‘মহিলাও কি গরিমা কে সাথ খিলওয়াড় নেহি চলেঙ্গে’, মোদী-শাহকে হুঁশিয়ারি দিয়ে শুক্রবার দিল্লি হাইকোর্টের সামনেই বিক্ষোভ দেখালেন মহিলারা। অমিত শাহের পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর চোখে চোখ রেখে তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, মেয়েদের সম্ভ্রম নিয়ে ছেলেখেলা চলবে না। হাজার চেষ্টা করেও মহিলাদের ক্ষোভের আগুন ধামাচাপা দিতে পারেনি তারা। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেতৃত্বে এদিন শ’য়ে শ’য়ে মহিলা হাইকোর্টের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান তুলেছেন, ‘কুলদীপ সেঙ্গার কি উমর কাইদ কা সাজা বরকারার রহে’ (সেঙ্গারের যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখতে হবে)। উন্নাও সহ দেশের কোণে কোণে বিজেপি রাজত্বে যে লক্ষ লক্ষ নির্যাতিতা ন্যায়বিচারের আশায় বসে রয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরা বলেছেন, ‘গুনেহগারো কো বাচানা বন্ধ করো’ (দোষীদের বাঁচানো বন্ধ করো)। হাইকোর্ট চত্বরে এদিন উপস্থিত ছিলেন নির্যাতিতা এবং তাঁর মা-ও। দু’জনে বিক্ষোভ-আন্দোলনে যোগ দিতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লি পুলিশ তাঁদের গাড়ি থেকে নামতেই দেয়নি। সিপিআই(এম)’র বর্ষীয়ান নেত্রী বৃন্দা কারাতের সঙ্গে এদিন ফোনে কথা হয়েছে নির্যাতিতা ও তাঁর মায়ের। এখন জয়পুরে রয়েছেন বৃন্দা কারাত। দিল্লি ফিরেই তাঁর দেখা করার কথা হয়েছে নির্যাতিতার সঙ্গে।
সাংবাদিকরা কোনওরকমে এদিন কথা বলার সুযোগ পান নির্যাতিতা ও তাঁর মায়ের সঙ্গে। নির্যাতিতা বলেন, ‘দেশের মহিলাদের কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে, এই প্রশ্নটা প্রকাশ্যে তুলতেই হাইকোর্টের বাইরে প্রতিবাদে যোগ দিতে গিয়েছিলাম।’ নাগরিক হিসেবে প্রশ্ন তোলার অধিকারে জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন তোলা আমার অধিকার এবং জনসাধারণেরও অধিকার। সব বিচারপতি অবশ্যই এক রকম নন।’ জামিনের এই নির্দেশ তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা এবং রোজগারের রাস্তা— দু’টিকেই বিপদে ফেলে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্যাতিতা। বলেন, ‘এই নির্দেশ আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেক মহিলাকে খাঁচাবন্দি করে দিল। এটি আমার পরিবারের জন্য হুমকি। আমার স্বামী তাঁর চাকরিও হারিয়েছেন। আমরা কী করব এখন?’ শীর্ষ আদালতের উপর ভরসা রেখে নির্যাতিতা বলেন, ‘আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাব এবং আমার অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আগেও আমাকে ন্যায়বিচার দিয়েছে এবং আমি নিশ্চিত এবারও দেবে। ভয় দেখিয়ে আমাকে চুপ করানো যাবে না। ওরা ভেবেছিল আমরা চুপ করে যাব। আমরা ভয় পাব না।’ এই লড়াইকে মহিলাদের অধিকারের বৃহত্তর সংগ্রাম বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জেলে যেতে হলে যাব। কিন্তু লড়াই থামাবো না।’
প্রসঙ্গত, মঙ্গলবার দিল্লি হাইকোর্ট বিজেপি নেতা কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে ধর্ষণ মামলায় জামিন দিয়ে দেয়। ওই মামলায় দোষীসাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা পেয়েছিল বিজেপি’র প্রাক্তন বিধায়ক। গোটা জীবনই তার হাজতবাস করার কথা ছিল। সেখানে কয়েকবছর কারাবন্দি থেকেই ছাড় পেয়ে গেল। সেঙ্গারের জামিন খারিজ করার আরজি জানিয়ে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে দু’জন মহিলা আইনজীবী পিটিশন দাখিল করেছেন। রায়ের দিন সন্ধ্যাতেই নির্যাতিতা ও তাঁর মা ইন্ডিয়া গেটের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে গেলে পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী তাঁদের আটকে দেয়। রীতিমতো টেনে হিঁচড়ে তাঁদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করা হয়। সংবাদমাধ্যমের সামনে রাগ, হতাশা, যন্ত্রণা উগরে দিয়ে নির্যাতিতা বলেছিলেন সেদিন, ‘আমি মা না হলে ওই দুই বিচারপতির সামনে দাঁড়িয়ে জীবন শেষ করে দিতাম।’
সেঙ্গারের জামিনের নির্দেশ বাতিল করার দাবিতে দেশজুড়েই বামপন্থী মহিলারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এদিন প্রতিবাদীদের একজন মোদী সরকারকে তুলোধনা করে বলেন, ‘আদালতে ছুটি পড়ার দিন দু’য়েক আগে জামিন দিয়ে দেওয়া কোনও কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে না। এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। দেশের মানুষজনকে কি বোকা পেয়েছেন নাকি? আর কতদিন আমাদের সঙ্গে এই প্রতারণা চলবে?’ আরেকজনের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা, ‘জনবাদী দেশ মে মনুবাদী রাজনীতি কা কোই ঔচিত্য নেহি’ (গণতান্ত্রিক দেশে মনুবাদী রাজনীতির কোনও জায়গা নেই), প্রশাসন-বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে চিৎকার করে বললেন, ‘ও (সেঙ্গার) একজনকে ধর্ষণ করেছে, যাকে ধর্ষণ করেছে তার বাবাকে মেরে দিয়েছে। এরকম মানুষগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া বন্ধ করুন।’
বিক্ষোভের তেজ ক্রমশ বাড়তে থাকলে দিল্লি পুলিশ মাইক নিয়ে বলতে শুরু করে, প্রতিবাদ দেখাতে হলে যন্তর মন্তরে যান। হাইকোর্টের সামনে এসব হবে না। আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু কোনওভাবেই মহিলাদের দমানো সম্ভব হয়নি। তাঁরা হাইকোর্টের সামনেই আকাশ ফুঁড়ে স্লোগান তুলেছেন। মোদী সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছেন মহিলাদের সম্ভ্রম নিয়ে ছেলেখেলা করার কোনও অধিকার তাদের নেই। আন্দোলনকারী এক মহিলা বলেন, ‘সরকার যদি সেঙ্গারের জামিন খারিজ করতে পারে ভালো, তা না হলে এই সরকারকেই খারিজ করা দরকার।’
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি (এআইডিডব্লিউএ)-র সাধারণ সম্পাদক মারিয়ম ধাওয়ালে, সংগঠনের দিল্লির সভানেত্রী আশা যাদব, সম্পাদক কবিতা শর্মা, মহিলা নেত্রী সর্বানী সরকার প্রমুখ ছিলেন এদিনের বিক্ষোভ-সমাবেশে। পরে মারিয়ম ধাওয়ালে বলেন, ‘ধর্ষক, খুনি সেঙ্গারকে জামিন দিয়ে দিল্লি হাইকোর্ট গোটা দেশকে বার্তা দিল যে আমাদের বিচার ব্যবস্থা ধর্ষক, খুনিদের রেহাই দিয়ে দেয়। আর মোদী-শাহ সরকার তো ধর্ষকদের রক্ষাকর্তাই। কারণ বেশির ভাগ ধর্ষকই তাঁদের দলের। যাদের অন্যতম ব্রিজভূষণ শরণ সিং। আরেক জন প্রজ্জ্বল রেভানা, তাঁর জন্য তো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারও করেছিলেন। এখন ধর্ষণের দায়ে তিনি জেলে। আসারাম বাপু, রাম রহিমের মতো তথাকথিত ধর্মগুরুরা বিজেপি’র প্রচার করে। এঁরাও ধর্ষণের অভিযোগেই জেলবন্দি। এসব দেখতে দেখতে দেশের মহিলারা সত্যিই বিরক্ত, হতাশ। বারবার মহিলাদের সঙ্গে অবিচার করা হচ্ছে।’ উন্নাওয়ের নির্যাতিতার সঙ্গে পুলিশ যে জঘন্য আচরণ করছে, তা নিয়েও ক্ষোভ জানান মারিয়ম। বলেন, ‘এমন ভাব করা হচ্ছে যেন উনি অপরাধী। আজও আমাদের সঙ্গে আন্দোলনে সাথ দিতে এসেছিলেন। কিন্তু গাড়ি থেকে নামতেই দেওয়া হলো না। ওঁর জীবনই এখন হুমকির মুখে রয়েছে। ইন্ডিয়া গেটের সামনে সেদিন যখন বিক্ষোভে বসলেন, তখনও একই আচরণ করা হলো। এই তো অবস্থা মহিলাদের। বিজেপি রাজত্বে যেভাবে আমাদের দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে মহিলা, প্রান্তিক অংশের মানুষকে আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে।’ এআইডিব্লিউএ’র দিল্লি-এনসিআর রাজ্য কমিটি এদিন এক বিবৃতিতে বলেছে, বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াওয়ের স্লোগান দিয়ে, সকালে নারীশক্তি নিয়ে লম্বাচওড়া বক্তৃতা দিয়ে দুপুরে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের ছেড়ে দেওয়া হয়। কাঠুয়ায় ধর্ষকদের সমর্থনে জাতীয় পতাকা হাতে মিছিল হয়, হাথরসে ধর্ষিতার মৃত্যুর পর তাঁর দেহ দ্রুত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আর এখন উন্নাওয়ের নির্যাতিতার ধর্ষকের জামিন। এই মনুবাদী রাজনীতি থেকে কোনও ভরসা নেই ঠিকই, কিন্তু আদালতের কাছে অবশ্যই প্রত্যাশা আছে। আমাদের দাবি, অভিযুক্ত-অপরাধীর পদ, প্রভাব, ধর্ম, বর্ণ যাই হোক না কেন, তাদের কোনওরকম সুরক্ষা দেওয়া উচিত নয়। সে প্রশাসনিক হোক বা রাজনৈতিক বা বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত। বিজেপি’র প্রাক্তন বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গারকে দেওয়া জামিন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এবং তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই যেন বহাল থাকে।
Sengar Protest
সেঙ্গারের জামিন খারিজের দাবিতে দিল্লি হাইকোর্টের সামনেই বিক্ষোভ মহিলাদের
×
Comments :0