ছিল। বড় মাছটা খেতে খেতে হয়ত ভুলবশত ছোট মাছটাকে কামড়ে ফেলেছে। এতে ছোট মাছটার পিঠের পাখনাটা সামান্য ছিঁড়ে গেল। পীয়ূষ প্রচণ্ড রেগে বড় মাছটাকে ধরে মেঝেতে আছাড় মেরে বলল, "দুষ্টু মাছ, খুনি মাছ। আজ তোকে মেরেই ফেলব।"
পীয়ূষের মা ছুটে এসে সে যাত্রায় কোনোক্রমে মাছটার প্রাণ বাঁচায়।
পীয়ূষ বলে, "মা, তুমি জানো না, ও খুব বাজে মাছ। ও খুনি।"
মা হেসে পীয়ূষের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, "এই যে তুমি ওকে এত কষ্ট দিলে, এটা কি ঠিক? তাছাড়া ওর জায়গা তো এখানে নয়। তুমি নিজের আনন্দের জন্য ওকে বন্দি করেছ। অন্যকে দোষ দেওয়ার আগে নিজের অপরাধটা বিচার করতে হবে।
পীয়ূষ অনেক ভাবল, সারা সন্ধে ভাবল, ঘুমোতে যাবার আগে অবধি ভাবল। সকালে উঠেই মাছ দুটোকে সে বাড়ির পাশে রূপনারায়ণের অস্থির স্রোতে ছেড়ে এল। এরপর থেকে একোরিয়ামের লাইটটা আর কখনও জ্বলেনি।
Comments :0