মধুসূদন চ্যাটার্জি: বাঁকুড়া
জোর করে টাকা আদায় করতে হেনস্তার পরে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে চাপ দেওয়া হয় এক গরিব হকারকে। বলতে রাজি না হওয়ায় ঐ হকারের ঘাড়ে এবং পেটে ভোজালি দিয়ে কোপ মারার বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটেছে শনিবার দুপুরে বাঁকুড়া শহরের কানকাটা সংলগ্ন রাস্তায়। আক্রান্তের নাম মাইমুর আলি মণ্ডল (৬০)। তাঁর বাড়ি ওন্দা থানার পুনিশোল গ্রামে। আক্রমণকারী তিন যুবকের বাড়ি বাঁকুড়া শহরের লোকপুর সহিসপাড়ায়। পুলিশ হামলাকারীদের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে রবিবার বাঁকুড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে যে ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে অপরাধমূলক, এটি সাম্প্রদায়িক নয়। ভুক্তভোগীকে ধর্মীয় স্লোগান দিতে বাধ্য করার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
এই ঘটনায় গোটা পুনিশোল গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ প্রতিদিন পুনিশোলের বহু গরিব মানুষ সূর্য ওঠার আগেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ১২কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়া শহরের উদ্দেশ্যে। তাঁরা নানা পাড়া ঘুরে টিন, লোহা ভাঙা, ভাঙা চেয়ার, পুরানো খবরের কাগজ সহ যাবতীয় পুরানো জিনিস পরিবারগুলির কাছ থেকে কেনেন। সেগুলি সন্ধ্যার পর পুনিশোল ও বাঁকুড়া শহরের কয়েকটি পুরানো জিনিসপত্র কেনার আড়তে বিক্রি করেন। এটাই তাঁদের সংসার চালানোর প্রধান উৎস। কোনোদিন ধর্মীয় জিগির তুলে হামলার শিকার তাঁরা হননি। শনিবার প্রথম এই এই ধরনের আক্রমণের ঘটনায় তাঁরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন।
রবিবার পুনিশোল গ্রামে গিয়ে দেখা গেল পুরো গ্রাম আতঙ্কে থমথম করছে। পুনিশোল গ্রামের শেষ প্রান্তে মুক্ষা বা রিয়াপাড়া নামে পরিচিত এলাকায় বাস করেন মাইমুর আলি মণ্ডল। তাঁর তিন ছেলে, দুই মেয়ে। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে হাসিবুদ্দিন মণ্ডল লেখাপড়া ছেড়ে তাঁর বাবার মতো পুরানো জিনিস কিনে বিক্রির জন্য সকাল থেকে বের হয়। বাকি দুই ছেলেও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, কোনও রোজগার নেই। পিতাপুত্রের টিন, লোহাভাঙা, পুরানো খবরের কাগজের হকারির ওপরেই পুরো সংসার টিকে আছে।
এদিন ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়েই মাইনুর আলি মণ্ডল জানান, শনিবার সকালে কিছু না খেয়েই ঘর থেকে সাইকেল ও বস্তা নিয়ে বের হই। লোকপুর, কেন্দুয়াডিহি, কানকাটা সহ একাধিক এলাকায় গিয়ে গৃহস্থের কাছ থেকে জিনিসপত্র কিনি কম দামে। দুপুর ১টা নাগাদ লোকপুর থেকে ভৈরবস্থানের দিকে যাওয়ার সময় কানকাটার আগে পিচরাস্তার ধারে একটি পুকুরের সামনে একটি টোটো আমার সাইকেলে ধাক্কা মারে। তিনজন যুবক ঐ টোটোতে ছিল। আমি সাইকেল নিয়ে পড়ে যাই, সাইকেলের পেছনে কাগজ ও পুরানো মালপত্র ছিল। টোটোর তিন যুবক আমার কাছে এসে প্রথমে ২০০ টাকা চায়। আমি বলি, টাকা কোথায় পাব? তখন ওরা বলে, ‘জয় শ্রীরাম’ বল। আমি বলতে না চাওয়ায় ওরা পকেট থেকে ভোজালি বের করে আমার কাঁধে ও পেটে কোপ মারে। রক্তাক্ত হয়ে আমি পড়ে যাই। মাইমুর আলি মণ্ডল আরও জানান, ঐ তিনজন এরপর আমাকে হুমকি দিয়ে যায় যে বাঁকুড়া হাসপাতালে গেলে সেখানে খুন করা হবে আমাকে।
জানা গেছে, ঘটনার পর ঐ হকারের সারা শরীর রক্তে ভিজে যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা ভয়ে অথবা অন্য কোনও কারণে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ পর এই রাস্তা দিয়ে পেরোনো অন্য এক হকার তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁর সঙ্গে অনেক কষ্টে রক্তাক্ত শরীরে সাইকেলেই নিজেদের গ্রাম পুনিশোলের দিকে এগোতে থাকেন মাইমুর আলি মণ্ডল। রাস্তাতেই পড়ে থাকে সংগ্রহ করা জিনিসপত্র। তাঁর ছেলে নাজিবুদ্দিন মণ্ডল জানান, বিকালের দিকে গ্রামের আমাদের এক আত্মীয় সাইমুর আলি মণ্ডল ফোন করে আমাদের ঘটনার কথা জানান। আমরা এগিয়ে গিয়ে বেনাজিরা এলাকা থেকে বাবাকে নিয়ে আসি। সন্ধ্যায় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পেটে ও ঘাড়ে সেলাই করেন চিকিৎসকরা। ততক্ষণে শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বের হয়েছে। নেতিয়ে পড়েছিল তাঁর শরীর।
রবিবারও ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তিনি বলেন, ৩২ বছর ধরে বাঁকুড়ায় ফেরিওয়ালার কাজ করছি, এই গ্রামের হাজারো গরিব মানুষ বাঁকুড়ায় যান। বাঁকুড়ার মানুষের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো, কোনোদিন এরকম ঘটনা ঘটেনি। এখন আমাদের ভয় লাগছে বাঁকুড়ায় যেতে। গ্রামের যুবক গোলাম খাজা খাঁন জানান, আমরা ভাবতে পারছি না এরকম ঘটনা ঘটেছে। কোনোদিন এমন ঘটনা ঘটেনি। মানুষ শান্তিতে কাজ করেছেন।
মাইনুর আলি মণ্ডলের স্ত্রী হাসিফুন বিবি কান্নায় ভেঙে পড়ে জানান, এই হকারি করেই আমাদের দিন চলে। আমরা এবার সংসার চালাবো কী করে? হাসপাতাল থেকে যে ওষুধগুলি লিখে দিয়েছে সেগুলো কিনব কি করে?
গ্রামের বাসিন্দারাও এদিন অপরাধীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
রবিবার বাঁকুড়া থানার আইসি সুজয় তুঙ্গে জানান, সাগর সহিস নামে একজনকে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। এদিনই বাঁকুড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সোশাল মিডিয়াতে দাবি করা হয়েছে, পুনিশোলের এক ফেরিওয়ালাকে বাঁকুড়া শহরে এক মাদকাসক্ত ব্যক্তি ২০০ টাকা দেওয়ার দাবি করলে, সে দিতে অস্বীকার করায়, উক্ত ব্যক্তি ওই ফেরিওয়ালাটিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। ঘটনাটি সম্পূর্ণরূপে অপরাধমূলক, এটি সাম্প্রদায়িক নয়। ভুক্তভোগীকে ধর্মীয় স্লোগান দিতে বাধ্য করার অভিযোগ ভিত্তিহীন। নাগরিকদের অনুরোধ করা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সত্যতা যাচাই না করে ভুয়ো খবর প্রচার করবেন না।
মন্তব্যসমূহ :0