এগিয়ে চলার পথে-৫
---------------------
আগামী ২৯ নভেম্বর কোচবিহারের তুফানগঞ্জে শুরু হবে সিপিআই(এম)’র ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা।’ ১৭ডিসেম্বর যাত্রা শেষ হবে কামারহাটিতে। তৃণমূলের অপশাসনে, বিজেপি’র নীতিতে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চক্রান্তে বিপন্ন পশ্চিমবঙ্গ। এই পরিস্থিতিতে মানুষের প্রতিদিনকার সমস্যাগুলি নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া, তাঁদের সঙ্গে আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে প্রায় এক হাজার কিমির এই যাত্রা। এই পরিস্থিতিকে তুলে ধরতেই গণশক্তির এই প্রতিবেদন।
------------------------------------------------
‘শম্ভুচরণ নাথ
মাটিগাড়ায় শিবের মন্দিরের ঘোষণা শুনেছেন রীণা গুরুঙ। দলসিংপাড়া বাগানের শ্রমিক তিনি। সেই বাগান তিন বছর ধরে বন্ধ। রীণার প্রশ্ন, ‘‘মন্দির খুলছে সরকার। আর আমাদের বাগান খোলার জন্য কোনও ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না?’’ বন্ধ দলসিংপাড়া বাগানে শ্রমিকদের ন’মাস ধরে ফাউলই ভাতাও বন্ধ।
রাজ্যের ২৯টি চা বাগান বন্ধ এখন। সম্প্রতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতি হয়েছে অনেকগুলি চা বাগানের। সঙ্কটে ছিল, আরও সঙ্কটে পড়েছে চা বাগানের উৎপাদন। মারাত্মক অবস্থায় চা বাগানের শ্রমিকরা।
বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন চা বাগান শ্রমিকরা। তিন মাস মজুরি নেই বাগরাকোট চা বাগানের শ্রমিকদের। গত সোমবার ফ্যাক্টরির গেট ঘেরাও করেন তাঁরা। বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের অভিযোগ কী? তিন মাস মজুরি হয়নি। শারদোৎসবে ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়ার কথা ছিল। দেওয়া হয়েছে ১০ শতাংশ। কালচিনির সুভাষিণী বাগানের সঙ্কটের মাত্রা আরও প্রবল। সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের সময়ে তোর্সা নদীর জল বাগানে ঢুকে চা গাছের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। সাতটি শ্রমিক আবাসন জলের দাপটে বিপন্ন হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি যেমন ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, এবং সন্তানদের বিভিন্ন শংসাপত্র বন্যার জলে ভেসে গিয়েছে।
প্রশাসনের উদ্যোগ? নেই। বিজেপি’র সাংসদ, তৃণমূলের বিধায়ক মন্ত্রীদের দেখা নেই।
চা বাগানের উন্নতির জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, রাজ্যের তৃণমূল সরকারের অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল। এখন দুই সরকারের শাসকদলের কেউই চা বাগানের প্রসঙ্গে কোনও কথা বলেন না। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর, দার্জিলিঙের মতো জেলাগুলির পরিযায়ী শ্রমিকদের বড় অংশ চা বাগান এলাকার মানুষ। শুধু পুরুষ শ্রমিক নন অনেক মহিলা শ্রমিকও আছেন।
বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক মহল্লার অনেকেই অর্ধাহারে। সেখানে ঘরে ঘরে অপুষ্টি। অসুখ অসুস্থতা ঘরে ঘরে। রাতে দেখতে না পাওয়ার সমস্যা আছে। রক্তাল্পতা, ভিটামিনের অভাব এবং চর্মরোগের মতো অসুখও প্রতি ঘরেই রয়েছে। চা বাগানগুলিতে চলমান আর্থিক সঙ্কটের সুযোগ নিচ্ছে দালালচক্র। কম মজুরি, দারিদ্র্য ও কাজের অনিশ্চয়তায় নারীদের ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে তারা। এভাবেই বাড়ছে নারী পাচার। গত জুলাই মাসে জলপাইগুড়ি জংশন থেকে ৫৬ জন এবং ২৮ জুলাই শিলিগুড়ি জংশন থেকে ৩৪ জন বাগানের মেয়েকে পাচার হওয়ার আগে উদ্ধার করেছে। ওঁরা এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু বাগানে বাগানে কত মেয়ে এভাবে পাচার হয়ে গিয়েছেন তার হিসেব কে রাখে! নজরদারি, সচেতনতা ও বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা জরুরি নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয় চা বাগান এলাকার বাসিন্দাদের বড় সঙ্কট তৈরি করেছে। অনেক এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, আছে তো ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই। সামান্য অসুস্থতাতেও মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছন, অনেক সময় ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়। পাশাপাশি প্রতিদিন হাতের ঝুড়ি নিয়ে তাঁরা সারি সারি গাছে ঢুকে পড়েন। নরম পাতা তুলতে তুলতে রোদে পুড়ে যায় শরীর, বৃষ্টিতে ভিজে যায় সারা দিন, তবুও থামে না তাঁদের কাজ। কারণ এই পাতাগুলির ওজনেই নির্ধারিত হয় তাঁদের মজুরি, যা প্রায়ই জীবিকার তুলনায় অপ্রতুল। শিশুরা অনেক সময় স্কুলে যেতে পারে না। ছোটবেলা থেকেই মায়ের হাত ধরে কাজে নামতে হয়। বাড়ছে ড্রপ আউট।
এই দুর্দশার বিরুদ্ধে মানুষের দাবিগুলিতে সোচ্চার হবে ‘বাংলা বাঁচাও যাত্রা’।
শ্রমিকনেতা বিদ্যুৎ গুন, বিকাশ মাহালীদের কথায়, ১৯৫১ সালে লেবার প্ল্যান্টেশন অ্যাক্টের মাধ্যমে শ্রমিকদের ঘর, জল, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মালিকদের ব্যবস্থা করার আইন চালু হলো। কিন্তু শ্রমিকরা তা পাচ্ছেন কিনা, বা না পেলে মালিকরা কি শাস্তি পাবে? তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। আপাতদৃষ্টিতে সরকারের তৈরি আইন উল্লেখযোগ্য মনে হলেও সরকারের তদারকির অভাবে বাগানের ম্যানেজার ও বাবুরা শ্রমিকদের কাছে মা-বাপ হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামলেও তাতে মালিকপক্ষ আর সরকারের বোঝাপড়া শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে।
Comments :0